হারিয়ে গেছে জীববৈচিত্র্য স্রোতস্বিনী আত্রাই এখন মরা খাল, দিন দিন হারাচ্ছে নাব্যতা জেগে উঠেছে অসংখ্য চর
মো. আব্দুর রহিম, (নওগাঁ) : পণ্য পরিবহণ, যাত্রি ও গাড়ি পারাপার, আন্তঃ উপজেলা সংযোগ স্থাপন, ব্যবসা বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আত্রাই নদীর ছিল একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কালের আবর্তে আত্রাই নদীর সুনাম ও জৌলুস আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে। এক সময়ের স্রোতস্বিনী আত্রাই এখন শুধুই মরা খাল। শুধুই স্মৃতি। নদীর উভয় পাশে বড় বড় চর জেগে ওঠায় মূল নদীটি খাড়ি বা খালের রূপ ধারণ করেছে। হারিয়ে গেছে অনেক জীববৈচিত্র্য।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, আত্রাই নদী ভারতের শিলিগুড়ি থেকে উৎপন্ন হয়ে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড়, ঠাঁকুরগাঁও, দিনাজপুর, নওগাঁ ও রাজশাহী জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে যমুনা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। আত্রাই নদীর উপরের অংশ করতোয়া ও নীচের অংশ বড়াল নদী নামে পরিচিত। এই নদীর মোট ৩৮৫ কিলোমিটার দীর্ঘ। রাজশাহী জেলা হতে আত্রাই নদী কয়েকটি শাখায় বিভক্ত হয়েছে। একটি শাখা নওগাঁ জেলার পতœীতলা-মহাদেবপুর উপজেলার দক্ষিণে গিয়ে পূর্বদিকে বাঁক নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়েছে। এই প্রবাহ পথে খুলনা-পার্বতীপুর ব্রডগেজ রেললাইনের আত্রাই সেতু অতিক্রম করেছে। এরপর নাটোরের সিংড়ার কালি মন্দিরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নন্দজার সাথে মিলিত হয়েছে। এই মিলিত স্রোত গুমানী নামে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে বড়াল নদীর সাথে মিলিত হয়েছে।
আত্রাই নদীর অনেক উপনদী আছে। এই উপনদীগুলো আবার বিভিন্ন শাখা প্রশাখায় বিভক্ত। যার মধ্যে ডানতীরে ফকিরণী ও বড়াল ও বামতীরে করতোয়া অবস্থিত। এককালে উত্তর বাংলার বিখ্যাত নদী ছিল আত্রাই। প্রাচীন মহাভারতে আত্রাই এর নাম পবিত্র আত্রেয়ী নদী হিসাবে উল্লেখ রয়েছে। এক সময় আত্রাই নদী দিয়ে তিস্তার পানি গঙ্গায় গিয়ে পড়ত। তবে ১৭৮৭ সালে আত্রাই নদীর সাথে তিস্তার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
এলাকার আজির উদ্দীন (৭৮), ব্যবসায়ী খয়বর আলী (৭০)সহ অনেকেই জানান সে বেশী দিনের কথা নয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও আত্রাই নদী ছিল পূর্ণযৌবনা। আত্রাই নদীকে ঘিরে নওগাঁর পতœীতলায় গড়ে উঠেছিল পতœীতলা, কাঁটাবাড়ি, কাশিপুর ও নজিপুর হাট। প্রতিটি হাটকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল এক একটি নৌবন্দর ব্যবসাকেন্দ্র ও বাজার। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বণিকরা রং-বেরংয়ের পাল তোলা নৌকা নিয়ে কৃষি পণ্য ক্রয় করার জন্য নোঙর ফেলত এ সকল বন্দর ও বাজারে পাশে এসে। এলাকায় উৎপাদিত বিভিন্ন কৃষিপণ্যের মধ্যে ধান, চাল, গম, জব, আখেরগুড়সহ অন্যান্য সামগ্রী ক্রয় করে বণিকরা নৌকায় করে নিয়ে যেতেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। আত্রাই নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা হাট বাজারগুলোর প্রায় বিলুপ্তি ঘটেছে নদীর নাব্যতার মতো। সাথে সাথে হারিয়ে ফেলেছে জৌলুস।
এর পাশাপাশি হারিয়ে গেছে প্রায় সকল জীববৈচিত্র্য। যেমন আত্রাই নদীতে এক সময় পাওয়া যেত বিভিন্ন প্রজাতির প্রচুর মাছ। বিশেষ করে ভাদ্র, আশ্বিন ও কার্তিক মাসে নদীতে মাছের জোয়ার আসত। ধরা পড়ত বিভিন্ন প্রজাতির মাছ।
নদীর দু-পাশে শ্যালো মেশিন বসিয়ে কৃষকরা আবাদ করতেন বিভিন্ন প্রকার কৃষিপণ্য। গত ১৫ বছর আগেও আত্রাই নদীতে চলাচল করত ফেরী। নওগাঁ জেলার পশ্চিমের ২টি উপজেলা সাপাহার ও পোরশায় মানুষের পারাপারের একমাত্র মাধ্যমে ছিল পতœীতলার ফেরীঘাট। আত্রাই নদীর এ সকল দূশ্য এখন শুধুই স্মৃতি আর স্মৃতি। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে। বর্তমানে নদীর দুপাশে জেগে উঠেছে অসংখ্য চর। দৃশ্যতঃ মূল নদী পরিণত হয়েছে মরা খালে। নদীর চর ও বুকে মানুষ বিচ্ছিন্ন ভাবে ফলাতে শুরু করেছে ধান, তরমুজ, পেঁয়াজ, রসুন, গম, শাক-সবজ্বি, আখসহ নানা কৃষি পণ্য। এখন শুধুমাত্র বর্ষা মওসুমে কিছুটা সময়ের জন্য আত্রাই নদী ফিরে পায় তার পুরনো রূপ। বাঁকি সময় সেই মরা খাল। বর্ষায় আত্রাই নদী যখন পানিতে টইটুম্বুর হয়ে উঠে তখন এর দ’ুপাশে ভীড় করে দেখার জন্য অসংখ্য ছোট-বড় মানুষ। পুরনো স্মৃতি তাদেরকে ক্ষনিকের জন্য হলেও উজ্বিত করে। অনেকে ভাবেন, হয়ত এমন এক দিন আসবে তাদের এই স্মৃতি টুকুও হারিয়ে যাবে। তখন শুধুই দীর্ঘশ্বাস থাকবে।
ছবির ক্যাপশন;পতœীতলা(নওগাঁ): আত্রাই নদী এখন মরা খাল। নওগাঁর পতœীতলা উপজেলা সদর নজিপুরে আত্রাই নদীর উপর নির্মিত ’শহীদ সিদ্দিক-প্রতাপ সেতুর’ নীচে চাষ হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির ফসল। এ ছবিটি ধারণ করেছেন আমাদের স্থানীয় প্রতিনিধি মো: আব্দুর রহিম।