১০ বছর ধরে সচিব শহিদুল হক, আছে নানা অভিযোগ

স্টাফ রিপোর্টার: একই পদে প্রায় ১০ বছর ধরে আছেন তিনি। চাকরির নির্ধারিত মেয়াদ শেষে চারবার নিয়েছেন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। দীর্ঘ সময় একই পদে থাকায় নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। তিনি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ শহিদুল হক।
তার বিরুদ্ধে সুবিধা নিয়ে ভেটিংয়ের সময় তামাক নিয়ন্ত্রণ-সংক্রান্ত বিধিবিধানে তামাক কোম্পানির পক্ষে বিভিন্ন বিষয় যুক্ত করা, প্রকল্প শেষ হওয়ার পরও অবৈধভাবে গাড়ি ব্যবহার, বিপুল সম্পত্তি অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। বিদেশ ভ্রমণে সিদ্ধহস্ত শহিদুল হকের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়াকালীন ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। সহকর্মীদের অভিযোগ, দীর্ঘ সময় ধরে থাকলেও শহিদুল হক লেজিসলেটিভ বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিতে উদ্যোগী হননি। তিনি কর্মকর্তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেন না, কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণ ও লেখাপড়া করতেও যেতে দিতে চান না । লেজিসলেটিভ বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, এত দীর্ঘ সময় ধরে একই স্থানে কোনো সচিবের দায়িত্ব পালনের নজির বাংলাদেশে নেই। ২০০১ সালের ১০ অক্টোবর থেকে ২০০১ সালের ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আইনমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। ব্যারিস্টার মওদুদ তার আত্মীয়-স্বজন ও দলীয় মতাদর্শের কর্মকর্তাদের এ বিভাগে নিয়োগ দেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর লেজিসলেটিভ আলাদা বিভাগ হলে বিচার ক্যাডারের কর্মকর্তা শহিদুল হককে সচিব নিয়োগ দেয়া হয়। একটা সময় পর্যন্ত তার থাকা যৌক্তিক ছিল। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, বিশেষায়িত ও কারিগরি পদের ক্ষেত্রে যেখানে দক্ষ লোকের সংখ্যা খুবই কম সেখানে শুধু চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়ার নিয়ম। শহিদুল হক মূলত অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে বারবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিয়েছেন, আর বঞ্চনার দুঃখ নিয়ে অনেক কর্মকর্তাকে অবসরে যেতে হয়েছে। দীর্ঘ সময় একই পদে থাকার সুযোগে শহিদুল হক স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠেন, জড়িয়ে পড়েন নানা অনিয়মে।
শহিদুল হক খুলনার আওয়ামী লীগের খ্যাতিমান নেতা ও সাবেক মন্ত্রী মরহুম সালাউদ্দিন ইউসুফের মেয়ে তাহমিনা হকের স্বামী। তিনি তার শ্বশুরের নাম ব্যবহার করে সরকারের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে থাকেন। চলতি মাসেই শেষ হচ্ছে তার সর্বশেষ চুক্তির মেয়াদ। তিনি পঞ্চম দফায় চুক্তি নেয়ার জন্য ইতোমধ্যে জোর তদবিরে নেমেছেন বলেও জানা গেছে।
তবে শহিদুল হককে ফের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হলে লেজিসলেটিভ বিভাগের কর্মকর্তারা সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হবেন বলে জানিয়েছেন।
বিভিন্ন অভিযোগ অস্বীকার করে শহিদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘কিছু লোক নানা দোষারোপ করে আমাকে হেয় করার চেষ্টা করছে। এসব অভিযোগ এর বাইরের কিছু নয়।’
লেজিসলেটিভ সচিবের একই পদে ১০ বছর ধরে থাকা প্রসঙ্গে আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবদুল মতিন খসরু জাগো নিউজকে বলেন, ‘কাউকে চুক্তি দেয়ার বিষয়টি সরকারের এখতিয়ার। তবে পৃথিবীতে কোনো পদের জন্য কেউ অপরিহার্য নয়। যোগ্য অন্যদেরও কাজের সুযোগ দিতে হবে।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ- টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ যোগ্য ব্যক্তির কাজের সুযোগ করে দেয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায়। এতে অনেকে পদোন্নতির জন্য যোগ্য হওয়ার পরও তাদের পদোন্নতি দেয়া যায় না, দেখা যায় প্রণোদনার ঘাটতি। সরকারের বিষয়টি খেয়াল করা উচিত।’
একের পর এক চুক্তি পেয়েছেন ১৯৯৮ সালে লেজিসলেটিভ ড্রাফটিং উইং করা হয়। ২০০৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে আইন ও বিচার বিভাগ এবং লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ নামে দুটি পূর্ণাঙ্গ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ওইদিন থেকেই চলতি দায়িত্বে সচিব হন তিনি। ২০১০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিবের দায়িত্ব পান শহিদুল হক। পূর্ণ সচিব হন ২০১২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। চাকরির মেয়াদ শেষে ২০১৪ সালের ১২ নভেম্বর অবসরোত্তর ছুটি (পিআরএল) বাতিল করে চুক্তিতে এক বছরের জন্য নিয়োগ দেয়া হয় শহিদুল হককে। এরপর ২০১৫ সালের ৩ নভেম্বর লেজিসলেটিভ সচিব হিসেবে শহিদুল হকের চুক্তির মেয়াদ দুই বছর বাড়ানো হয়। চুক্তিতে থাকার সময় ২০১৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সিনিয়র সচিব হন তিনি। সিনিয়র সচিব হওয়ার পর লেজিসলেটিভ বিভাগেই ওই বছরের ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত চুক্তিতে নিয়োগ পান শহিদুল হক।
এরপর ২০১৭ সালের ৩১ অক্টোবর লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব হিসেবে শহিদুল হকের চুক্তির মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানো হয়। সেই মেয়াদ আগামী ৩১ অক্টোবর শেষ হবে।
আইন মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুরে জন্ম নেওয়া শহিদুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর ১৯৮২ সালে বিসিএস (বিচার) ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে মুন্সেফ পদে যোগদান করেন। মুন্সেফ ছাড়াও সহকারী জজ, সিনিয়র সহকারী জজ, সাব-জজ, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এবং জেলা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শহিদুল হক।
দীর্ঘদিন একই পদে থাকার বিষয়ে শহিদুল হক বলেন, ‘সরকার আমাকে প্রয়োজন মনে করেছে তাই এতদিন রেখেছে। আমি যদি দক্ষতা ও সততার পরিচয় দিতে না পারতাম তাহলে সরকার কেন এতদিন আমাকে রেখেছে?’
তিনি বলেন, ‘আমি কখনও তদবির করি না। এবারও তদবির করছি না। সরকার যদি প্রয়োজন মনে করে তবে রাখবে। সরকার না রাখতে চাইলে আমি এক ঘণ্টাও থাকতে পারব না।’
১৯৮০ সালের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার সময় শহিদুল হক ফজলুল হক মুসলিম হলের ছাত্র ছিলেন। অভিযোগ আছে, তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের কমিটিতে ছিলেন।
তবে ছাত্রদলের কমিটিতে থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমি কোন ধরনের রাজনীতি করতাম তা প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী জানেন। তার কাছ থেকে জেনে নিতে পারেন।’
২ সন্তান বিএটিতে, তামাক কোম্পানির পক্ষে বিধিবিধান
‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩’ বাস্তবায়নে এ সংক্রান্ত বিধিমালায় সিগারেট কোম্পানির পক্ষে বিধান যুক্ত করার অভিযোগ রয়েছে লেজিসলেটিভ সচিব শহিদুল হকের বিরুদ্ধে।
কারণ শহিদুল হকের ছেলে তাসদীকুল হক প্রতীক ও মেয়ে সামিহা হক প্রমা ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটি) কোম্পানিতে চাকরি করেন।
‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা’র খসড়ায় বলা হয়েছিল, তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেট, মোড়ক, কার্টন বা কৌটায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সরবরাহ করা রঙিন ছবি ও লেখা সমন্বিত স্বাস্থ্য সতর্কবাণী অবিকল ছাপতে হবে।
বিধি কার্যকর হওয়ার সর্বোচ্চ নয় মাস পর থেকে সতর্কবাণীযুক্ত মোড়ক ছাড়া কোনো তামাকজাত দ্রব্য বাজারজাত বা বিক্রি করা যাবে না বলেও বলা হয় খসড়া বিধিমালায়। এ অবস্থায় এটি লেজিসলেটিভ বিভাগে ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হয়। লেজিসলেটিভ বিভাগ সতর্কবাণীযুক্ত করার সময় নয় মাস থেকে বাড়িয়ে ১৮ মাস করার প্রস্তাব দিয়ে বিধিমালার খসড়াটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠায়।
২০১৪ সালের ২৯ মে ‘বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস- ২০১৪’ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তখনকার স্বাস্থ্য সচিব এম এম নিয়াজউদ্দিন বিধিমালা নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘আইন মন্ত্রণালয় সতর্কবাণীযুক্ত করার সময় ১৮ মাস করার কথা বলেছে। বিষয়টি আমাদের কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি। আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।’ পরে অবশ্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বাধার মুখে সতর্কবাণী যুক্ত করার সময় ১২ মাস করা হয়।
আইন মন্ত্রণালয় সাধারণত ভেটিংয়ের সময় কোনো আইন বা বিধি বহাল, অন্য কোনো আইন বা বিধির সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি-না, তা দেখে থাকে। এর বাইরে আইন বা বিধিমালায় কোনো সংশোধন আনার এখতিয়ার না থাকলেও তখন শহিদুল হক সিগারেট কোম্পানিগুলোর পক্ষে সংশোধন এনেছিলেন বিধিমালায়।
এছাড়া ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন) আইন’ অনুযায়ী তামাক পণ্যের সচিত্র সতর্কবার্তা প্যাকেটের উপরিভাগের ৫০ শতাংশে রাখার বিধান থাকলেও সেটা বদলে তামাক কোম্পানির দাবি অনুযায়ী নিচের অংশে ওই সতর্কবার্তা ছাপানোর সুযোগ দিয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। এর পেছনেও হাত ছিল লেজিসলেটিভ সচিবের।
২০১৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ওই গণবিজ্ঞপ্তি কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। স্বাস্থ্য সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিব এবং জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের কোঅর্ডিনেটরকে এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছিল তখন।
তামাক কোম্পানির পক্ষ নেয়ার বিষয়ে সচিব বলেন, ‘সতর্কবাণী যুক্ত করা হয়েছে। নতুন একটা সিস্টেমে যাচ্ছি, এ কারণে পক্ষ-বিপক্ষ বিবেচনা করে আমরা প্রস্তাব দিয়েছিলাম। পরে মন্ত্রণালয় যেটা এগ্রি করেছে আমরা তো সেটাই রেখেছি। এর মধ্যে আমার দোষের কী দেখছেন? আমরা তো বলিনি লাগবে না।’
তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে-মেয়ে কি ওই কোম্পানিতে চাকরি করতে পারবে না? আমার সন্তানরা তাদের যোগ্যতায় সেখানে চাকরি করছে, তারা ভালো প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা করেছে, তারা মেধাবী।’
অবৈধ গাড়ি ব্যবহার
সচিব হয়েও ‘প্রমোশন অ্যাকসেস টু জাস্টিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস ইন বাংলাদেশ’ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হন শহিদুল হক। প্রকল্প শেষ হওয়ার পরও তিনি সেটি পরিবহন পুলে জমা দেননি। দাতা সংস্থা ইউএনডিপির অর্থায়নে এ প্রকল্পের গাড়িটি (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৩৭৮২৬) শহিদুল হক তার পারিবারিক কাজে ব্যবহার করেছেন।
২০১৫ সালের এপ্রিলে প্রকল্পটি শেষ হয়। ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে চিঠি দিয়ে উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় কেনা কোনো গাড়ি আছে কিনা- তা লেজিসলেটিভ বিভাগের কাছে জানতে চাওয়া হয়। শহিদুল হক তখনও গাড়িটি জমা না দিলেও ১ ফেব্রুয়ারি লেজিসলেটিভ বিভাগের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক-৬ শামীম আহম্মেদের কাছে লেখা চিঠিতে জানিয়ে দেয়া হয়, বিভাগের কাছে উন্নয়ন প্রকল্পের কোনো গাড়ি নেই। যা সম্পূর্ণ মিথ্যা তথ্য ছিল।
এ বিষয়ে শহিদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘গাড়িটি গত বছরের ১৮ জুলাই পরিবহন পুলে জমা দেয়া হয়েছে।’
একাধিক বাড়ি-ফ্ল্যাট-জমি
ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে শহিদুল হকের নামে-বেনামে বাড়ি, ফ্ল্যাট ও জমি রয়েছে বলে জানা গেছে। রাজধানীর শ্যামলীর আদাবরে বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটিতে (বাড়ি নং- ৮১৭, রোড নং-৪) একটি বাড়ি রয়েছে।
রাজউকের মিরপুর পল্লবী ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের পল্লবী দ্বিতীয় পর্বের প্রকল্পে তার স্ত্রী তাহমিনা হকের নামে একটি পাঁচ কাঠা প্লট রয়েছে (কে-মেইন রোড, প্লট নম্বর কে-২৬)।
এছাড়া শহিদুল হকের পূর্বাচলে নিজ নামে ১০ কাঠার প্লট, পূর্বাচলে তথ্য গোপন করে স্ত্রীর নামে সাত কাঠার প্লট, ধানমন্ডিতে ফ্ল্যাট, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নিজ নামে চার কাঠার প্লট, ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা আমেরিকার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির পেছনে বহুতল বিশিষ্ট নির্মাণাধীন একটি বাড়ি, ঢাকার সার্কিট হাউজ রোডে ইস্টার্ন হাউজিংয়ে একটি ফ্ল্যাট, সাভারের ভাটপাড়া হাউজিং সোসাইটিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে একাধিক প্লট রয়েছে বলে জানা গেছে।
বিভিন্ন আইন, বিধিমালাসহ বিভিন্ন আইনগত দলিল ভেটিংয়ের সময় সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর কাছ থেকে সুবিধা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে শহিদুল হকের বিরুদ্ধে।
এসব বিষয়ে শহিদুল হক বলেন, ‘পূর্বাচলে প্লট নেই প্রশাসনের এমন একটা সিনিয়র লোক আমাকে দেখান। আমি সরকারের একাধিক প্লট নেইনি। ভাটপাড়ার প্লটটি আমার ভাইয়ের ছিল, পরে তিনি আমার নামে লিখে দেন।’
‘আমার স্ত্রী আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রধান নেতা সালাউদ্দিন ইউসুফের মেয়ে। এমন একটা ফ্যামিলির মেয়ের ছোটখাট প্রপার্টি থাকতে পারে না?’
সহকর্মীরা ক্ষুব্ধ
সচিবালয় নির্দেশিকা ও মন্ত্রণালয়ের আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ আদেশ অমান্য করে শহিদুল হক স্বেচ্ছাচারীভাবে সব সিদ্ধান্ত এককভাবে নেন বলে অভিযোগ তুলেছেন বিভাগের বেশির ভাগ কর্মকর্তা।
বর্তমানে লেজিসলেটিভ বিভাগে প্রথম শ্রেণির ১০৪ জন, দ্বিতীয় শ্রেণির ৪৪ জন কর্মকর্তাসহ মোট ৩০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। নিজে বেশির ভাগ সময় বিদেশে পড়ে থাকলেও অন্যদের বিদেশে প্রশিক্ষণ ও লেখাপড়ার সুযোগ দেয়ার ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত রক্ষণশীল বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
১৩তম ব্যাচের উপ-সচিব মালেকা বাহার শামসী মাল্টায় পিএইচডির সুযোগ পেলেও শহিদুল হক তাকে যেতে অনুমতি দেননি। পরে তিনি অনেকটা অভিমান করেই অনুমতি ছাড়া বিদেশে পিএইচডি করতে চলে যান। অননুমোদিতভাবে বিদেশে যাওয়ায় পর তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
গত ১০ বছরে ১৫০ বারেরও বেশি বিদেশ সফর করেছেন। গত পাঁচ বছরের মধ্যে তার দুই বছর সময় বিদেশে কেটেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তিনি অনুরোধের মাধ্যমে অন্য মন্ত্রণালয়ের জিও’র (আদেশ) জারি করে বিদেশে গেছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, দীর্ঘদিন ধরে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে লেজিসলেটিভ ড্রাফটিং কর্মকর্তাদের পদোন্নতিজনিত বিরোধ মেটাতে মামলা-মোকদ্দমা শেষে দুটি পৃথক বিভাগ হয়। কিন্তু শহিদুল হকের কারণে কর্মকর্তাদের বঞ্চনার দুঃখ রয়েই যায়।
শহিদুল হকের দফায় দফায় চুক্তির কারণে কমপক্ষে চারজন অতিরিক্ত সচিব, সচিব পদে পদোন্নতি বঞ্চিত হয়ে মনোকষ্টে চাকরি থেকে বিদায় নেন। এটা জুনিয়র কর্মকর্তাদের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে, স্বাভাবিক কাজের পরিবেশ নষ্ট করেছে বলে জানান কর্মকর্তারা। এবার তার চুক্তির মেয়াদ আবারও বাড়ানো হলে কয়েকজন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি ছাড়াই বিদায় নিতে হবে।
সর্বশেষ ২০১৭ সালের নভেম্বরে শহিদুল হককে দুই বছরের চুক্তিতে নিয়োগ দেয়া হলে তখন বাংলাদেশ লেজিসলেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছিল।
অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং তখনকার লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. ইসরাইল হোসেনের (বর্তমানে অবসরে) সভাপতিত্বে সভাশেষে ২০১৭ সালের ২৬ অক্টোবর অ্যাসোসিয়েশন বিবৃতিতে জানিয়েছিল, দীর্ঘ আট বছর এ বিভাগের সচিব পদে শহিদুল হক অধিষ্ঠিত থাকার পরও সার্ভিসের ও বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, এমনকি এসব বিষয়ে সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। এতে সকল স্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে উপস্থিত সকল সদস্য একমত পোষণ করেন যে, সার্ভিসের উন্নয়নসহ কর্মকর্তাদের মধ্যে সুষ্ঠুভাবে কর্মসম্পাদনের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে এ বিভাগে সবপ্রকার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বন্ধ করা আবশ্যক।
এবারও শহিদুল হককে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হলে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একজোট হয়ে উচ্চ আদালতে সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানিয়েছেন।
সহকর্মীদের বিদেশে প্রশিক্ষণ বা লেখাপড়ার করতে যেতে বাধা দেয়ার বিষয়ে শহিদুল হক বলেন, ‘এ বিভাগের অনেক কাজ, কিন্তু লোকবল কম। ২/৩ জনের গ্রুপ ৭/৮টি মন্ত্রণালয়ের (আইন, বিধিবিধান প্রণয়ন সংক্রান্ত কার্যক্রম) দেখে। এর মধ্যে লোক না থাকলে কাজ কীভাবে চলবে? আমি সরকারের স্বার্থ দেখব নাকি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের স্বার্থ দেখব?’
তবে দীর্ঘদিন একই পদে থাকায় নিচের দিকের কেউ কেউ বঞ্চিত হচ্ছেন- স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘সরকার যদি কাউকে নিয়োগ দেয়, সেটা সবাইকে মেনে নিতে হবে।’
নিজের বিদেশ ভ্রমণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি এ বছর এখন পর্যন্ত পাঁচবার বিদেশে গেছি। এমন একটা পদে থেকে পাঁচবার বিদেশ যাওয়া কি বেশি হয়ে গেছে, বলুন?’
যা করে লেজিসলেটিভ বিভাগ
লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ প্রধানত সরকারের পক্ষে জাতীয় সংসদে উত্থাপনের জন্য সব আইন প্রণয়নের প্রস্তাব বা বিল ইত্যাদির খসড়া প্রস্তুত ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকে। অধ্যাদেশের খসড়া প্রণয়ন ও অধ্যাদেশ জারি এবং পরবর্তী অধিবেশনের প্রথম বৈঠকের ৩০ দিনের মধ্যে তা জাতীয় সংসদে উথাপন করাও এ বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সকল অধঃস্তন আইন, যেমন- বিধি, প্রবিধি, উপ-আইন, প্রজ্ঞাপন ইত্যাদি এবং সকল আন্তর্জাতিক চুক্তি ও আইনগত ভিত্তি আছে এমন সকল আইনগত বিষয়সহ গুরুত্বপূর্ণ সকল চুক্তি ভেটিংয়ের (পরীক্ষা-নিরীক্ষা) কাজও এ বিভাগ করে থাকে।
এছাড়া এ বিভাগ সংবিধান ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দফতরের আইন, বিধি, প্রবিধি, উপ-আইন, সমঝোতা স্মারক, আন্তর্জাতিক চুক্তি, সন্ধি ইত্যাদির ক্ষেত্রে আইনগত মতামত দিয়ে থাকে। সকল আইন ও আইনানুগ দলিল বিশেষ করে ইংরেজী থেকে বাংলায় এবং বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা এ বিভাগের অন্যতম দায়িত্ব। আইন সংকলন, সংহতকরণ, অভিযোজন এবং এর কারিগরি সংশোধন লেজিসলেটিভ ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। বিদ্যমান সকল আইনের পর্যায়বৃত্ত মুদ্রণ ও প্রকাশনা এবং প্রকাশনার কপিরাইট নিয়ন্ত্রণ ও সংরক্ষণের কাজটিও এ বিভাগের কার্যপরিধিভুক্ত। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং আইন কমিশনের প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়/বিভাগ হিসেবে এ বিভাগ যাবতীয় কাজ করে থাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *