আড়াইহাজরে ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত ৮
মোঃ মনিরুল ইসলাম, আড়াইহাজার প্রতিনিধি : নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার একটি চালের আড়তে ‘ডাকাতি চেষ্টার পর’ গণপিটুনিতে সন্দেহভাজন ৮ জন নিহত ও ৪ জন আহত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার ভোরে উপজেলার সাতগ্রাম ইউনিয়নের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পুরিন্দা বাজারে এ ঘটনা ঘটে বলে স্থানীয়দের বরাত দিয়ে আড়াইহাজার থানার ওসি সাখাওয়াত হোসেন জানান। এর মধ্যে ঘটনাস্থলেই ৭ জন এবং হাসপাতালে আরেকজন মারা যান। নিহত পাঁচজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন-ময়মনসিংহের কোতোয়ালি থানার রুবেল, টিটু, জুয়েল, শওকত, ফেনী জেলার সোনাগাজী থানার আলমপুরের এবাদুলের ছেলে রাজিব ওরফে রনি (৪০)। আহত চারজন হলেন-ময়মনসিংহের কোতোয়ালি থানার মিলন মিয়ার ছেলে সাব্বির (২৫), ছানা মিয়া ছেলে সজিব (২৬), লতিফের ছেলে মানিক (৩২) ও চাঁদপর সদরের ওসমান মিয়ার ছেলে লোকমান (২৮)।
এর মধ্যে মানিককে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার পর থানা হেফাজতে রাখা হয়েছে। বাকি তিনজনের অবস্থা আশংকাজনক হওয়ায় তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনায় দুটি মামলা করা হয়েছে। পুলিশ ও এলাবাসী জানায়, বৃহস্পতিবার ভোর ৪টার দিকে সাতগ্রাম ইউনিয়নের পুরিন্দা বাজারের নাইটগার্ড জামান, মোতালিব, আউয়ান ও নিয়ত আলীর হাত-পা বেঁধে ফেলে এবং ব্যবসায়ী এমএ গফুর ভূঁইয়ার ‘ভাই ভাই স্টোরের’ তালা ভেঙে চালের বস্তা ট্রাকে (ঢাকা মেট্রো ট-১৮-৪৩১১) তুলতে থাকে। বাজার সংলগ্ন মসজিদে কয়েকজন মুসল্লি ঘটনাটি দেখে এগিয়ে এলে তাদের কয়েকজনের হাত-পাও বেঁধে ফেলে। অন্য মুসল্লিরা মসজিদের মাইকে বাজারে ডাকাত পড়েছে বলে ঘোষণা দেয়। এতে পুরিন্দা ও আশপাশের কয়েকটি গ্রামের হাজারখানেক মানুষ লাঠিসোটা নিয়ে ডাকাতদের ধাওয়া দেয়। এ সময় পুরিন্দা বাজারে ৩ জন, পুরিন্দা রোকনউদ্দিন মোল্লার মাঠে ৪ জন, পুরিন্দা আনোয়ার মেম্বারের পুকুর এলাকায় ৩ জন ও বাগবাড়ি এলাকায় ২ জনকে গণপিটুনি দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই ৭ জন নিহত হয়। খবর পেয়ে আড়াইহাজার থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করে। সকালে পুলিশ ও ফায়ার। সার্ভিসের ডুবুরিরা আনোয়ার মেম্বারের পুকুর থেকে ৩ জনের পুরিন্দা বাজার থেকে ১ জনের ও রোকনউদ্দিন মোল্লার মাঠ থেকে ৩ জনের মৃতদেহ এবং আহত ৫ জনকে উদ্ধার করে। আহতদের প্রথমে আড়াইহাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠানো হয়। দুপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজিব ওরফে রনি মারা যায়। আহত বাকি চারজনের তিনজনকে গুরুতর অবস্থায় ঢামেক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ভাই ভাই স্টোরে মালিক গফুর ভূঁইয়া জানান, ডাকাতরা তার আড়ত থেকে ১৫০ বস্তা চাল ট্রাকে তুলে ফেলে এবং আরও চাল ট্রাকে তুলতে থাকে। এ সময় নামাজ পড়তে আসা মুসল্লিরা দেখে মসজিদের মাইকে ‘ডাকাত’ এসেছে বলে প্রচার করতে থাকে। আমরা মাইকে শুনে বাজারে আসি। এলাকাবাসী ডাকাতদের চালভর্তি ট্রাকটিও আটক করেছে। ট্রাকের গায়ে ‘গামা মুড়ির মিল’ লেখা রয়েছে। সাতগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অদুদ মাহমুদ জানান, জনতা ডাকাতদের ধাওয়া দিলে কেউ পুকুরে, কেউ বাঁশঝাড়ে ও কেউ ডোবায় কচুরিপানার তলায় লুকানোর চেষ্টা করে। জনতা তাদের আটক করে গণপিটুনি দেয়। তিনি জানান, প্রায়ই পুরিন্দা বাজারে ও আশপাশের বাড়িতে ডাকাতি হলেও এ পর্যন্ত কোনো ডাকাতকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি। বিশেষ করে শীত মৌসুমে আড়াইহাজার উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতের উপদ্রব বেড়ে যায়। গতবছরও এ সময় এলাকাবাসীর গণপিপটুনিতে মারা যায় ডাকাত দলের দুই সদস্য। ডাকাত ধরতে জড়ো হওয়া কয়েক হাজার মানুষের কারণে ভোররাত থেকে সকাল ৯টি পর্যন্ত ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়। পরে অতিরিক্ত পুলিশ এসে যান চলাচল স্বাভাবিক করে। এদিকে নিহত ডাকাত সদস্য রনির স্ত্রী নাজমা থানা হেফাজতে স্বামীর লাশ শনাক্ত করে বলেন, আমার স্বামীর ঢাকায় একটি বাসে হেলপারের কাজ করত। দশদিন ধরে তার সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ হয়নি। সে ডাকাতি করত কিনা তা আমার জানা নেই। লোক মারফত জানতে পেরে আড়াইহাজার থানায় এসে লাশ শনাক্ত করি। স্বামীর লাশ শনাক্ত করে তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। নারায়ণগঞ্জে পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিত উদ্দিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেন, ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ সাত ডাকাতের লাশ উদ্ধার করেছে। একজন হাসপাতারে নেয়ার পর মারা গেছে। আট ডাকাতের লাশ উদ্ধার করে মর্গে প্রেরণ করা হয়েছে। নিহত ডাকাতদের অধিকাংশের বাড়ি ময়মনসিংহ এলাকায়। গুরুতর আহত তিন ডাকাতকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। একজন থানা হেফাজতে রয়েছে।
গণপিটুনিতে আহতদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, এরা সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের সদস্য। ঘটনাস্থল থেকে বেশকিছু দেশীয় অস্ত্র ও একটি কাটার উদ্ধার করা হয়েছে। ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত একটি ট্রাক ও বেশকিছু চালের বস্তা ও জব্দ করা হয়েছে। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতে আড়াইহাজার থানায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ভাই ভাই স্টোরের মালিক গফুর ভূঁইয়া হতাহত ১২ জনের বিরুদ্ধে একটি ডাকাতি মামলা এবং এসআই আবদুল্লাহ আল মামুন অজ্ঞাত কয়েক হাজার মানুষকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।