ঘাটে ঘাটে টাকা দিয়েই কীটনাশক অনুমোদন

অপরাধ তথ্যচিত্র ডেস্ক:ফসল সুরক্ষায় চাষির নির্ভরতা বালাইনাশক। সেই ভরসা পুঁজি করে দেশে এখন ১৫ হাজার কোটি টাকার কীটনাশকের বাজার। আমদানিনির্ভর এত বড় কৃষি রাসায়নিকের বাজার ঘিরে দাঁড়িয়ে গেছে শক্তপোক্ত সিন্ডিকেট। বালাইনাশক বিদেশ থেকে উড়িয়ে আনার আগে নানা গণ্ডি পেরোনোর বিধান থাকলেও তা মানার বালাই নেই। টাকা ঢাললেই দিনকে রাত করে দেয় এই চক্র! যে কেউ আনতে পারে ‘বিষের বোতল’।অভিযোগ আছে, সিন্ডিকেট সব নিয়মনীতিকে ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ বানিয়ে অবৈধ উৎস থেকে কীটনাশক আমদানি করে প্রান্তিক কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ করছে। এতে একদিকে যেমন সরকার বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে নিম্নমানের বালাইনাশক ব্যবহার করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষক।এসব কীটনাশক চাষি কিংবা পরিবেশের বারোটা বাজালেও তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। দেশে কীটনাশক আমদানি এবং পরে তা বিক্রি ও ব্যবহারের জন্য নিবন্ধন দেয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং। অথচ এই উইংয়ের কতিপয় কর্মকর্তাই কাটছেন ঘরের বেড়া! ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও থেমে নেই তাদের ধুন্ধুমার দুর্নীতি। উল্টো ঘুষের টাকার অঙ্ক বেড়েছে। এখনও টাকা দিয়েই মিলছে নিবন্ধন কিংবা পণ্য আমদানির অনুমতি। সমকালের অনুসন্ধানে মিলেছে এসব তথ্য। টাকা দিলে সবই সম্ভব
কীটনাশকের নিবন্ধন ও তদারকির দায়িত্বে থাকা উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং বলছে, যে কোনো কীটনাশক আমদানি করতে লাগবে নিবন্ধন। নিবন্ধিত ব্র্যান্ড ছাড়া কোনো কীটনাশক আমদানি, বিক্রি বা মজুতের সুযোগ নেই। উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ছাইফুল আলম। তিনি দাপ্তরিক নানা কাজে ব্যস্ত থাকায় এই উইংয়ে সময় দিতে পারেন না। ফলে উইং ঘিরে নানা অপকর্মের মজমা বসেছে। কীটনাশকের নিবন্ধন নিতে পিয়ন থেকে শুরু করে সব টেবিলেই ছাড়তে হয় টাকা। অনুসন্ধানে সমকাল জানতে পেরেছে, উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের উপপরিচালক (বালাইনাশক প্রশাসন) মো. নূরে আলম সিদ্দিকী, অতিরিক্ত উপপরিচালক (বালাইনাশক প্রশাসন) মো. হাসিনুর রহমান, পেস্টিসাইড রেগুলেশন অফিসার শফি উল্যাহর নেতৃত্বেই চলছে এসব অনিয়ম। কীটনাশক আমদানির অনুমতিপত্র বের করে আনতে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীকে কোন ঘাটে কত টাকা ঢালতে হয়, সেটির পথনকশা পেয়েছে সমকাল। প্রথমে অফিস পিয়নের সঙ্গে গড়তে হয় সখ্য। একটি ফাইল জমা দিতে হলে পিয়নের হাতে গুঁজতে হয় ৫০০ থেকে হাজার টাকা। এরপর পেস্টিসাইড রেগুলেশন অফিসার শফি উল্যাহর কাছে ফাইল জমা দিতে দিতে লাগে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা। সইয়ের জন্য সেই ফাইল যায় উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের উপপরিচালক (বালাইনাশক প্রশাসন) মো. নূরে আলম সিদ্দিকীর টেবিলে। তাঁর হাতে দিতে হয় ১০ হাজার। একই অঙ্কের টাকা পকেটে তোলেন অতিরিক্ত উপপরিচালক (বালাইনাশক প্রশাসন) মো. হাসিনুর রহমানও। এর বাইরে ফাইলের পেছনে প্রতি টেবিলে দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা গুনতে হয় সংশ্লিষ্ট আমদানিকারককে। এখানেই শেষ নয়, একটি পণ্যের নিবন্ধনের জন্য মো. হাসিনুর রহমানকে ৫ হাজার, মো. নূরে আলম সিদ্দিকীকে দিতে হয় ১০ হাজার টাকা। নিবন্ধন সই করে বালাম বইয়ে লেখার জন্য গুনতে হয় হাজার টাকা। এরপর সনদের জন্য আরও দুই হাজার।একটা সময় ধরাবাঁধা ছিল না ঘুষের অঙ্ক। এখন টাকার অঙ্ক নির্ধারণ করে দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কোনো কোম্পানি নিবন্ধনের জন্য গেলে চক্রের সদস্যরা আগেই ‘কত লাগবে’ বলে দিচ্ছে।নিয়ম অনুযায়ী একটি পণ্যের অনুমোদনের জন্য কর্মকর্তাদের কারখানা পরিদর্শনের নিয়ম আছে। আগে কারখানা পরিদর্শনে গেলে কর্মকর্তাদের ১০ হাজার টাকা দিলেই কাজ হয়ে যেত, এখন ২০ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে।একটি কোম্পানির কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, এক সময় উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের এক টেবিলে টাকা দিলেই কাজ হয়ে যেত। এখন টেবিলে টেবিলে টাকা ফেলতে হয়। নতুন-পুরোনো কর্মকর্তা মিলে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। এই ব্যবসায়ীর অভিযোগ, তিনটি পণ্য আনতে হলে সব মিলিয়ে এক থেকে দেড় লাখ টাকা ঘুষ লাগে। যত ভালো পণ্যই হোক, ঘুষ মাফ নেই।উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের অনিয়ম নিয়ে একটি ফোন রেকর্ড সমকালের হাতে এসেছে। সেখানে এক ব্যবসায়ী বলছিলেন, ‘একসময় উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ে কীটনাশকের অনুমোদন নিতে অল্প কিছু ঘুষ দিলেই কাজ হয়ে যেত। এখন রেট বেঁধে দিয়েছে। তিনটি কীটনাশক আনতে গেলে লাখ টাকা লেগে যায়। গণঅভ্যুত্থানের পরও এমন পরিস্থিতি থাকলে আমরা ব্যবসা কীভাবে করব? এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’ ফোনের অন্য প্রান্তে আরেক ব্যবসায়ী বলেন, ‘ওরা যা চায়, আমি তা দিয়ে দিচ্ছি। কারণ আমার ব্যবসা করা দরকার। ওদের সঙ্গে ভেজাল করে লাভ নেই।’উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের অতিরিক্ত উপপরিচালক (বালাইনাশক প্রশাসন) মো. হাসিনুর রহমান অভিযোগের বিষয়ে বলেন, ‘আমি এখানে নতুন এসেছি। আমার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ মিথ্যা। কেউ অভিযোগ করলেই হবে না। এটার প্রমাণ লাগবে। আমাদের এখানে একটা অভিযোগ বক্স আছে। কেউ যদি হয়রানির শিকার হন, তাহলে অভিযোগ বক্সে লিখিত দিতে পারেন।’অভিযুক্ত উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের উপপরিচালক (বালাইনাশক প্রশাসন) মো. নূরে আলম সিদ্দিকী ও পেস্টিসাইড রেগুলেশন অফিসার শফি উল্যাহর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে সমকাল। গতকাল শনিবার রাতে তাদের দু’জনের মোবাইল নম্বরে কয়েকবার ফোন দিলেও সাড়া দেননি।এ ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং পরিচালক মো. ছাইফুল আলম বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর আমরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে দুর্নীতিমুক্ত করতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছি। তবে উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ে দুর্নীতি হচ্ছে, তা আমি আগেই খবর পেয়েছি। ব্যবসায়ীদের বলেছি, কেউ টাকা চাইলে যেন আমার কাছে সরাসরি আসে। যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তাদের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।বিষে নীল কৃষক
কর্মকর্তাদের অনিয়মের কারণে বাজারে কীটনাশকের দাম লাফাচ্ছে। আবার নিম্নমানের কীটনাশকে ক্ষতির মুখে পড়ছেন কৃষক। আমদানির চেয়ে তিন থেকে চার গুণ দামে বিক্রি করছেন অধিকাংশ আমদানিকারক। এতে কৃষকের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। এর প্রভাব পড়ছে বাজারে। আর কৃষক ঠকিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন সংশ্লিষ্টরা।পাবনার এক লিচুচাষি সমকালকে বলেন, ‘গত বছরে পোকা দমনে কীটনাশক কিনে লিচু গাছে দিয়েছিলাম। কয়েকবার দেওয়ার পরও পোকা যায়নি। এক পর্যায়ে রাগে এক বোতল কীটনাশক নিজের মুখে ঢেলেছি। কীটনাশক খাওয়ার পরও আমার সমস্যা হয়নি।’ ধানের বাদামি গাছ ফড়িং, সবজির ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা, জাব পোকা, সাদা মাছি এবং বিভিন্ন ধরনের শোষক পোকা দমনে ব্যবহার করা হয় ‘মানিক ২০ এসপি’ নামে একটি বালাইনাশক। বিদেশ থেকে এটি প্রতি কেজি কেনা হচ্ছে ৬৯৬ টাকায়। আমদানি খরচ, পরিবহন, প্যাকিং খরচ, অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন, বাজারজাতসহ সব মিলিয়ে প্রতিটি পণ্যে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ খরচ হয়। সে হিসাবে ৬৯৬ টাকার পণ্যে সর্বোচ্চ ২৪৪ টাকা খরচ হতে পারে। আর লাভ ১২ শতাংশ হিসাবে ১১২ টাকা। সব মিলিয়ে পণ্যটি কৃষকের কাছে ১ হাজার ১৫৬ টাকায় বিক্রি করা উচিত। তবে নেওয়া হচ্ছে ৩ হাজার ২৪০ টাকা।একইভাবে ১৪৪ টাকায় প্যারাকুয়েট কিনে বিক্রি হচ্ছে ৭২০ টাকায়, ১ হাজার ২০ টাকায় কারটাপ নামের বালাইনাশক কিনে বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৪০০ টাকায়। ম্যানকোজেব মেটাল এক্সিল প্রতি কেজি ৪৩৮ টাকায় কিনে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ১০ টাকায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে দেশে মাত্র ২২টি কোম্পানি কাঁচামাল (সক্রিয় উপাদান) আমদানি করে বালাইনাশক উৎপাদনের অনুমতি পেয়েছে। এর বিপরীতে প্রায় ৭০০টি কোম্পানি ফিনিশড প্রোডাক্ট আমদানি করে সরাসরি বা ফের প্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাজারজাত করছে। অর্থাৎ বালাইনাশকে স্থানীয় উৎপাদনকারীদের অবদান ১০ শতাংশের কম।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে ৭৫০টির মতো বেসরকারি পেস্টিসাইড কোম্পানিকে আমদানির জন্য প্রায় ১২ হাজার ব্র্যান্ড অনুমোদন দিয়েছে। বালাইনাশকের বাজার এখন ১৫ হাজার কোটি টাকার, যার প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। বড় এ বালাইনাশক বাজার স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও আমদানিনির্ভরই রয়ে গেছে। অথচ বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে বিশ্বের বহু দেশেই এখন রপ্তানি করছে। পণ্যটি আমদানিনির্ভর হওয়ায় কৃষকদের জিম্মি করার সুযোগও বেশি।কৃষি উপদেষ্টা যা বললেন
কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, প্রয়োজনের অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার রোধ করতে হবে। কীটনাশকের বিষয়ে কাজ করছে উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং। তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, তা খতিয়ে দেখব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *