সাবধান! গণপরিবহনে চলাচলে জেনে নিন করণীয়

অপরাধ তথ্যচিত্র ডেক্স: ঈদের আগে থেকেই টুকটাক করে রাস্তাঘাটে মানুষের চলাচল বাড়তে শুরু করে। ঈদে কর্মস্থল ত্যাগ করে বাড়ি ফেরায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল সরকার। কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেকেই বিশেষত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরিজীবী ও স্বাধীন পেশায় কর্মরত মানুষ ট্রেন, বাস কিংবা লঞ্চ না পেয়ে বিকল্প পরিবহনে বাড়তি পয়সা খরচ করে স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করতে ঢাকা ছাড়ে। ঈদ শেষে তারাই আবার ফিরতি যাত্রায় ঢাকায় ফিরছে। এরইমধ্যে সীমিত আকারে বাস, ট্রেন, লঞ্চ ও বিমান চলাচলে অনুমোদন দিয়েছে সরকার।

কিন্তু ঈদ ঘিরে কিংবা ঈদ শেষে এই যাওয়া-আসা করোনা সংক্রমণ ঝুঁকিকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে বিশ্বের অনেক দেশে দুই ব্যক্তির মাঝে ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলা হলেও বাংলাদেশে সেটি তিন ফুট। কিন্তু সবশেষ গত কয়েকদিন বাস, ট্রেন কিংবা লঞ্চে করে যেভাবে ঢাকায় ফিরছে মানুষ তাতে করে ন্যূনতম দূরত্বও বজায় থাকছে না।

এ অবস্থায় আপনি যাত্রাপথে কিংবা গণপরিবহনে কিভাবে নিজেকে নিরাপদে রাখবেন, কী করেইবা চলার পথে করোনার সংক্রমণ ঝুঁকি এড়াবেন, এক্ষেত্রে আপনার করণীয় কী- এ নিয়ে বিবিসি বাংলা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। পাঠকের জন্য প্রতিবেদনটি হুবহু তুলে ধরা হলো:

সঠিকভাবে মাস্ক পরছেন তো?
সরকারের নির্দেশনা হচ্ছে- সবাইকে অবশ্যই মাস্ক পরে গণপরিবহনে উঠতে হবে। কিন্তু করোনা সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দিতে পারে- এমন মাস্ক পরা হচ্ছে কিনা আর সঠিকভাবে সেটি পরছেন কিনা তা অনেকেই খেয়াল করছেন না।

এ বিষয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন বলছেন, ‘বাসা থেকে মাস্ক পরে যখন বের হবেন আর বাসে বসে ইচ্ছামতো সেটা খুলবেন, বারবার গলায় ঝুলিয়ে রাখবেন, কথা বলবেন, আবার পরবেন সেটি কিন্তু ঠিক নয়। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকে। বাস থেকে নেমে অফিস বা বাসায় পৌঁছেই সবকিছুর আগে মাস্ক খুলে ফেলে দিতে হবে। খুলে রেখে দেয়া মাস্ক বারবার ব্যবহার করা যাবে না।’

মাস্ক পরার বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন হেলথ সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের এপিডেমিওলজি বিভাগের শিক্ষক মোসাম্মাৎ নাদিরা পারভিন।

তিনি বলছেন, ‘বাজারে যে মাস্কগুলো পাওয়া যায় তা করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষার জন্য যথেষ্ট নয়। মাস্ক পরে মুখের সামনে হাত দিয়ে জোরে ফু দিলে যদি বাতাস লাগে তাহলে সেটি নিরাপদ নয়। সেক্ষেত্রে আমরা নিজেরাই মাস্ক বানিয়ে নিতে পারি। নিজেরাই সুতি কাপড় দিয়ে তিন স্তর বিশিষ্ট মাস্ক তৈরি করে নিলে সেটা অনেক নিরাপদ হবে।’

যেভাবে ফেলবেন গ্লাভস
করোনা ভাইরাস থেকে সুরক্ষার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পন্থা হল হাত পরিষ্কার রাখা। মোসাম্মাৎ নাদিরা পারভিন বলছেন, গণপরিবহনে ওঠার সময় হ্যান্ডেল ধরতে হয়, অনেক সময় বাসের সিটের ওপর হাত দিতে হয়, টাকা ধরতে হয় যাতে করোনাভাইরাস থাকতে পারে। গণপরিবহনে বারবার হাতে স্যানিটাইজার দেয়া মুশকিল। তার চেয়ে হাতে গ্লাভস পরাই ভালো। এতে জীবাণু হাতে লাগার বদলে গ্লাভসে লাগবে। তবে ব্যবহার করা গ্লাভস কিভাবে ফেলবেন সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ।

নাদিরা পারভিন বলছেন, ‘এক জোড়া গ্লাভস একবারই ব্যবহার করতে হবে। অফিসে বা বাসায় ঢোকার আগেই সেটি ফেলে দিতে হবে। গ্লাভস খোলার সঠিক নিয়ম হচ্ছে উপরের দিক থেকে ধরে টান দিয়ে উল্টো করে খোলা এবং উল্টো করেই সেটি ফেলতে হবে।’

চলার পথে ব্যাগ বহন নয়
কর্মস্থলে বা অন্য কাজে যাওয়ার সময় অনেকেই সাথে ব্যাগ বহন করেন। অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন বলছেন, সেটি না করাই ভাল। কারণ ব্যাগ ধুয়ে পরিষ্কার করা মুশকিল। নারীরা অনেক সময় চামড়ার তৈরি হ্যান্ডব্যাগ ব্যবহার করেন। সেটি পরিষ্কার করা আরও সমস্যা। অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন পরামর্শ দিচ্ছেন যতটা সম্ভব কম জিনিসপত্র নিয়ে বের হওয়া যা পকেটে ঢোকানো যায়।

এক্ষেত্রে নারীদের সালোয়ারে চেইন যুক্ত পকেট তৈরি করে নেয়া উচিত বলে পরামর্শ তাহমিনা শিরিনের।

পুরো শরীর ঢাকা পোশাক পরুন
বাংলাদেশ গরমের দেশ। এখানে অনেকেই আরামের জন্য ছোট হাতার জামা পরেন। মোসাম্মাৎ নাদিরা পারভিন বলছেন, ‘চলাচলের সময় এমন পোশাক পরা উচিৎ যাতে শরীরের বেশিরভাগ অংশ ঢাকা থাকে। যেমন ফুলহাতার শার্ট বা কামিজ পরা, টি-শার্ট না পরা, জুতো-মোজা পরা উচিৎ।’

‘সাথে যদি মাস্ক, গ্লাভস ও চোখে চশমা থাকে তাহলে অনেক সুরক্ষা পাওয়া যাবে। বাড়ি গিয়ে পোশাক খুলে সরিয়ে রাখা বা ধুয়ে ফেলতে হবে’- বলেন তিনি।

তার পরামর্শ- যদি সামর্থ্য থাকে তবে ‘ফেস-শিল্ড’ ব্যবহার করা যেতে পারে। যা বারবার চোখ, মুখ, নাকে হাত দেয়া থেকে বিরত থাকতে সহায়তা করবে এবং অন্য কারো হাঁচি কাশি থেকেও রক্ষা করবে।

পথে কিছু খাওয়া থেকে বিরত থাকা
চলার পথে অনেকেই এটাসেটা খান। কিন্তু বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে হকারদের কাছ থেকে কেনা এসব খাবার খাওয়া যাবে না।

তাহমিনা শিরিন বলছেন, ‘এটি একেবারেই করা উচিৎ নয় কারণ হকাররা দিনভর রাস্তায় ও গাড়িতে বহু মানুষের সংস্পর্শে আসেন। এখন বাইরের খাবার একদমই খাওয়া উচিৎ না। কারণ খাবার যিনি প্রস্তুত করছেন, যিনি বিক্রি করছেন তাদের কার মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ রয়েছে, কার হাতে কী লেগে আছে তা কিন্তু আমরা জানি না। আর কিছু খেতে হলে মাস্ক খুলতে হবে। যা যাত্রাপথে একেবারেই ঠিক হবে না।’

থুথু ও কফ না ফেলা
আমাদের দেশে অনেকেই রাস্তাঘাটে যখন-তখন থুথু ও কফ ফেলেন। গণপরিবহনের জানালা দিয়েও কফ-থুতু ফেলেন। এতে করোনা ভাইরাস থাকতে পারে।

নাদিরা পারভিনের পরামর্শ- ‘গণপরিবহনে চলার সময় সঙ্গে টিস্যু রাখতে হবে। মুখে টিস্যু চেপে হাঁচি, কাশি ও কফ ফেলতে হবে। সেই টিস্যু যানবাহনের জানালা দিয়ে যেখানে যেখানে ফেলা যাবে না। গণপরিবহনে উঠার আগে সঙ্গে একটা পলিথিন নিন। ব্যবহৃত টিস্যু সেই পলিথিনে রেখে বাস থেকে গাড়ি থেকে নামার পর সঠিক জায়গায় সেটি ফেলুন।’

সবচেয়ে ভালো হয়, হাঁচি বা কাশির মতো করোনা ভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে গণপরিবহনে চলাচল না করা। এক্ষেত্রে বাড়িতে থাকাই উচিত।

জুতোর নিচেও মনোযোগ দিন
বাইরে চলাচলের সময় রাস্তায় কফ-থুথু ফেলা হলে সেটি আপনার জুতোর নিচে করে বাড়িতে কিংবা গাড়িতে পৌঁছে যায়। তাই জুতোর নিচের অংশ পরিষ্কার রাখার জন্য যানবাহনের গেটে ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে রাখা দরকার। এমনকি অফিসে কিংবা বাসায় প্রবেশের সময়ও এটি করা উচিত। সামর্থ্য থাকলে দোকানে কিনতে পাওয়া যায় এমন ‘ডিসইনফেকট্যান্ট স্প্রে’ দিয়ে জুতোর নিচে স্প্রে করা যেতে পারে বলেও পরামর্শ মোসাম্মাৎ নাদিরা পারভিনের।

দূরত্ব বজায় রাখুন
করোনা ভাইরাস থেকে নিরাপদে থাকতে বিশ্বের অনেক দেশে একে অপরের থেকে ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলা হচ্ছে। বাংলাদেশে সেটি ৩ ফুট। কিন্তু আমাদের এই যানজট-জনজটপূর্ণ দেশে সেটি মেনে চলা কঠিন। গত কয়েকদিন ধরে লঞ্চ, ট্রেন কিংবা বাস টার্মিনালে যাত্রীদের যে ভিড় দেখা যাচ্ছে তা রীতিমত ভীতিকর।

কিন্তু করোনা সংক্রমণ এড়াতে যত পদ্ধতির কথা বিশেষজ্ঞরা বলছেন তার মধ্যে অন্যতম পন্থা হচ্ছে মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা। সেজন্যই যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রাখা প্রয়োজন।

গণপরিবহনে চলার সময় আশপাশে কেউ হাঁচি-কাশি দিলে তার থেকেও দূরে থাকুন। সরকার গণপরিবহনে অর্ধেক যাত্রী পরিবহনের নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু কোনও যানবাহনে সেই নির্দেশনা নিশ্চিত না হয় তবে সেটিতে না উঠাই নিরাপদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *