সাত ক্ষতির মুখে অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুন্দরবন

Mongla siloমো. মনির হোসেন,মংলা থেকে : ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সুন্দরবন এখন সাত ক্ষতির মুখোমুখি। বনের ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে এ ক্ষতি বিস্তৃত। এসব ক্ষতিতে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ বিঘœ হচ্ছে। বনের উদ্ভিদ ও জলজ প্রাণির স্বাভাবিক জীবন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আরও তিনটি ক্ষতি হাতছানি দিচ্ছে। সেগুলো হচ্ছে বনের অদূরে রামপাল-কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, মংলা বন্দরের পশ্চিমে জয়মনি ঘোলের কাছে শিপইয়ার্ড ও খাদ্য বিভাগের সাইলো নির্মাণ।

জেলা প্রশাসনের গেজেটিয়ারে সুন্দরবন বিভাগের চিত্র তুলে ধরে এক প্রবন্ধে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (পশ্চিম) জহির উদ্দিন আহমেদ পরিবেশের এ ক্ষয়ক্ষতির কথা উল্লেখ করেছেন। ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে রয়েছে বনের পশ্চিমাঞ্চলের তুলনায় পূর্বাঞ্চলের লবণাক্ততা কম, সুন্দরবনের পূর্বাঞ্চলের লবণাক্ততা বেশী, যান্ত্রিক নৌযান চলাচলে জলজ ও প্রাণির জীবনকে বাধাগ্রস্ত করছে, লোকালয়ের আমনের জমিতে চিংড়ি চাষ করার ফলে বনের সামাজিক ও পরিবেশের ওপর বিরুপ প্রভাব ফেলছে, পর্যটকদের ফেলা আবর্জনা-পলিথিন ব্যাগ, সার ও কীটনাশক বৃষ্টির পানির সাথে মিশে জলজ বৈচিত্রের ক্ষতি, শিল্পকলকারখানার বর্জ্য নিসরণ জলজ বৈচিত্রের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত এবং নোনা ও মিঠে পানির মিশ্রনে পর্যায়ক্রমে পলি পড়ার কারণে উৎপাদনশীলতার ব্যাঘাত হচ্ছে-অঙ্কুরোদগম হচ্ছে না কেওড়া বীজের। বনের ভিতরে নদীগুলোতে ভারী নৌযান চলাচল করায় মিশ্রিত তেল ও বর্জ্য সুন্দরবনের ভিতরে ছড়িয়ে পড়ছে।sundarban

ইন্টার প্রেস সার্ভিস এক বিশেষ প্রতিবেদনে ব্রিটিশ সরকারের গবেষণা প্রকল্প পরিচালক টেরী থমাসকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে জোয়ারের যে পরিমাণ নোনা পানি বনের নদী-খালে প্রবেশ করে, ভাটার টানে সেই পরিমাণ নোনা পানি সাগরে ফিরে আসছে না। এতে বনের পানিতে লবণাক্ততা অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। গত কয়েক দশকে বনের জীব বৈচিত্রে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। হুমকির মুখে পড়েছে জলজ সম্পদ ও বন্য পশুপাখি।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্টি এন্ড উড টেকনোলোজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুস সোবাহান মল্লিক জানান, লবণাক্ততা বাড়ায় সুন্দরী, পশুর ও গেওয়া গাছ টিকে থাকা কষ্টসাধ্য। এবার বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম হওয়ায় লবণাক্ততা বেড়েছে। জাহাজ থেকে তেল নিসরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই পদার্থ পলিমাটিতে জমে মাটির ছিদ্র বন্ধ করায় বিভিন্ন প্রজাতির বীজের অঙ্কুরোদগম হচ্ছে না।

সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক উল্লেখ করেন, গত কয়েক দশকে গবেষণার ফলে বনাঞ্চলের লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারনে উদ্ভিদ ও প্রাণিকূলের স্বাভাবিক জীবন ধারায় ব্যাঘাত হওয়ার ফলে প্রাকৃতিক প্রজনন সঠিকভাবে হচ্ছে না। এছাড়া নদীগুলোর উজানে বাঁধ দিয়ে মিষ্টি পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করার ফলে সুন্দরবনের পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বনবিভাগের অপর একটি সূত্র বলেছে, চিংড়ি ঘের করার ফলে বনের সামাজিক ও পরিবেশের ওপর বিরুপ প্রভাব ফেলেছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, কীটনাশক মিশ্রিত পানি ভেসে সুন্দরবন সংলগ্ন নদ-নদীতে পড়ায় ছোট-বড় সব প্রজাতির মাছ মারা যায়। কীটনাশকের প্রভাবে উপকূলের মৎস্য প্রজাতির ক্ষতি হচ্ছে। খুবি’র ফরেস্টি এন্ড উড টেকনোলোজি বিভাগের অধ্যাপক এ কে ফজলুল হক বলেন, রামপালের কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ফেলা পানিতে তাপমাত্রায় জলজ ও জীবের ক্ষতি হবে। জাহাজ চলাচল বাড়লে সুন্দরবনকে প্রভাবিত করবে। তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছাঁই ও ধোঁয়া নিয়ে সমস্যায় পড়তে হবে। আন্তর্জাতিক সংস্থা রামসা বন বিভাগকে দেওয়া এক পত্রে উল্লেখ করেছে শিপইয়ার্ড ও খাদ্য বিভাগ নির্মাণ করায় সুন্দরবনের জীব-বৈচিত্রের জন্য ক্ষতিকর হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *