শিশুশ্রম নিয়ন্ত্রণের ২৮৪ কোটি টাকার ‘পণ্ডশ্রম’ প্রকল্প

বিশেষ প্রতিনিধি: হতে হবে দরিদ্র পরিবারের সন্তান, থাকতে হবে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত, আর বয়স সর্বোচ্চ ১৭– শিশুশ্রম নিরসনে তালিকা করার সময় এসব শর্তের ধার ধারেননি প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা। এ সুযোগে দরিদ্র শিশুদের জন্য সরকারের নেওয়া প্রকল্পের উপবৃত্তির টাকা নিয়ে গেছে সচ্ছল পরিবারের শিশুদের পরিবার। ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত না থাকলেও প্রকল্পের আওতায় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে অংশ নিয়ে প্রতি মাসে গুনে নিয়েছে এক হাজার টাকা। ১০ মাসের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ শেষে এককালীন জনপ্রতি ১৩ হাজার টাকার প্রণোদনা নিয়েও হয়েছে নয়ছয়। সরকারি কর্মকর্তাদের আশকারায় বেশির ভাগ এনজিও প্রকল্পের এ টাকা লোপাট করে।

এমন অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে ‘বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন (চতুর্থ পর্যায়)’ প্রকল্পে। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং আঞ্চলিক বিভিন্ন কার্যালয়ের আলাদা পরিদর্শন প্রতিবেদনে বিস্তর অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে।

যাদের জন্য এ আয়োজন, সেই ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত দরিদ্র শিশুদের কপালে জোটেনি প্রকল্পের উপবৃত্তি। এতে প্রকল্পের টাকা গচ্চার পাশাপাশি হয়েছে সময়ের অপচয়, ৪২ পেশায় নিয়োজিত শিশুদের ঝুঁকিমুক্তও করা যায়নি। এত অনিয়মের পরও শিশুশ্রম নিরসন ও পুনর্বাসন প্রকল্পের নামে আড়াই হাজার কোটি টাকার নতুন আরেকটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। গত জুনে ওই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজও শেষ হয়েছে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংশ্লিষ্ট কনভেনশন ১৩৮ এবং জাতিসংঘের শিশু অধিকার-সংক্রান্ত কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করেছে সরকার। এই কনভেনশনে শিশুকে সব ধরনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত রাখার কথা বলা হয়। এ প্রতিশ্রুতি রক্ষায় ২০২৫ সালের মধ্যে দেশ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনের অঙ্গীকার রয়েছে সরকারের। এর অংশ হিসেবেই ২০১৮ সালে প্রকল্পটি হাতে নেয় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। খরচ ধরা হয় ২৮৪ কোটি টাকা। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, বরিশাল, সিলেট, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনসহ আরও কয়েকটি এলাকায় প্রকল্পটি চলছে। প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল গত ডিসেম্বরে, পরে তা জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। দেশের ১১২টি এনজিওর মাধ্যমে এ কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত জরিপ প্রতিবেদন বলছে, দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ৩০ লাখ ৫৪ হাজার। তাদের ১০ লাখ ৭ হাজারই ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত। আর ঝুঁকিপূর্ণ ৪৩ খাতের মধ্যে মাত্র ৫টিতে কাজ করছে ৩৮ হাজার ৮টি শিশু।

প্রতিবেদনে উঠে এসেছে নানা অনিয়ম
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৭, ৩৮, ৪৭, ৪৮ ও ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের বেশ কয়েকটি কেন্দ্র পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব কেন্দ্রে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত শিশু হিসেবে ৮৯৩ জনকে প্রকল্পের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে তাদের অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ কোনো কাজের সঙ্গে জড়িত না। অনেকে আবার কেন্দ্রের শিক্ষার্থী না হলে ধরে এনে উপস্থিত দেখানো হয়েছে। কোনো কোনো শিশুর বয়স প্রকল্পের নির্ধারিত বয়সসীমার সঙ্গে মিল নেই। অনেক শিশুর পরিবার উপবৃত্তির টাকাও পায়নি। পটুয়াখালী মহিলা উন্নয়ন সমিতি (পিএমইউএস) নামে একটি এনজিও ওই পাঁচ ওয়ার্ডে ৩৬টি কেন্দ্র পরিচালনা করে।

শ্রম মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এলাকা জরিপের মাধ্যমে সুবিধাভোগী শিশু নির্বাচন, উপবৃত্তির টাকা পরিশোধসহ কিছু অনিয়ম নিয়ে শুরু থেকেই আলোচনা ছিল। পরে স্টিয়ারিং কমিটির (পিএসসি) সভায় প্রকল্পের কার্যক্রম নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। সভায় বলা হয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার বিভিন্ন শিক্ষাকেন্দ্রের তালিকাভুক্ত এক হাজার শিশুশ্রমিকের মধ্যে ৩৬৬ জনের তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা যায়, মাত্র ২৫ জন এ প্রশিক্ষণ পাওয়ার যোগ্য।

বাকিরা কেউ ঝুঁকিপূর্ণ কিংবা ঝুঁকিহীন কোনো ধরনের কর্মে নিয়োজিত নেই। এদের অনেকেই সচ্ছল পরিবারের বিদ্যালয়গামী শিশু। এ পরিস্থিতিতে ডিআইএফইকে নিবিড় পরিদর্শনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সারাদেশের বিভিন্ন কেন্দ্র পরিদর্শনে এসব অনিয়ম পাওয়া যায়।

জরিপের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন শ্রমে নিয়োজিত ১০ থেকে ১৬ বছর বয়সী এক লাখ শিশুকে নির্বাচিত করা হয়। ৯টি বিষয়ের ওপর ছয় মাসের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ও চার মাসের দক্ষতা উন্নয়নের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এসব শিশুকে। এ সময় প্রত্যেক শিশুকে মাসে এক হাজার টাকা করে বৃত্তি দেওয়ার কথা। প্রশিক্ষণ পাওয়া সেরা ১০ হাজার শিশুকে ক্ষুদ্র উদ্যোগের পুঁজি হিসেবে এককালীন ১৩ হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা। এ টাকা কেউ পেয়েছে, কেউ পায়নি।

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে এক পরিদর্শক বলেন, মন্ত্রণালয় এবং এনজিও মিলে প্রকল্পের টাকা লোপাট করেছে। যেসব নম্বরে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা দেওয়া হয়, সেগুলো সংশ্লিষ্ট এনজিওর হাতে রয়েছে। এ কারণে উপবৃত্তির টাকা ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের পরিবারের হাতে পৌঁছেনি। তাঁর মতে, চতুর্থ প্রকল্পের মতো ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়েও প্রায় একই রকম অনিয়মের ঘটনা ঘটেছিল।

উপবৃত্তির টাকা পায়নি শিশুরা
রাজধানীর মুগদায় ৩৬টি কেন্দ্র পরিচালনা করে গণউন্নয়ন সংস্থা। এর মধ্যে নমুনা হিসেবে ৫ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর মুগদা শীতলক্ষ্যা কেন্দ্র এবং ৬ নম্বর ওয়ার্ডের যমুনা নামে দুটি কেন্দ্র পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালের জানুয়ারির পর আর কোনো মাসের উপবৃত্তির টাকা পায়নি কোনো শিশু। একই অভিযোগ জামালপুরের ইসলামপুরের দুটি কেন্দ্র পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়। অ্যাকশন ফাইভ নামে একটি এনজিও ওই এলাকায় ৩৬টি কেন্দ্র পরিচালনা করছে। রাজধানীর ধানমন্ডিতে সুরভী নামে একটি এনজিও পরিচালিত চারটি কেন্দ্র পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, এনজিওটির দেওয়া তথ্যের সঙ্গে উপস্থিত শিশুদের কাজের মিল নেই। একটি কেন্দ্রের ১১ শিশুর পেশা হিসেবে তাঁত শ্রমিক হিসেবে কাজ করে বলা হয় সুরভীর তরফ থেকে। অথচ ওই এলাকায় কোনো তাঁতশিল্প নেই বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

খুলনা অঞ্চলের পরিদর্শনে আরও ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে। খুলনা সিটি করপোরেশন এলাকায় কমিউনিটি ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন নামে একটি এনজিও পরিচালিত ১৯ নম্বর শিক্ষা কেন্দ্রে মাত্র তিন শিশুকে উপস্থিত পাওয়া গেছে। কেন্দ্রের শিক্ষক ফারজানা আক্তার পরিদর্শকদের জানিয়েছেন, ছয় মাস ধরে উপবৃত্তির টাকা পাচ্ছে না শিশুরা। ওই এলাকায় এ রকম ১ হাজার ৪৪১ শিশু কোনো টাকা পায়নি।

যা বলছেন প্রকল্প পরিচালক
গত ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মনোয়ার হোসেন। এর পর থেকে তিনি বেসরকারি বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে বদলি হন। তাঁর দায়িত্ব পালনের সময়েই অনিয়মের ঘটনা ঘটেছিল। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছি, প্রকল্পে কোনো অনিয়ম হয়নি। আমার জ্ঞানত কোনো অনিয়ম হয়নি প্রকল্পে।’ তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের নির্বাচিত এনজিওর মাধ্যমেই কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পেয়ে থাকে সুবিধাভোগী শিশুদের পরিবার। তবে দু-একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে থাকলে সেটা আমলে নেওয়ার মতো উল্লেখযোগ্য নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *