থাকছে তিস্তার ক্ষত, প্রস্তুত হচ্ছে ঢাকা
সীমান্ত চুক্তির মতো তিস্তার ক্ষেত্রেও মোদি ম্যাজিকের অপেক্ষায় ছিল ঢাকা। কিন্তু রোববার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ আনুষ্ঠানিকভাবেই জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির চলতি সফরে হচ্ছে না তিস্তা চুক্তি। তবে তিস্তার এ ‘ক্ষত’ নিয়েই প্রস্তুত হচ্ছে ঢাকা। ২২ চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রস্তুতিও চলছে জোরেশোরে।বিশ্লেষকরা বলছিলেন, সীমান্ত চুক্তির ফলে সবাই তিস্তা চুক্তি নিয়ে আশাবাদী হয়েছিল। কিন্তু তিস্তা না হওয়ায় সবাই একটু হতাশ। তবে ভারত বলছে, আশা ফুরিয়ে যায়নি। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর খবর, তিস্তা নিয়ে নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলবেন। পাশাপাশি ভারত এটাও বলেছে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে রাজি করানোর চেষ্টা চলছে তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে। যে কারণে হচ্ছে না তিস্তা চুক্তি : নরেন্দ্র মোদির সরকারের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ রোববার বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর এ সফরে তিস্তা নিয়ে কোনো চুক্তি হবে না। কেননা এ ইস্যুতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সমর্থন লাগবে। একইসঙ্গে তিনি এ-ও বলেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সমর্থন নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। জানা যায়, তিস্তা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি কেন্দ্রকে সমর্থন দেননি। ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন। তিস্তায় সমর্থন দিলে বিরোধীরা ইস্যুটিকে মমতার বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে পারে বলেই তিনি সমর্থন দেননি বলে জানা যায়। পাশাপাশি তার রাজ্যে কেন্দ্র থেকে অনেক বেশি বরাদ্দ পাওয়ার জন্যও মমতা তিস্তা চুক্তির বিরোধিতা করছেন। পশ্চিমবঙ্গের প্রভাবশালী দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদনে সোমবার বলা হয়, বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি কলকাতায় মমতাকে তিস্তা চুক্তির প্রয়োজন বোঝাতে গিয়ে বাকবিতন্ডা করে বসেন। পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়ে। সূত্রের খবর, বৈঠকে মমতার অনড় অবস্থান দেখে দীপু মনি রেগে গিয়ে বলেছিলেন, তিস্তার পানি শুধু আপনাদেরই পানি নয়, আমাদেরও পানি। দরকার হলে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে যাব। দীপুর এ আচরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অসন্তুষ্ট হন। পরের দফায় মন্ত্রিসভায় আর রাখাই হয়নি দীপু মনিকে। ২২ চুক্তি ও সমঝোতা : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক এবং প্রটোকলসহ প্রায় ২২ চুক্তি সইয়ের জন্য চূড়ান্ত করা হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য চুক্তিগুলো হচ্ছে বাণিজ্য, ঋণ, উপকূলীয় জাহাজ চলাচল ও পণ্যের মান পরীক্ষা। সমঝোতা স্মারকের মধ্যে রয়েছে মানব পাচার ও জালনোট প্রতিরোধ, উপকূলীয় রক্ষীদের সহযোগিতা এবং যাত্রীবাহী জাহাজ চলাচল। এছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদন, সামুদ্রিক অর্থনীতি, জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ মোকাবিলা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি নিয়ে বেশ কয়েকটি চুক্তি এভং সমঝোতা স্মারক সইয়ের জন্য চূড়ান্ত করার কাজ চলছে। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সব ইস্যুর সমাধানের অংশ হিসেবে এত চুক্তি ও সমঝোতা একসঙ্গে স্বাক্ষরিত হতে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতিতেই স্বাক্ষরিত হবে সব কূটনৈতিক চুক্তি এবং সমঝোতা। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের ঘোষণাসংবলিত বিনিময়পত্রও রয়েছে। দুই প্রধানমন্ত্রী নিজেরাই স্বাক্ষর করতে পারেন নৌ পথে দুই দেশের জনগণের যোগাযোগসংক্রান্ত একটি প্রটোকলে। মোদির সফরে বাংলাদেশকে নতুন করে ২১৫ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার চুক্তিও সই হবে। বিদ্যমান নৌ প্রটোকল নবায়ন হবে। এ বিষয়টি সম্প্রতি নৌমন্ত্রী শাজাহান খান নিশ্চিত করেছেন। দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি নবায়ন হবে। অভ্যন্তরীণ জলপথে পণ্য পরিবহন চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হবে। সই হবে উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চুক্তি। দুই দেশের মধ্যে আরও বিদ্যুৎ কেনা ও সহযোগিতার জন্য সমঝোতা স্মারক সই হবে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে ইন্টারনেটের গতি ‘ব্যান্ডউইডথ’ বিক্রির চুক্তিও হবে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগ বাড়াতে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্দিষ্ট করে দেয়ার বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে পণ্য ভারতের বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে বাধা দূর করতে দুই দেশের মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থার মধ্যে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। এসবের বাইরে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার সম্পদ আহরণে ব্লু-ইকোনমি খাতে সহযোগিতার জন্য সমঝোতা স্মারক সই হবে। মোদির সফরে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও নতুন বিষয়ের সূচনা করবে দুই দেশ। পাশাপাশি থাকছে মানব পাচার এবং জালনোট প্রতিরোধ ও উভয় দেশের কোস্টগার্ডকে শক্তিশালী করার বিষয়ে পৃথক তিনটি সমঝোতা স্মারক। আখাউড়া-আগরতলা সড়ক উন্নয়ন ও দুটি রুটে আনুষ্ঠানিকভাবে বাস সার্ভিস চালু, পোর্টফলিও বিনিয়োগ, দুই দেশের বেসরকারি খাতের আর্থিক সেবা নিশ্চিত করা, সামরিক যন্ত্রাংশ যৌথভাবে উৎপাদন, বৈদেশিক বিনিয়োগ আর বাণিজ্য সহজীকরণ নিয়ে চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা সইয়ের প্রস্তুতি চলছে। সার্ক ফ্রেমওয়ার্কের মাধ্যমে বিদ্যুৎ আমদানি-রফতানি ছাড়াও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ কেন্দ্র, লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনাল ও বাংলাদেশে রফতানির লক্ষ্যে ভারতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে ভারতের বড় দুটি বেসরকারি গ্রুপের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই হবে। এছাড়া আরও চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হবে জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ মোকাবিলা, শিক্ষা, সংস্কৃতি বিনিময় ইস্যুতে। তিন চুক্তি বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় অনুমোদন : ভারতের সঙ্গে বাস চলাচলবিষয়ক একটি চুক্তি ও দুটি প্রটোকলের খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এর আওতায় কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা ও ঢাকা-সিলেট-শিলং-গৌহাটি রুটে বাস চলাচল করবে। সোমবার সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ চুক্তি ও প্রটোকল অনুমোদন দেয়া হয়। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। ঢাকা-কলকাতা-ঢাকা ও ঢাকা-আগরতলা-ঢাকা রুটের জন্য আগেই চুক্তি হয়েছে জানিয়ে সচিব বলেন, আগে যে কাঠামো অনুসরণ করা হয়েছিল কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা ও ঢাকা-সিলেট-শিলং-গৌহাটি রুটের ক্ষেত্রে একই কাঠামো অনুসরণ করা হচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরকালে এ চুক্তি ও প্রটোকল স্বাক্ষরিত হবে বলেও জানান তিনি। এগ্রিমেন্ট বিটুইন দ্য গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ অ্যান্ড দ্য গভর্নমেন্ট অব দ্য রিপাবলিক অব ইন্ডিয়া ফর দ্য রেগুলেশন অব মোটর ভেহিকেল প্যাসেঞ্জার ট্রাফিক বিটুইন টু দ্য কান্ট্রিজের আওতায় প্রটোকল দুটি প্রণয়ন করা হয়েছে। বাস চালাচলের ক্ষেত্রে দুই দেশকে কোনো ফি দিতে হবে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, প্রটোকলের মধ্যে এ বিষয়ে কিছু বলা নেই। বাস চলাচলের ফলে দুই দেশের মধ্যে কানেক্টিভিটি বাড়বে- উল্লেখ করে সচিব বলেন, এ চুক্তিতে দুই দেশ সমান সুযোগ-সুবিধা পাবে। সবই পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে প্রণীত ও গৃহীত হয়েছে। চুক্তির আওতায় দুই দেশে যাতায়াতকারী যানবাহনের রুট পারমিট, রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট, ফিটনেস সনদ, ইন্স্যুরেন্স পলিসির দরকার হবে। বাস পরিচালনাকারী ও বাসের যাত্রীদের পাসপোর্ট ও মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসাও থাকতে হবে বলে জানান সচিব।