আজ নব আনন্দে জাগ্রত ধরণী
ঢাকা: ‘আজি নতুন রতনে ভূষণে যতনে/ প্রকৃতি সতীরে সাজিয়ে দাও’- আজ নব আলোর কিরণশিখা শুধু প্রকৃতিকে নয়, রঞ্জিত করে নবরূপে সাজিয়ে যাবে প্রত্যেক বাঙালির হৃদকোণও। নব আলোর শিখায় প্রজ্বলিত হয়ে শুরু হবে আগামী দিনের পথচলা। যতসব জীর্ণতা, সব মঙ্গলের অগ্নিস্নাতে পূণ্য করতে এসেছে নতুন বর্ষ। আজ মঙ্গলবার পহেলা বৈশাখ। বাংলা সনের প্রথম দিবস। স্বাগত ১৪২২। শুভ নববর্ষ।
আজ প্রভাতে পূর্বাকাশে লাল টকটকে সূর্যের কিরণচ্ছটার মধ্যদিয়ে ইতোমধ্যে যাত্রা শুরু করেছে নতুন বছর। উচ্ছ্বাস-সুভ অনুভূতিকে সঙ্গী করে নিদ্রাভঙ্গ হয়েছে বাঙালির। নব নব স্বপ্ন আর পুরোনোকে স্মৃতির মণিকোটরে গেঁথে এসেছে নতুন এ বছর। আজ নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার দিন। বাঙালির সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসব পহেলা বৈশাখকে বরণ করে নিতে প্রস্তুত এখন বাঙালিরা।
আজ বৈশাখ করে বরণ করে সবাই যেমন বলবে ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’; তেমনি কায়মনে প্রার্থনা করবে ‘তাপস নিঃশ্বাস বায়ে… মূমুর্ষেরে দাও উড়ায়ে/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক…/ মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’ অনেকেই আবার কবির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলে উঠবে ‘কি ফুল ফোটাবে তুমি হে বৈশাখ/ তোমার শাখায় সে কথা তুমিই জানো,/ হয়তো বা তুমিও জানো না তোমার প্রথম দিনে।/ বিধাতার মৌন অনুরোধ পারে না হেলিতে/ তাই ঘুরে ঘুরে আসে বারে বারে প্রত্যেক চৈত্রের শেষে।’
‘হে ভৈরব/ হে রুদ্র বৈশাখ/ ধুলায় রুক্ষ উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল/ তপঃক্লিষ্ট তপ্ত তনু/ মুখে তুলি বিষাণ ভয়াল/ কারে দাও ডাক…./ হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ!’- ‘বৈশাখ’ কবিতায় এভাবেই বৈশাখের রুদ্ররূপ বর্ণনা করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবির লেখা পঙ্ক্তিমালার মতো রুদ্ররূপ নিয়ে আজ আমাদের দুয়ারে এসে হাজির হয়েছে পহেলা বৈশাখ। গত কয়েক দিনের তাপদাহ আজও বিদ্যমান থাকবে এমনটাই জানিয়েছে আবহাওয়া কর্তৃপক্ষ।
পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আজ মঙ্গলবার সরকারি ছুটির দিন। রাষ্ট্রপতি, আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া পৃথক পৃথক বাণীতে দেশবাসীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। সংবাদপত্রগুলোও প্রকাশ করছে বিশেষ ক্রোড়পত্র। রেডিও-টেলিভিশনে প্রচারিত হবে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। সেই সঙ্গে আছে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নানা আয়োজন আর ব্যবসায়ীদের হালখাতা। এসব মিলিয়ে পুরো দেশে এখন বইছে নববর্ষের উৎসবের আমেজ।
মঙ্গলবার বর্ষবরণের উৎসবের আমেজে মুখরিত থাকবে বাংলার প্রতিটি কোণ। গ্রীষ্মের তাপদাহও আজ রুখতে পারবে না উৎসবপ্রিয় বাঙালিদের। দেশের প্রতিটি পথে-ঘাটে, মাঠে-মেলায়, অনুষ্ঠানে থাকবে কোটি মানুষের প্রাণচাঞ্চল্য আর উৎসবমুখরতা। পহেলা বৈশাখের শুভলগ্নের আনন্দে আজ বাঙালি ধর্মান্ধ অপশক্তির কূট ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করবার আর কুসংস্কার ও কূপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা নেবে, হবে ঐক্যবদ্ধ। চিরাচরিত ঐতিহ্যানুযায়ী ধর্ম, বর্ণ, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলে মেতে উঠবে বৈশাখী উৎসবে। আর নতুনের আহ্বানে অন্তরের মাঝে গীত হতে থাকবে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই গান- ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল বৈশাখীর ঝড়…’। এই সুর ধ্বনির মধ্য দিয়েই বাঙালি নতুন বছরের সকল অপ্রাপ্তি ভুলে গিয়ে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে। ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, সুখীসমৃদ্ধ দেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়েই বাঙালি পালন করবে এবারের পহেলা বৈশাখ।
পহেলা বৈশাখ ঠিক কবে থেকে পালিত হয়ে আসছে তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে রয়েছে দ্বিধাবিভক্ততা। বিভিন্ন বই ঘেটে জানা যায়, হিন্দু সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বারটি মাস অনেক আগে থেকেই পালিত হতো। এই সৌর পঞ্জিকার শুরু হতো গ্রেগরিয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে। হিন্দু সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, বঙ্গ, কেরলা, মনিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিল নাড়ু এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালিত হতো। এখন যেমন নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, এক সময় এমনটি ছিল না। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আর্তব উৎসব তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হতো। তখন এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ। প্রাযুক্তিক প্রয়োগের যুগ শুরু না হওয়ার আগ পর্যন্ত কৃষকদের ঋতুর উপরই নির্ভর করতে হতো।
ইতিহাস বলে, পহেলা বৈশাখ উদযাপন মোঘল সম্রাট আকবরের শাসনামল থেকেই শুরু হয়। চৈত্র মাসের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্র্য সংক্রান্তির দিনের সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। এর পরদিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ থেকেই ‘হালখাতা’র প্রচলন শুরু হয়।
গ্রামে-গঞ্জে মানুষ আবহমানকাল ধরেই পহেলা বৈশাখ পালন করে আসলেও শহরে পালন শুরু হয়েছে উনিশ শতকে। দেশে তখন স্বদেশি আন্দোলনের যুগ। ব্রিটিশদের ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ ধারণাকে দাঁতভাঙা জবাব দিতে গ্রাম-গঞ্জের সার্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখ নাগরিকরা উদযাপন করতে শুরু করে। ক্রমশ জনপ্রিয়ও হয়ে উঠে পহেলা বৈশাখ উৎসব।
পাকিস্তান আমলে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী পহেলা বৈশাখ পালনের ব্যাপারটি সুনজরে দেখেনি। এ ব্যাপারে হিন্দুয়ানিসহ বিভিন্ন অভিযোগ তোলা হয়েছিল। কিন্তু বাংলা নববর্ষ পালনের বিষয়টি ক্রমশ জনপ্রিয় হয়েছে। বাংলা নববর্ষ উদযাপনের ক্ষেত্রে রাজধানী ঢাকায় ১৯৬৫ সালে যুক্ত হয় নতুন মাত্রা। ওই বছর রমনার বটমূলে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ছায়ানট’ আয়োজন করেছিল বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। এরপর থেকে প্রতিবছর রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখের সকালে অনুষ্ঠিত হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠান, যা এখন ঢাকার বাংলা বর্ষবরণের প্রধান উৎসব।