মোরেলগঞ্জে দ্রব্য মূল্যের আকাশ ছোঁয়া দামে দিশেহারা নিম্ন আয়ের মানুষ: কাঁচাবাজার সিন্ডিকেট চক্রের নিয়ন্ত্রণে
এস.এম. সাইফুল ইসলাম কবির বাগেরহাট : বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে বেপরোয় হয়ে উঠেছে কাঁচাবাজার সিন্ডেকেট চক্র। এ চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে পৌর শহরের প্রায় লক্ষাধিক বাসিন্দা। ১৫ সদস্যের এ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রন করেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের বাজার।
তাদের লাগামহীন মুনফার কারনে কয়েকগুন চড়ামূল্যে কাঁচাবাজার ও তরিতরকারি কিনতে বাধ্য হচ্ছেন নিম্ন আয়ের মানুষ এখানকার ক্রেতা সাধারণ। এ চক্রের বিরুদ্ধে যে কেউ মুখ খুললে হেনস্তার শিকার হতে হয়। নিয়মিত মাজার মনিটরিং না থাকায় সংঘবদ্ধ এ চক্রের দৌরাত্ম বেড়েইে চলছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসনকে ম্যানেজ করে দিনের পর দিন কাঁচামাল সিন্ডিকেটের অবৈধ কারবার চলছে। তাই এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কার্যকরী তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ক্ষোভ প্রকাশ করে বেশ
কয়েকজন ভোক্তা বলেন, রাম রাজত্ব কায়েমের মাধ্যমে এরা অল্পতেই আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যাওয়ার মতো বিপুল অর্থ-বৃত্তের মালিক বনেছেন। আর চড়া দামে কাঁচা তরিতরকারি কিনতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে সাধারণ ক্রেতাদের।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিশ্ব ঐতিহ্য পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ পূর্ব সুন্দরবনের উপকূলীয় বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে ও আশপাশের এলাকায় মৌসুমী কাঁচামালের উৎপাদন তেমন নেই। আর চাহিদার তুলনায় উৎপাদন না থাকায় মোরেলগঞ্জ পৌর কেন্দ্রিক নিত্যপণ্যের কাঁচাবাজারকে ঘিরে বিগত কয়েক বছরে গড়ে উঠেছে ১৫ সদস্যের সিন্ডিকেট চক্র। এ চক্রের সদস্যরা হলেন-আব্দুর রশিদ ফকির. হারুনআর রশিদ. তুজাম্বর মেম্বার. আল আমিন নজরুল তালুকদার.রফিক, আলু আলম, ফিরোজ, সুমন, কবির, কামরুল, নজরুল, জাহিদ,নাসির ও কালু।
খুলনা, যশোরের সাতমাইল, আঠারোমাইল, কেশবপুর, সাতক্ষীরার তালা, শাহাদাতপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মোরেলগঞ্জে আসে কাঁচামালের তরিতরকারি।
বিগত কয়েক বছর আগে ওই সকল এলাকা থেকে পাইকাররা এখানে পাইকারি মূল্যে পণ্য সরবরাহ করতেন। কিন্ত নানা প্রভাব বিস্তার ও করসাজি করে কাঁচামাল ও তরিতরকারির বাজার নিয়ন্ত্রনে নেয় স্থানীয় সিন্ডিকেট চক্র।
প্রায় প্রতিটি পণ্যই কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি দাম লিখিয়ে আড়তে মজুদ রেখে খুচরা বিক্রেতাদের সরবরাহ করা হয়। আর খুচরা বিক্রেতারা সিন্ডিকেট চক্রের আড়ৎ থেকে এসব পণ্য নিয়ে কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা বাড়িয়ে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে।
এ ছাড়া সিন্ডিকেট চক্রটি দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে যে পণ্য আনে তা মজুদ রেখে বাজারে কাঁচামালের সংকট তৈরি করে । এ সংকট দেখিয়েই নিজেদের সিন্ডিকেট বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে চক্রটি। সিন্ডিকেট চক্রটি খুচরা বাজারে কোন পণ্য কত টাকায় বিক্রি করা হবে তাও নির্ধারণ করে দেয়। বেঁধে দেয়া দামের কমে কেউ পণ্য বিক্রি করলে তাকে নানা ধরনের হয়রানি ও হুমকি প্রদান করা হয়।
এ ছাড়া গ্রামের গৃহস্থ চাষিরা বাজারে এলে তাদের নিয়মিত বাজারে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। সপ্তাহে সোম ও শুক্রবার-এ ২ দিন গ্রামের কৃষকরা তরকারি বিক্রি করতে দেওয়া হলেও অন্য ৫ দিন তাদের সবজি বিক্রি করা নিষিদ্ধ থাকে। কারণ গ্রামের কৃষকরা কিছুটা কম দামে সবজি বিক্রি করে থাকেন। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় কৃষকরা বাজারে এলে সিন্ডিকেট চক্রটি তাদের মালামাল কেড়ে নিয়ে ইচ্ছামতো দাম ধরিয়ে দিয়ে তাদের বিদায় করে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দ্রব্য মূল্যের আকাশছোঁয়া দামে দিশেহারা হয়ে পড়েছে নিন্মবিত্ত ও নিন্ম আয়ের মানুষেরা। বাজারে কাঁচা মালের মালামালের সরবরাহ ঠিক থাকলেও দিগুণ-তিনগুণ দামে । হু হু করে বাড়েছে পণ্যের দাম। এ চাড়াও বাজার সংশ্লিষ্টদের তদারকি না থাকায় আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে সিন্ডিকেট ব্যাবসায়ীরা।
আলু ৪৫, বেগুন ৯০, কুমড়া ৩৫, ঢেড়শ ৬০, পেঁপে ২৫, কুশি ৫০, পটল ৪০, ঝিঙা ৪০, মুলা ৫০, পাতাকফি ৬০, করলা ৬০, চাল কুমড়া ২০ টাকা, কাচা মরিচ ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
মোরেলগঞ্জ কাঁচাবাজারে সবজি কিনতে আসা রেজাউল হাওলাদার, এইচ এম আসলাম হোসেন, শহিদুল ইসলাম ও সাথী ইসলাম বলেন, সকাল বিকাল নিত্য পণ্যের দাম ওঠা-নামা করে এখানে। সিন্ডেকেটের বেঁধে দেয়া মূল্যে সকল দোকানেই কাঁচামাল বিক্রি হয়। আর বিক্রি না হলে ফেলে দেয়া হয় ড্রেনে । সরবরাহ থাকলেও দাম কমে না।
স্থানীয় আরও বেশ কয়েকজন ক্রেতা বলেন, সিন্ডিকেট আড়তদারদের কারণেই এ বাজারে দাম বেশি। তারা জানান, আশপাশের বাজারের চেয়ে শহরের প্রধান এ বাজারে সবসময় পণ্যের দাম অনেক বেশি নেয়া হয়। স্বল্প দূরত্বে অন্য কোনো বাজার না থাকায় একান্ত বাধ্য হয়ে এ বাজারে চড়া দামে তরকারি কিনতে এসে নাভিশ্বাস উঠে যায় তাদের।
সিন্ডিকেট চক্রটির সদস্যরা সকলেই পৌর বাজারের আড়তদার। এ চক্রটিই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে পুরো বাজার। এদের অনেকেই কাঁচামালের ব্যবসার নামে সিন্ডিকেট করে অল্পদিনেই বিপুল অর্থ, গাড়ি ও বাড়ির মালিক হয়েছে। যখন যে রাজনৈতিক নেতা প্রভাবশালী থাকে তখন তাকে ম্যানেজ করে দিনের পর দিন সিন্ডিকেট ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে চক্রটি। তাই সবসময় ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায় তারা।সবজি বিক্রেতা সাখাওয়াত হোসেন সেন্টু , জাহাঙ্গীর ফরাজি সহ অনেকেই জানান, জানান,গত সপ্তাহের তুলনায় এ সপ্তাহে সবজির দাম একটু বেড়েছে। লম্বা বেগুন ৪০ টাকা, গোল বেগুন ৫০ টাকা, পটল ৫০ টাকা, মুলা ৪০ টাকা, শসা ৪৫ টাকা, কেজিপ্রতি কাঁচা মরিচ ১০০ টাকা, ঢেঁড়স ৫৫ টাকা, লেবুর হালি ২০ টাকা।
বাজার করতে আসা মো. নুরুল আমিন বলেন, সবজির মূল্য আসলে আমাদের হাতে নেই, কিছু করারও নেই। তারা যে দামে দেবে, আমাদের সেই দামে কিনে খেতে হবে। আবার অন্যান্য দিনের তুলনায় আজকে একটু দাম ও বেশি।
পাইকারী বিক্রেতা আব্দুর রশিদ ফকির বলেন, চাহিদার তুলনায় পণ্য সরবরাহ কম তাই গত সপ্তাহের তুলনায় এ সপ্তাহে সবজির বাজারে দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।তবে আগামী মাস থেকে নতুন সবজি আসা শুরু হলে দাম অনেকটা কমে যাবে।
তেল ও চালের দাম স্বাভাবিক থাকলেও মসলা বাজারে জিড়া কেজি প্রতি ১০২০ টাকা,সাদা এলাচ ও কালো এলাচের ও ডিমের দাম ও বৃদ্ধি পেয়েছে।
মাংসের বাজারে ও দাম বৃদ্ধি অব্যহত রয়েছে গরুর মাংস ৭৫০ টাকা, ব্রয়লার মুরগি আকারভেদে কেজিপ্রতি ১৮৫ টাকা, কক মুরগি ৩২০ টাকা কেজি, রুই মাছ ৫০০ টাকা কেজি, দেড় কেজি ওজনের ইলিশ মাছ ২২০০ টাকা কেজি আর ৭০০ গ্রাম ওজনের ১২০০ টাকা কেজি। এছাড়া, নদীর চিংড়ি আকারভেদে ৭০০ থেকে ১০০০ টাকা কেজি।
মাছ কিনতে আসা এক কলেজ ছাত্র শেখ রাহাতুল ইসলাম জয় বলেন, মাছের বাজারে যেভাবে দাম বৃদ্ধি পেয়েছে এতে করে আমাদের বাসার জন্য মাছ কেনা খুবই কষ্টকর।
এ বিষয়ে কথা হয় মোরেলগঞ্জ বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ দেলোয়ার হোসেন বলেন, বাজারে কোন সিন্ডিকেট নেই, সবই উড়ো কথা। তারা পাইকারিতে যে দামে পণ্য কেনেন তার চেয়ে সামান্য বেশি দামে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন।
আর খুচরা বিক্রেতারা বলেন, আড়ত থেকে যে দর দেওয়া হয়, তার চেয়ে সামান্য কিছু লাভে আমরা বিক্রি করে থাকেন। দাম বাড়ানো কিংবা কমানোর বিষয়টি আড়ৎদারদের হাতে । তবে মাঝে মধ্যে বাজার মনিটরিংয়ে স্থানীয় প্রশাসন অভিযানে নামে। তখন দু’একজনকে সামন্য জরিমানা ছাড়া তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না।
এ বিষয় উপজেলা বাজার মনিটরিং কমিটির সভাপতি ও মোরেলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস. এম. তারেক সুলতান বলেন, বাজার মনিটরিংয়ের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ ও নিয়মিত বৈঠক করা হয় যাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায় থাকে। তাছাড়া অভিযোগ উঠলেই অভিযান পরিচালনা ও জরিমানাও করা হয়। এ ছাড়া রশিদের মাধ্যমে ক্রয় বিক্রয়ের জন্য বিক্রেতা ও ক্রেতাদের পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে।