মরণফাঁদ তামাক: বছরে প্রাণ যাচ্ছে ১ লক্ষ ৬১ হাজার মানুষের
আব্দুল মজিদ, নাটোর:
একটি সিগারেট জ্বলে ওঠে, নিভে যায় কয়েক মিনিটেই। কিন্তু তার রেখে যাওয়া ধোঁয়া থেকে যায় কারও ফুসফুসে, কারও ভবিষ্যতে। বাংলাদেশে এমনই নীরব ঘাতক হয়ে দাঁড়িয়েছে তামাকজাত দ্রব্য—প্রতিবছর কেবল এই একটি অভ্যাসের কারণে প্রাণ হারাচ্ছেন প্রায় ১ লক্ষ ৬১ হাজার মানুষ।
এই ভয়াবহ তথ্য উঠে আসে সম্প্রতি নাটোরে আয়োজিত একটি দিনব্যাপী সচেতনতামূলক কর্মশালায়।
‘বাংলাদেশে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাব ও উত্তরণের উপায়’—এই শিরোনামে কর্মশালাটি আয়োজন করে বাংলাদেশ ব্লাইন্ড মিশন।
স্থানীয় একটি চাইনিজ রেস্তোরাঁয় অনুষ্ঠিত কর্মশালার উদ্বোধন করেন নাটোর প্রেসক্লাবের সভাপতি এবং বাসস এর নাটোর প্রতিনিধি ফারাজী আহম্মদ রফিক বাবন।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ব্লাইন্ড মিশনের ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) খন্দকার আবেদুল ইসলাম। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠক তারেক মাহমুদ এবং অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ভলেন্টিয়ার নাসিরুজ্জামান হিরক।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ন্যাশনাল কনসালটেন্ট সুভাশিষ মহন্ত নান্টু, যিনি তার উপস্থাপনায় বলেন,
“তামাক একটি মরণফাঁদ। এটি শুধুমাত্র ব্যবহারকারীকেই নয়, তার পরিবার, সহকর্মী এবং সমাজকেও ক্ষতির মুখে ঠেলে দেয়।”
তিনি জানান, তামাকজাত দ্রব্যে রয়েছে নিকোটিন, আর্সেনিক, ডিডিটি, আলকাতরা, ফরমালিন ও বিটুমিনসহ ৪ হাজারেরও বেশি ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান, যার মধ্যে অন্তত ৪৩টি সরাসরি ক্যান্সার সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে।
সিগারেট না ছুঁয়েও মৃত্যুঝুঁকিতে!
এই কর্মশালায় বিশেষ গুরুত্ব পায় আরেকটি ভয়াবহ দিক—সেকেন্ড হ্যান্ড স্মোকিং।
সুভাশিষ মহন্ত নান্টু বলেন,
“বাংলাদেশে লাখ লাখ মানুষ নিজেরা কখনো তামাক স্পর্শ না করেও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন শুধু অন্যের ধোঁয়ার কারণে। বাড়ি, রাস্তাঘাট, দোকান, এমনকি কর্মস্থলে— যেখানে-সেখানে ধূমপানের ফলে অন্যরা প্রতিনিয়ত স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন।”
এই বক্তব্যে সাড়া দিয়ে অংশগ্রহণকারী সাংবাদিক আব্দুল মজিদ বলেন, “আমি কখনো সিগারেট খাইনি, তবু সহকর্মীর ধোঁয়া আমার শ্বাসনালীতে গিয়ে লাগছে প্রতিদিন। এটা আমার কী দোষ?”
এই প্রশ্ন শুধু তাঁর একার নয়—এটা আমাদের সবার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সেকেন্ড হ্যান্ড স্মোকিং-এর প্রভাবে শিশুরা নিউমোনিয়া ও অ্যাজমার মতো রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। গর্ভবতী নারীর ক্ষেত্রেও এই ধোঁয়া গর্ভের শিশুর বিকাশে মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
তামাকবিরোধী যুদ্ধে মিডিয়ার ভূমিকা
বক্তারা বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকারের আইন থাকলেও বাস্তবায়নে রয়েছে বড় ধরনের ঘাটতি। তামাক কোম্পানিগুলোর প্রভাব, বিজ্ঞাপন কৌশল ও নীতিনির্ধারকদের দ্বিধা এই লড়াইকে দুর্বল করে তুলছে।
তারা বলেন, “তামাকবিরোধী যুদ্ধ কেবল আইন দিয়ে সম্ভব নয়—এতে দরকার মিডিয়ার সক্রিয় অংশগ্রহণ, সামাজিক আন্দোলন, এবং নাগরিকের সোচ্চার কণ্ঠ।”
দিনব্যাপী এ কর্মশালায় নাটোর জেলার ২৫ জন সাংবাদিক অংশগ্রহণ করেন। তাঁরা তামাক নিয়ন্ত্রণে মিডিয়ার দায়িত্ব ও করণীয় বিষয়ে মতামত তুলে ধরেন।
সামনের পথ: সচেতনতা, প্রয়োগ ও প্রতিজ্ঞা
বাংলাদেশ ব্লাইন্ড মিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ভবিষ্যতেও দেশের বিভিন্ন জেলায় শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক ও এনজিওকর্মীদের নিয়ে এ ধরনের সচেতনতামূলক কর্মসূচি চলমান থাকবে।
শেষ পর্যন্ত তামাকের বিরুদ্ধে এই লড়াই ব্যক্তিগত নয়—এটা আমাদের জাতীয় স্বার্থের লড়াই।
প্রতিটি মানুষের প্রাণ, প্রতিটি শিশুর নিঃশ্বাস, প্রতিটি পরিবারের ভবিষ্যৎ এই লড়াইয়ের সঙ্গে জড়িত।
তামাকের ধোঁয়া যেন আর কোনো স্বপ্ন ঝাপসা না করে—এটাই হোক আমাদের শপথ।