ঢাকা শিশু হাসপাতালের আইসিইউ পুড়ে ছাই

ডেস্ক রিপোর্ট: প্রায় এক ঘণ্টার চেষ্টায় নিয়ন্ত্রণে আসে রাজধানীর শিশু হাসপাতালের আগুন। গতকাল দুপুর ১টা ৪৭ মিনিটে আগুন লাগার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে কাজ শুরু করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পাঁচটি ইউনিট। ২টা ৩৯ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এদিকে আগুন লাগার খবরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে হাসপাতালে রোগী ও স্বজনদের মধ্যে। আগুন থেকে বাঁচতে ছোটাছুটি শুরু করে সবাই। একপর্যায়ে যে যেভাবে পেরেছে সন্তানদের নিয়ে হাসপাতালের বাইরের ফ্লোরে অবস্থান নেয়। ফায়ার সার্ভিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মিডিয়া শাজাহান শিকদার জানান, খবর পেয়ে দ্রুত প্রথমে দুটি ও পরে আরও তিনটি ইউনিট হাসপাতালে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। প্রাথমিকভাবে আগুন লাগার কারণ জানা যায়নি। আগুন নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সদস্যরাও যোগ দেন। হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম জানান, শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের দায়িত্বরত চিকিৎসকের কক্ষের এসি থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বলে প্রাথমিক ধারণা। আগুনে রোগীদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। সবাইকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। সবাই সুস্থ আছে। রোগীদের আমরা যথাযথভাবে নামিয়ে এনেছি। তিনি বলেন, হাসপাতালের আইসিইউ ভবনে আগুন লাগার তথ্যটি ভুল। আগুন লেগেছে কার্ডিয়াক বিভাগে।
ওই বিভাগের আইসিইউতে থাকা ১৭ রোগীকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ ব্লকের রোগীদেরও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ আশপাশের হাসপাতালে রোগীদের শিফট করা হবে।
আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের পঞ্চম তলায় শিশু হৃদরোগ বিভাগে যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে বিভিন্ন জিনিসপত্র। ভিতরে গিয়ে দেখা যায় আইসিইউ রুমটি পুড়ে গেছে। বেড এবং অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জাম যেখানে সেখানে পড়ে আছে। এ রুমটিতে ১৭টি আইসিইউ বেড ছিল। আইসিইউর চিকিৎসক রুমে থাকা কম্পিউটার, প্রিন্টার, চেয়ার-টেবিলসহ সব আগুনে নষ্ট হয়ে গেছে। রুমের দেয়ালসহ সবকিছুতেই কালো ধোঁয়ার আস্তর পড়ে গেছে। সেই ফ্লোরে যেতেই বাতাসে ভেসে আসে পোড়া গন্ধ। আগুনে ওই ফ্লোরে থাকা সব আসবাবপত্র পুড়ে গেছে। পুড়ে গেছে বেড, দেয়াল, এসি, ফ্রিজসহ অক্সিজেন সামগ্রী। যেগুলোর কোনোটাই আর ব্যবহারোপযোগী নেই। একপর্যায়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও ভর্তি রোগী ও স্বজনদের মধ্যে উদ্বেগ আর আতঙ্ক বিরাজ করছিল। হাসপাতালটির বি ব্লকে আগুন লাগলেও তাড়াহুড়ো করে অন্যান্য ব্লক থেকেও রোগী ও স্বজনরা নিচে নেমে আসে। কার্ডিয়াক বিভাগে কর্তব্যরত এক নার্স বলেন, আগুনে পুড়ে যাওয়া প্রতি বেডেই রোগী ছিল। যখন দুর্ঘটনা ঘটে তখন আইসিইউতে মোট ১৭ জন রোগী ছিল। আগুন লাগার পর তাদের প্রত্যেককেই বিভিন্ন ওয়ার্ড ও অন্য আইসিইউগুলোয় স্থানান্তর করে দেওয়া হয়।

আইসিইউর পঞ্চম বেডে ভর্তি থাকা শিশু রিপামণির নানি লিনা বেগম বলেন, ‘তিন দিন আগেও এখানে আগুন লাগছিল। পরে আমরা বাচ্চাকে নিয়ে অন্যখানে চলে যাই। এরপর আমাদের ফোন করে ডেকে এনে রোগী ভর্তি করানো হয়। আমি সাড়ে ১২টায় এখানে আসি, আমার মেয়ে তার বাচ্চার চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে তাকে চিকিৎসা ও ইনজেকশন দিতে শ্যামলীতে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন আমি একাই নাতনির জন্য আইসিইউ রুমের সামনে ছিলাম। প্রায় দেড়টার দিকে বাইরে হঠাৎ দেখি বিদ্যুতের বাতি বন্ধ হয়ে যায়। পরে ভিতরে এক নার্স চিৎকার দিয়ে ওঠে। দৌড়ে ভিতরে গিয়ে দেখি রুম পুরো অন্ধকার এবং আমার নাতনির বেডের ওপর আগুন জ্বলছে। আমি দ্রুত গিয়ে হাতের নল টান দিয়ে খুলে ফেলি, এতে বাচ্চাটির হাত দিয়ে অনবরত রক্ত বের হতে থাকে। অন্য বাচ্চাদের স্বজনরাও ছোটাছুটি করে তাদের বাচ্চা নিয়ে চলে যায়। আমি আমার নাতনিকে নিয়ে দৌড়ে নিচে জরুরি বিভাগে আসি, তার শ্বাসকষ্ট শুরু হলে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে। ’

ভর্তি রোগীর অন্য স্বজনরা জানান, আগুন লাগার সময় অনেকেই জুমার নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন। হঠাৎ আগুন লাগার খবরে দৌড়ে হাসপাতালে এসে দেখেন দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে এবং চারদিক ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন বি ব্লক।

হাসপাতালের নিচে কথা হয় শফিউল্লাহ নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত দুই বছর বয়সী সন্তানকে নিয়ে স্ত্রীসহ এসেছেন। হাসপাতাল ভবনে যখন আগুন লাগে তখন তিনি জুমার নামাজ আদায় করে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ সময় আগুনের খবর শুনেই দ্রুত স্ত্রী-সন্তানের কাছে যান। পরে তাদের নিয়ে বাইরে চলে আসেন। নিজের কন্যাসন্তানকে ভর্তি করিয়ে আগুন লাগা ভবনের নিচতলায় ছিলেন বুলবুল ও তার স্ত্রী। তিনি বলেন, ‘নিচতলায় আগুন ছড়ায়নি। ধোঁয়া দেখতে পেয়ে আমরা বেরিয়ে আসি। আমাদের ওয়ার্ডে যারা ছিল সবাই বেরিয়ে আসে। অন্যদের তেমন একটা সমস্যা হয়নি, কিন্তু ওয়ার্ডে দুটো বাচ্চার অক্সিজেন লাগানো ছিল, তাদের কী অবস্থা জানি না। ’

রফিকুল ইসলাম নামে আরেকজন বলেন, ‘শুনেছি এসি থেকে আগুন লেগেছে। এরপর সঙ্গে থাকা বেডের কাপড়ে আগুন লেগে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। হাসপাতালে যদি হুটহাট এভাবে আগুন লেগে যায়, তাহলে তো রোগীদের জন্য ভয়ের বিষয়। ’

ডায়রিয়ার কারণে সাত দিন ধরে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে ভর্তি ছিল পাঁচ মাসের শিশু আয়াত। বৃহস্পতিবার তাকে আইসিইউ থেকে চতুর্থ তলার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে স্থানান্তর করেন চিকিৎসক। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে আয়াতের মা নীলা কোনোরকমে তার বাচ্চাকে নিয়ে নিচে নামেন।

আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর মোহাম্মদপুর ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মোহাম্মদ ফখরুদ্দিন বলেন, ‘দুপুর ২টা ২৮ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। এরপর আমাদের ফায়ার সার্ভিসের টিম ঘটনাস্থলে অনুসন্ধান চালায়। তবে আমরা কোনো ভুক্তভোগীকে পাইনি। আগুন লাগার পরপরই আইসিইউতে থাকা সবাইকে সরিয়ে নিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও রোগীর স্বজনরা। আমরা ধারণা করছি আইসিইউর ভিতরে এসি ছিল। সেটা থেকে হয়তো আগুন লেগেছে। তবে তদন্তের পর সঠিক কারণ জানা যাবে। ’

এদিকে গতকাল বিকালে আগুনের ঘটনায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আগুনের ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কার্ডিয়াক আইসিইউ বিভাগের প্রধানকে আহ্বায়ক করে একজন মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, ওয়ার্ড মাস্টার, একজন সিনিয়র নার্স ও ফায়ার সার্ভিসের প্রতিনিধি সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা তিন দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন জমা দেবেন। ’ তিনি বলেন, ‘এখন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সেবা চালু করা। আমাদের নিজস্ব টেকনিক্যাল টিম, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, ডিপিডিসি ও ফায়ার সার্ভিস চেক করে যদি সিদ্ধান্ত দেন তাহলে আমরা নিচতলা থেকেই চালু করতে চাই। এভাবে ধীরে ধীরে আমরা সবকিছু চালু করতে চাই। কাজ চালু হয়ে গেছে। তদন্ত কমিটির সিদ্ধান্ত ছাড়া এখন অতিরিক্ত কিছু আর বলতে পারছি না। ’ গত মঙ্গলবারও শিশু হাসপাতালে আগুন লেগেছিল-এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কয়েক দিন আগে ৫ নম্বর ওয়ার্ডে আগুনের বিষয়টি সেভাবে বড় কিছু ছিল না। খাবার গরম করার চুলায় রোগীর স্বজনের কাপড়ে আগুন লেগেছিল। যা নার্সসহ স্টাফদের চেষ্টায় সঙ্গে সঙ্গে নেভানো হয়। আজকের যে আগুন সেটির বিষয় এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। ’ আপনাদের প্রস্তুতিতে ঘাটতি ছিল কি না-জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক বলেন, ‘হাসপাতালে ২ শতাধিক এসি রয়েছে। শীত শেষে গরম আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি এসি সার্ভিসিং করা হয়। সেদিনের আগুনের পরই আমাদের নার্সেরা ফায়ার এক্সটিংগুইশার দিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলেছেন। আজকের আগুনে ধোঁয়া বেশি হওয়ার কারণে কেউ যেতে পারেননি। ফলে আমাদের ফায়ার এক্সটিংগুইশারগুলো ব্যবহার করতে পারিনি। যার কারণে ফায়ার সার্ভিসকে জানাতে হয়েছে। দ্রুত ফায়ার সার্ভিস চলে আসায় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। সবাই নিরাপদে আছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *