খুলনায় ১১০ ওভারহোলিং নিয়ে তামাশা চলছে
বি. এম. রাকিব হাসান, খুলনা : খুলনা বিদ্যুৎকেন্দ্র। শিল্প ও বন্দর নগরী খুলনার ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। নগরীর শিল্পাঞ্চল খালিশপুরে এর অবস্থান। গোয়ালপাড়া পাওয়ার হাউজ হিসেবেই এর পরিচিতি।
৫৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ভাসমান বার্জ মাউন্টেড, টিজি-১৪, জিটি-৩৫ এবং ডিজেল চালিত ১৬ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রির পর এখন এখানকার ১১০ ও ৬০ মেগাওয়াট কেন্দ্র দু’টিই কালের সাক্ষী। কিন্তু এ কেন্দ্র দু’টিও ওভারহোলিং না করে ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংসের চক্রান্ত চলছে। ১১০ ওভারহোলিং নিয়ে চলছে তামাশা। ৩১ বছরে মাত্র ৪ বার ১১০ এবং ৫ বার ৬০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি ওভারহোলিং হয়। অথচ পার্শ্ববর্তী নর্থ ওয়েষ্টার্ণের দেড়শ’ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্লান্টটি দু’বছরের মাথায় নতুন করে ওভারহোলিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ আমলাতান্ত্রিক পরিকল্পনার অভাবে সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করা হলেও সরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্ম অভিজ্ঞতা নিয়েই বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো করছেন অনেক কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সূত্র জানায়, ১৯৮৪ সালে ১১ কোটি ২০ হাজার ইউএস ডলার ব্যয়ে স্কোডা এক্সপোর্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠান ১১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে। নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ম্যানুয়াল অনুযায়ী ২৫ থেকে ২৭ হাজার ঘন্টা চালানোর পর ওভারহোলিং করার পরমর্শ থাকলেও শুরু থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এক লাখ ৩১ হাজার ৮১০ ঘন্টা চলে এ কেন্দ্রটি। এরপর প্রথম দফায় ১৯৮৯ সালের ২২ জুন থেকে ১৯৯১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ওভারহোলিং হয়। এরপর ১৯৯৫ সালে মিনি ওভারহোলিং, ১৯৯৮ সালে আংশিক পুনর্বাসন এবং ২০০০ সাল থেকে ২০০২ পর্যন্ত দ্বিতীয় ওভারহোলিং হলেও গত বছর ৬ নভেম্বর থেকে কেন্দ্রটি একেবারেই বন্ধ রয়েছে। সর্বশেষ ওভারহোলিংয়ের পর এ কেন্দ্রটি চলে ৫৪ হাজার ২১ ঘন্টা।
অপরদিকে, ১৯৭৩ সালের ২৫ মে স্থাপিত ৬০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠানও স্কোডা এক্সপোর্ট। এটি নির্মাণে ব্যয় হয় ৭ কোটি ইউএস ডলার। এটিও ২৫ থেকে ২৭ হাজার ঘন্টা চলার পর ওভারহোলিংয়ের কথা থাকলেও এক লাখ ৩০ হাজার ৮৫৩ ঘন্টা পর ১৯৭৭ সালে প্রথম দফায় ওভারহোলিং হয়। ১৯৮১ সালে দ্বিতীয় দফায়, ১৯৯৭ সালে পুনর্বাসন, ২০০৫ থেকে ২০০৬ এবং ২০০৭ থেকে ২০১০ সালে দু’দফায় টারবাইন ওভারহোলিং হয়। সর্বশেষ পুনর্বাসনের পর এ কেন্দ্রটি ৩৪ হাজার দু’ঘন্টা চলে বলে খুলনা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সূত্রটি জানায়। ২০১২ সালের ১৭ মে থেকে কেন্দ্রটি বন্ধ রয়েছে। ২০১০ সালের ৩০ মে এ কেন্দ্রে আগুন লাগার পর বিদেশী সহায়তায় এর সংস্কার করতে ২ কোটি টাকা দাবি করা হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় কারিগর দিয়েই এটি সংস্কার হয়।
এদিকে, খুলনা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফার্নেস অয়েল নির্ভর এ দু’টি কেন্দ্র ওভারহোলিং করে পুন:চালুর দাবি প্রতিনিয়তই উপেক্ষিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওভারহোলিংবিহীন দীর্ঘ সময় চলার কারণে কেন্দ্রের বয়লারের ইকোনোমাইজার টিউব, সুপারহিটার টিউব ও রি-হিটার টিউবের পুরুত্ব কমে যাওয়ায় ১১০ এর উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। আর টারবাইনের উচ্চমাত্রার ভাইব্রেশনের কারণে ২০১২ সালের ১৭ মে থেকে বন্ধ রয়েছে ৬০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি। ৪০ বছরের পুরাতনের ধূয়া তুলে এ কেন্দ্রটি অবসর দেয়ার চক্রান্ত চলছে।
যদিও ২০১১ সালে ১১০ ও ৬০ মেগাওয়াট কেন্দ্র দু’টি পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ বিদ্যুৎউন্নয়ন বোর্ড। এজন্য ৭ সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যবৃন্দ ওই বছরই খুবিকে পরিদর্শন করে ১৫ পৃষ্ঠাব্যাপী বিস্তারিত প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে ৬০ মেগাওয়াট ইউনিটের পুনর্বাসনের জন্য ১৪৩ কোটি, ১১০ মেগাওয়াট ইউনিটের জন্য ১৭৮ কোটি এবং ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টের জন্য ৬৫ কোটি অর্থাৎ সর্বমোট ৩৮৬ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এর পরই গত বছর ৬০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি ওভারহোলিংয়ের পরিবর্তে চিরতরে বন্ধের নোট দেয়া হয় খুবিকের পক্ষ থেকে।
পক্ষান্তরে ১১০ কেন্দ্রটি ওভারহোলিংয়ের জন্য টেন্ডার আহবান করা হলে পিডিবির কালো তালিকাভুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতা নির্বাচিত হয়। কালো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান বলে এ বছরের গোড়ার দিকে বিউবো’র বোর্ড মিটিংয়ে ওই টেন্ডার বাতিল করে পুন:টেন্ডার আহবানের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সম্প্রতি বোর্ড মিটিংয়ে পুন:টেন্ডারের সিদ্ধান্ত বাতিল করে ১১০ কেন্দ্রটি ওভারহোলিং প্রক্রিয়া নাকচ করে দেয়া হয়।
এদিকে, খুলনা বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে এমন নাটকীয়তার প্রতিবাদে ফুঁসে উঠছে খুবিকে’র শ্রমিক সমাজ। ক্ষমতাসীন দলের শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্বে শ্রমিকরা নেমেছে আন্দোলনে। জাতীয় বিদ্যুৎ শ্রমিক লীগের(বি-১৯০২) পক্ষ থেকে গতকাল থেকে শুরু হয়েছে পক্ষকালব্যাপী কর্মসূচী।
গতকালকের বিক্ষোভ কর্মসূচীতে সংগঠনের সভাপতি শেখ আসলাম উদ্দিনের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও শাখা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুন্সী শহীদুজ্জামান। বক্তৃতা করেন, হাফিজুর রহমান কাজল, মোস্তাক হাকিম, দুর্গাপদ বিশ্বাস, শামসুদ্দিন কচি, আঃ সালাম (পি.ও), সমীর কুমার সরকার, রিয়াজুল করিম, শফিকুল ইসলাম, সাইদুল হাসান, সৈয়দ বুলবুল কবির বুলু, মনিরুজ্জামান মিয়া, খন্দকার নাজমুল আলম, বাশার শেখ, কাজী শাহাদাৎ হোসেন, খন্দকার মনিরুজ্জামান, আক্তার হোসেন পিন্টু প্রমুখ।
এছাড়া একই সংগঠনের অপর গ্রুপের এক সভায় বোর্ডের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানানো হয়। শাখা কমিটির সভাপতি বশির আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তৃতা করেন, বোরহান উদ্দিন মিয়া, মঞ্জুর-উল-হক, ইকবাল হোসেন, আমির হোসেন তোতা, ফারুক আহমেদ, নাসিম প্রমুখ।
অবশ্য খুলনা বিদ্যুৎকেন্দ্রের এমন করুণ দশার মধ্যেই এ কেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী জয়দেব কুমার সাহা বর্তমানে চীন সফরে রয়েছেন। কিছুদিন পরই ওই কর্মকর্তা অবসরে গেলেও তাকে চীনে পাঠানো হয়েছে প্রশিক্ষণে। খুলনা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের পাশাপাশি যে কর্মকর্তা শীঘ্রই অবসরে যাচ্ছেন তাকে কি জন্য ট্রেনিংয়ে বিদেশে পাঠানো হয়েছে এর সঠিক কোন জবাব নেই কর্তৃপক্ষের কাছে। তবে আন্দোলনরত শ্রমিকরা এ নিয়ে মুখ না খুললেও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন বলেন, এক সময় কর্মচারী ও টেকনিশিয়ানদের ট্রেনিংয়ে পাঠানো হতো। কিছুদিন ধরে তা’ হচ্ছে না।