এ্যাডহক কমিটি নিয়ে বেসরকারি কলেজে টাকার ছড়াছড়ি

সেখ রাসেল, ব্যুরো চিফ, খুলনা:
​ খুলনার একাধিক বেসরকারি কলেজ পরিচালনায় অ্যাডহক কমিটি গঠন নিয়ে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ১৫ বছর অধিকাংশ কলেজের সভাপতি পদ ছিল আওয়ামী লীগের এমপি অথবা প্রভাবশালী নেতাদের দখলে।
শিক্ষার্থীদের মেধাবিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালনের কথা থাকলেও বিদ্যাপীঠকে অনিয়ম ও দুর্নীতির তীর্থভূমিতে পরিণত করার অভিযোগ ছিল তাদের বিরুদ্ধে। শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে বেসুমার অর্থ বাণিজ্য; ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তি ও পরীক্ষার ফি, প্রবেশপত্র, সনদপত্র সহ বিভিন্ন খাতে সংগৃহিত অর্থ ফান্ডে জমা না দিয়ে তছরূপ এবং কলেজের অবকাঠামো উন্নয়নে বরাদ্দ থেকে কমিশন বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা লুটে নিয়েছেন তারা। প্রায় ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট কলেজের প্রিন্সিপালরা ছিলেন সভাপতির অনিয়মের প্রধানতম সহায়ক।
আগস্ট বিপ্লবের পর আওয়ামী দোসর এই সব সভাপতিরা পালিয়ে গেছেন। কলেজ প্রিন্সিপালদের কেউ কেউ পলাতক। কেউ আত্মগোপন থেকে ফিরেছেন। কেউ বহাল আছেন, তবে রয়েছেন নানামুখি চাপে। বেসরকারি কলেজের সভাপতির পদটি লাভজনক বিবেচিত হওয়ায় রাজনীতি সম্পৃক্ত অনেকেরই ব্যাপক উৎসাহ এই পদে আসীন হওয়া নিয়ে। ফলে এক পক্ষের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা, অন্যপক্ষের নতুন করে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে পরিবেশ। বেড়েছে অবৈধ অর্থের ছড়াছড়ি, বেড়েছে পেশীশক্তি প্রদর্শণের প্রবণতা। অ্যাডহক কমিটি অনুমোদন নিয়ে দোদুল্যমান অবস্থান ও বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়কে গভীরভাবে বিতর্কিত করেছে। অভিযোগ উঠছে অর্থ লেনদেনের। কলেজ কেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্থানীয় প্রশাসন কোন কোন সময় বিতর্কিতদের পক্ষ অবলম্বন করছে বলেও সুস্পষ্ট অভিযোগ মিলছে। আর উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে পুলিশ প্রশাসন অনেকটাই নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
সবুরননেছা মহিলা ডিগ্রি কলেজ :
ইন্টারমিডিয়েটে এবার ১০০ ছাত্রীও ভর্তি হয়নি। অনার্সে স্টুডেন্ট নেই, ছাত্রী পাওয়া যায়না ডিগ্রিতে। গোটা কলেজে স্টুডেন্ট আছে দু’শর মতো, রেজাল্টও আহামরি নয়। অথচ এই কলেজের অ্যাডহক কমিটি গঠনে ঘটেছে নজিরবিহীন ঘটনা। পাঁচ দফা পরিবর্তনের পর ৬ষ্ঠ বারের মতো কমিটি দিয়েছে জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়। অধ্যক্ষ ও স্থানীয় বিএনপি নেতাদের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে কলেজে হামলার ঘটনাও ঘটেছে। ফলে আড়াই মাস যাবৎ তালাবদ্ধ অধ্যক্ষের রুম। এই চিত্র খুলনার বেসরকারি সবুরননেছা মহিলা ডিগ্রি কলেজের। বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারী) ৬ষ্ঠ বারের মতো অ্যাডহক কমিটি পেয়েছে কলেজটি। খুলনা বিশ^বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ডীন প্রফেসর ড. শাহজাহান কবির সভাপতি হয়েছেন। জানা গেছে, ১৯৯২ সালে গগন বাবু রোডে প্রতিষ্ঠিত হয় কলেজটি। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ছিলেন খুলনা-২ আসনের এমপি নজরুল ইসলাম মঞ্জু। সে সময় মরিয়ম ছিদ্দীকাকে অধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৪ সালে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হন মহানগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এম ডি এ বাবুল রানা। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের আগ পর্যন্ত এ দায়িত্ব ভোগ করেছেন দোর্দন্ড প্রতাপশালী এই নেতা। স্বল্প সংখ্যক শিক্ষার্থীর এই কলেজে এমপিওভূক্ত শিক্ষক রয়েছেন ৩৪ জন, নন এমপিও আরও ১৫/১৬ জন। আর কর্মচারী সংখ্যা ১৮। এর মধ্যে গত ১০ বছরেই নিয়োগ পেয়েছেন ১১ শিক্ষক ও ৬ কর্মচারী। জানা গেছে, অধ্যক্ষ মরিয়াম ছিদ্দীকার পাঠানো প্রস্তাবে ১৯ সেপ্টেম্বর খুবির’র প্রফেসর ড. মো: শাহজাহান কবিরকে সভাপতি করে প্রথম অ্যাডহক কমিটি অনুমোদন দেয় জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়। মাত্র চার দিনের মাথায় কমিটি পরিবর্তন করে রেহানা আক্তার ঈসাকে সভাপতি করে আর একটি কমিটি আসে। রেহানা ঈসা খুলনা মহানগর বিএনপির অন্যতম যুগ্ম আহবায়ক। ৯ অক্টোবর আবার এক চিঠিতে রেহানা ঈসার কমিটি বাতিল করে শাহাজাহান কবিরের কমিটি বহাল রাখার কথা জানায়। ১০ দিন পরে ২০ অক্টোবর অপর এক চিঠিতে শাহাজাহান কবিরের কমিটি বাতিল করে রেহানা আক্তারের অনুমোদন বহাল থাকবে বলে জানানো হয়। এরপর ২৭ অক্টোবর অপর চিঠিতে এই কমিটিও স্থগিত করার কথা জানান জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শক (ভারপ্রাপ্ত) মো: আব্দুল হাই সিদ্দিকী সরকার। এরপর কলেজে বিভাগীয় কমিশনারের প্রতিনিধি হিসেবে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (শিক্ষা ও আইসিটি) সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এদিকে অ্যাডহক কমিটি গঠন নিয়ে টানাহেচড়া চলাকালে ১০ নভেম্বর দুপুরে একদল বহিরাগত যুবক ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে ত্রাস সৃষ্টি করে। বহিরাগতরা কলেজের সিসি ক্যামেরা ভাংচুর ও ডিভাইস খুলে নেয়, অধ্যক্ষের কক্ষে প্রবেশ করে আলমারি ভাঙ্গার চেষ্টা করে, তার নেম প্লেট খুলে নেয় এবং রুমের দরজায় তালা মেরে দেয়। চলে যাওয়ার আগে চাবি ও ডিভাইস কলেজের সিনিয়র শিক্ষক মোস্তফা মাহমুদের কাছে দিয়ে যায়। এ সময় অধ্যক্ষ অফিশিয়াল কাজে অ্যাডহক কমিটির তৎকালীন সভাপতি ও অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারের দফতরে ছিলেন। মরিয়ম ছিদ্দীকা অভিযোগ করেন, আড়াই মাস নিজের রুম ছেড়ে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ কক্ষে বসে অফিস করছি। সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র আটকে আছে রুমে। থানায় জিডি করেছি, প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের দুয়ারে দুয়ারে ধর্ণা দিয়েছি। সবাই বলেছে এটা অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। নিজেরা ঝামেলা মিটিয়ে নেন। মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক চৌধুরী মিরাজ কলেজে হামলায় নেতৃত্বে ছিলেন। সাবেক সভাপতি এম ডি এ বাবুল রানা রাজনৈতিক মতাদর্শে যাই থাকুক, উনি কলেজের উন্নয়নে অনেক ফান্ড নিয়ে এসেছেন। যতো বিল্ডিং দেখছেন সব তিনি বরাদ্দ এনেছেন। শিক্ষক কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে তার সুপারিশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিলনা বলে জানান অধ্যক্ষ। যোগাযোগ করা হলে রেহানা ঈসা বলেন, শিক্ষাবীদ, শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবী হিসেবে এই শহরের মানুষের কাছে আমি পরিচিত। প্রতিষ্ঠানের কল্যাণের জন্য আমি সভাপতি হতে চেয়েছি। এরসাথে রাজনীতি সম্পৃক্ত নয়। দুর্নীতিগ্রস্ত আওয়ামী লীগ নেতা বাবুল রানার সাথে যোগসাজসে অনেক অনিয়ম ও লুটপাট কলেজে হয়েছে। অনিয়মের প্রতিবাদ করে অনেক শিক্ষক হয়রানি ও শাস্তির সম্মুখীন হয়েছেন। কলেজে লেখাপড়া বলে কিছু হয়নি, নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে লুটপাটের মহোৎসব হয়েছে। আমি সভাপতি হলে অডিটে সবকিছু ধরা পড়ে যাবে। সেই ভয়ে প্রিন্সিপাল আমার বিরোধিতা করছে। নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত সভাপতি শাহজাহান কবির বলেন, আমি বিশ^বিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত আছি। ব্যস্ততা কমলে কলেজে যাবো। সেখানে অনেক সমস্যা আছে, শিক্ষার্থী কম, শিক্ষকদের মধ্যে সম্পর্কের ঘাটতি। কিভাবে ঘুরে দাঁড়ানো যায়, সেই চেষ্টা থাকবে।
মেট্রোপলিটন কলেজ : নগরীর সোনাডাঙ্গা থানার সবুজবাগে অবস্থিত কলেজটির প্রিন্সিপাল দিবাকর বাওয়ালীর বিরুদ্ধে ঘুষের টাকা ফেরৎ চেয়ে আদালতে মামলা করেছেন মো: রায়হান সরদার। উচ্চমান সহকারী পদে চাকরি দেওয়া হবে বলে তার কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা নিয়েছিলেন দিবাকর। শিক্ষক বা কর্মচারী পদে নিয়োগ দেওয়া হবে বলে টাকা নিয়েছিলেন, কিন্ত চাকরি দেননি। অথবা ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে কাজে নিযুক্ত করা হলেও কোনদিন এক টাকা বেতন মেলেনি। কিংবা চাকরি, যোগদান, বেতন কিছুই মেলেনি- এমন অন্তত ৩০ টি অভিযোগ জমা পড়েছে অ্যাডহক কমিটির কাছে। অথচ যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনিই লাপাত্তা পাঁচ মাস।
চিকিৎসার জন্য ভারতে যাচ্ছেন বলে ছুটি নিয়েছিলেন। এরপর ই-মেইলে ছুটি বাড়ানোর আবেদন করেই চলেছেন। ওদিকে অনুপস্থিত থেকেও তার ইশারায় চলছে কলেজের সার্বিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চক্রান্ত। কমিটির কার্যক্রম স্থগিত করতে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। তার অনৈতিক কর্মকান্ডের বিরোধীতাকারী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে পাঠাচ্ছেন উকিল নোটিশ। আবার তাদের হোয়াটসঅ্যাপে করুণ পরিণতি ভোগ করার হুমকি দিয়ে ক্ষুদে বার্তাও দিচ্ছেন। বলেছেন, আমি কলেজটা প্রতিষ্ঠা করেছিলাম বলে চাকরি করে খেতে পারছিস। যা করছিস তার ফলাফল ভালো হবেনা।
কলেজের সিনিয়র শিক্ষক এ এইচ এম মাহবুবুর রহমান জানান, পট পরিবর্তনের পর ১৩ আগস্ট পর্যন্ত হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর আছে প্রিন্সিপালের। এরপর চিকিৎসার নামে ছুটি নিয়ে চলে যান ভারতে। কলেজ প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছিলেন। তারপর এটিকে তার পৈত্রিক সম্পত্তি বানিয়ে ইচ্ছামতো লুটপাট করেছেন। বিশেষ করে নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন বেসুমার। প্রিন্সিপালের অফিস নিয়োগ ও তদবির বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। সাধারণ স্টাফ দূরের কথা, সিনিয়র শিক্ষকরাও সেখানে প্রবেশের অনুমতি পেতেন না। হাতেগোনা ৩/৪ জনকে নিয়ে দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত থাকতেন। তবে শেষ এক বছর কলেজেও অনিয়মিত হয়ে পড়েছিলেন। এতো মানুষের কাছ থেকে চাকরি দেওয়ার নামে টাকা নিয়েছিলেন। তাদের হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতেন।
কলেজ অ্যাডহক কমিটির সভাপতি মো: মাসুদ পারভেজ বাবু বলেন, দিবাকর বাওয়ালী দায়িত্ব পালনকালে অভ্যন্তরীণ আয়ের কোন হিসাবই দেননি। উপবৃত্তি থেকে প্রাপ্ত টিউশন ফি, কারিগরি বোর্ড থেকে প্রাপ্ত টাকা, এইচএসসির কেন্দ্র ফিসের টাকা, কলেজে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন পরীক্ষার কেন্দ্র ফিসের টাকা সব ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। আয়ের সব টাকা জমা হতো তার নিজস্ব ফান্ডে। নিয়োগ বাণিজ্য, প্রতারণা, অনুমোদন ছাড়া বিদেশ গমন, কলেজে অনুপস্থিতি সহ নানা অনিয়মের কারণে তাকে দুই বার শোকজ করা হয়েছে। অজ্ঞাত অবস্থানে থেকেও তিনি কলেজকে অস্থিতিশীল করার ছক আটছেন।
লায়ন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ : শেখ মুজিবের বিশাল ম্যুরালবানানো হয়েছিলপ্রধান ফটকের সামনে প্রথম ভবনের গায়ে। নগরীর অন্যতম প্রবেশদ্বার গল্লামারির সন্নিকটেফোরলেনের শেরে বাংলা রোড ধরে আসতে যেতে যে কারো নজরে পড়তে বাধ্য। ৫ আগস্ট হাসিনার পতন ঘটলেও লায়ন্স স্কুল থেকে মুজিবের মূর্তি অপসারণ হয়েছে ১৪ ডিসেম্বরের পরে। মূলত এই স্কুলটি ছিল আওয়ামী লীগের সেকেন্ড হোম, নিরাপদ শেল্টার হোম আর দুর্নীতি লুটপাটের কেন্দ্রস্থল। যার সর্বময় কর্তৃত্ব ছিল স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও দাপুটে আওয়ামী ক্যাডার আলী আকবর টিপুর হাতে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চূড়ান্ত মুহুর্তে দাঁড়িয়েও এই স্কুলের অভ্যন্তরে লীগের ক্যাডাররা সশস্ত্র অবস্থান নিয়ে ছাত্রদের মিছিল সমাবেশে হামলার নীলনকশা একেছিলেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ।
আর সার্বক্ষণিকভাবে টিপুর একান্ত সহযোগী হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন কলেজের প্রিন্সিপাল মো: বাদশাহ খান। এগুলো কেবলমাত্র মৌখিক অভিযোগ নয়। খুলনা জেলা প্রশাসনের তদন্তে তার বিরুদ্ধে আনীত ১১ টি অভিযোগের মধ্যে ৮টিই প্রমাণিত হয়েছে। স্কুল ও কলেজের ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করে ক্যাম্পাস ত্যাগ করা এই কট্টরবাদী আওয়ামী শিক্ষক এখন সম্পূর্ণ ভোল পাল্টে বিএনপি সেজেছেন। আর নগর বিএনপির দুই নেতার কাঁধে ভর করে পুনর্বাসিত হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
কলেজের সিনিয়র শিক্ষক মো: মনিরুজ্জামান জানান, অসদাচারণ, দূর্ব্যবহার, আর্থিক অনিয়ম ও লুটপাট, দুর্নীতিতে সহায়তা, অতি আওয়ামী আচরণের কারণে ছাত্র ছাত্রী ও অভিভাবকরা আগে থেকেই তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিল। ৫ আগস্ট পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি আলী আকবর টিপুর মতো বাদশাহ খানও আত্মগোপনে চলে যান। কিন্ত কিছুদিনের মধ্যে ফিরে আসার চেষ্টা করলে শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে মিছিল ও সড়ক অবরোধ করে। এরপর স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক স্কুল অ্যাডহক কমিটির সভাপতি হন। বাদশাহ খান পুনরায় স্কুলে প্রবেশের চেষ্টা করলে পরিস্থিতি আবারও চরম উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সে সময় সব পক্ষের প্রতিনিধি নিয়ে বৈঠক হয়। সেখানে ছাত্র সমন্বয়করা প্রিন্সিপালের অনিয়ম দুর্নীতি তদন্তের স্বার্থে দলিলপত্রাদি যাতে গায়েব করে দিতে না পারে সেজন্য প্রিন্সিপাল ও প্রধান অফিস সহকারীর রুম তালাবদ্ধ রাখার সিদ্ধান্ত দেন। নিরাপত্তার স্বার্থে নৌবাহিনীর প্রহরায় বাদশাহ খানকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়। এরই মধ্যে খুলনা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার ইমরান হাসান প্রিন্সিপালের দুর্নীতি ও অসাদাচারণের বিরুদ্ধে দাখিলকৃত অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে ১৭ অক্টোবর প্রতিবেদন দাখিল করেন। যেখানে ভর্তি ফি, প্রশংসাপত্র প্রদান, দাতা সদস্যের অনুদান জমা না দেওয়া, হলরুম ও মাঠ ভাড়া থেকে আয় তছরুপ সহ ৮টি অভিযোগের প্রমাণ পায়। ৮ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১১টার দিকে মটর সাইকেলের এক বহর নিয়ে কলেজে প্রবেশ করেন প্রিন্সিপাল। বহিরাগত ৩০/৪০ জন যুবক ক্যাম্পাসে ত্রাসের সৃষ্টি করে। এ সময় স্কুল শাখায় বার্ষিক পরীক্ষা চলছিল। শিক্ষার্থীরা আতংকিত হয়ে পড়ে। তারা প্রিন্সিপালের রুমের তালা ভেঙ্গে বাদশাহ খানকে চেয়ারে বসিয়ে দেয় এবং তার নির্দেশ অমান্য করা হলে পরিণতি খারাপ হবে বলে ভয়ভীতি দেখায়। যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল থেকে মহানগর বিএনপির আহবায়ক কমিটির যুগ্ম আহবায়ক পদ পাওয়া দুই নেতা এদের নেতৃত্বে ছিলেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে মো: বাদশাহ খান বলেন, কলেজ শাখার নন এমপিও কিছু শিক্ষক বানোয়াট ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে পরিস্থিতি নষ্ট করছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় আমাকে নিয়মিত দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছে বলেই আমি কলেজে যাচ্ছি। আমার বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছে ও রিপোর্ট দাখিল হয়েছে এমন কিছু জানা নেই। পলাতক সভাপতি আলী আকবর টিপুর পক্ষ নিয়ে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে তিনি বাইরে থেকে অনেক অনুদান এনেছেন। ম্যুরাল, টেরাকোটা ও বাগান করতে ৯ লাখ ৯ হাজার টাকা এনেছেন। তার আয়ের অনেক খাত আছে। এই কলেজের টাকা মেরে খাওয়া লাগেনা। প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠেছে সেবাধর্মী সংস্থা লায়ন্স ইন্টারন্যাশনালের জমিতে তাদের অনুদানে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে লায়ন্স ক্লাব কর্তৃপক্ষ প্রথমে বর্তমান সভাপতি ডা. আর কে নাথকে কলেজের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি ঘোষণা করেন। কিন্ত তিনি এই দায়িত্ব নিতে অপরাগতা প্রকাশ করলে সাবেক সভাপতি অ্যাডভাকেট কুদরতে খুদাকে মনোনীত করেন। তবে তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আগেই নতুন প্রজ্ঞাপনে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ওপর অ্যাডহক কমিটির দায়িত্ব বর্তায়। কুদরতে খুদা বলেন, ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানটিকে লুটপাট করে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। আমি দায়িত্ব নিলে সব দুর্নীতি অনিয়মের গোমর ফাঁস হয়ে যাবে। এজন্য আমার নিয়োগের বিরোধিতা করছেন প্রিন্সিপাল। এদিকে মহানগরীর বাইরে কয়রা উপজেলার খান সাহেব কোমর উদ্দিন কলেজ, দাকোপের চালনা কলেজ সহ একাধিক বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে ব্যাপক অভিযোগ মিলছে তথ্য অনুসন্ধানে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *