সারা দেশে সেবাপ্রার্থীদের দুর্ভোগ
সাবরেজিস্ট্রারকে মারধর প্রতিবাদে কর্মবিরতি
বিশেষ প্রতিনিধি: অসদাচরণ করায় এবং সেবা না পেয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার সাবরেজিস্ট্রার ইউসুফ আলীকে পিটিয়ে জখম করেছে ক্ষুব্ধ জনতা। মঙ্গলবার শিবগঞ্জ সাবরেজিস্ট্রি কার্যালয়ে প্রবেশ করে জনসাধারণ ও ভুক্তভোগীদের একাংশ তাকে মারধর করেন। দীর্ঘদিন ধরে ঘুস, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়মের কারণে তিনি জনরোষের শিকার হয়েছেন বলে দাবি স্থানীয়দের।
এদিকে ইউসুফ আলীর ওপর হামলার প্রতিবাদে বাংলাদেশ রেজিস্ট্রেশন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের ডাকে সারা দেশের রেজিস্ট্রার ও সাবরেজিস্ট্রি কার্যালয়ে কর্মবিরতি কর্মসূচি শুরু করেছে। এতে দলিলদাতা ও গ্রহীতারাসহ সেবাপ্রার্থীরা চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সাবরেজিস্ট্রার ইউসুফ আলীকে শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। পরে তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে পাঠান চিকিৎসকরা।
রেজিস্ট্রেশন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অহিদুল ইসলাম ও মহাসচিব এসএম শফিউল বারী স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বুধবার বলা হয়, মঙ্গলবার বিকাল ৪টার দিকে দায়িত্ব পালনকালে সাবরেজিস্ট্রার ইউসুফ আলী (৪০) লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন।
শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবুল হায়াতের উসকানি ও নির্দেশে কয়েকজন দুষ্কৃতকারী হকিস্টিক ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তার ওপর হামলা করে। এতে ইউসুফ মারাত্মকভাবে আহত হন।
এ সময় তার মোবাইল ফোনও ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ইউএনওর এমন ন্যক্কারজনক ঘটনায় বাংলাদেশ রেজিস্ট্রেশন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে। এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার না হওয়া পর্যন্ত নিবন্ধন অধিদপ্তরের আওতাধীন সারা দেশের জেলা রেজিস্ট্রার ও সাবরেজিস্ট্রি কার্যালয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতি কর্মসূচি পালন করা হবে।
তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে ইউএনও আবুল হায়াত বলেন, শিবগঞ্জ সাবরেজিস্ট্রি কার্যালয়ের প্রয়াত কর্মচারীর প্রতিবন্ধী মেয়ের পেনশনের দাবির আবেদন নিয়ে দুপুরে সাবরেজিস্ট্রার ইউসুফ আলীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম।
ওই সময় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানসহ উপজেলা পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তাও ছিলেন। এ সময় সাবরেজিস্ট্রার ইউসুফ আলী অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। আমি এর প্রতিবাদ করেছি। এ নিয়ে কথাকাটাকাটি হয়।
দুপুর ১টা থেকে দেড়টার মধ্যে এ ঘটনা ঘটে। কিন্তু বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে তার (সাবরেজিস্ট্রার) ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। বিষয়টি জানতে পেরে তাৎক্ষণিক পুলিশকে খবর দিয়েছি। পুলিশ তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
ইউএনও আবুল হায়াত আরও বলেন, ইউসুফ আলীর ওপর হামলার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। ওই কার্যালয়ের নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে ক্ষুব্ধ ভুক্তভোগীরা হামলা চালিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্যই আমাকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে।
শিবগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা চৌধুরী জুবায়ের আহমেদ জানান, হামলার সময় দলিল লেখক, নকলনবিশ ও জমিসংক্রান্ত কাজে আসা সাধারণ মানুষজন ছিলেন। কে বা কারা সাবরেজিস্ট্রার ইউসুফ আলীর ওপর অতর্কিত হামলা করেছে, সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ সময় সাবরেজিস্ট্রারের অফিসকক্ষও ভাঙচুর করা হয়। সাবরেজিস্ট্রার ইউসুফ আলীর বিরুদ্ধে সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের নানা অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে শিবগঞ্জ সাবরেজিস্ট্রার ইউসুফ আলীর ওপর হামলার প্রতিবাদে বুধবার থেকে সারা দেশে রেজিস্ট্রার ও সাবরেজিস্ট্রি কার্যালয়ে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি পালিত হচ্ছে। দলিল রেজিস্ট্রিসহ সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এতে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
রাজশাহী ব্যুরো জানায়, শিবগঞ্জ সাবরেজিস্ট্রি অফিসের এক কর্মচারী অবসরে যাওয়ার পর মারা যান। এরপর তার প্রতিবন্ধী মেয়ের অনুকূলে পেনশনের টাকা দিতে তার স্ত্রী সাবরেজিস্ট্রার ইউসুফ আলীর কাছে যান। এজন্য তাকে অতিরিক্ত টাকা দেওয়া হলেও তিনি ১৫ মাস ধরে তা সুরাহা করেননি। উলটো অশালীন আচরণ করা হয়।
সাবরেজিস্ট্রার ইউসুফ আলীর ওপর হামলার বিষয়ে স্থানীয়রা জানান, শুধু ওই নারীই নন, বেশিরভাগ সেবাপ্রার্থীর সঙ্গে ইউসুফ আলী এমন আচরণ করেন। দলিল লেখকদের সঙ্গেও তার অসদাচরণ করার অভিযোগ রয়েছে। এসব কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে স্থানীয়রা তার ওপর হামলা চালিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে সাবরেজিস্ট্রার ইউসুফ আলীর ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে শিবগঞ্জ থানার ওসি চৌধুরী জোবায়ের আহমেদ বলেন, খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ উপস্থিত হয়ে সাবরেজিস্ট্রার ইউসুফ আলীকে জনতার রোষ থেকে উদ্ধার করে। এ ব্যাপারে কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, সাবরেজিস্ট্রারকে নির্যাতন ও মোবাইল ফোন ছিনতাইয়ের প্রতিবাদে রূপগঞ্জের সাবরেজিস্ট্রি অফিসে কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। সাবরেজিস্ট্রি কার্যালয় জানায়, ঘটনার উপযুক্ত বিচার না হওয়া পর্যন্ত কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।
এতে দলিলদাতা ও গ্রহীতারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। জমি রেজিস্ট্রি করতে আসা আলামিন মিয়া বলেন, আমাদের দলিল রেজিস্ট্রি হওয়ার কথা ছিল। এ দলিলের দাতা-গ্রহীতা অন্তত ৪০ জন। তাদের মধ্যে বৃদ্ধও রয়েছেন।
তারা অনেক কষ্ট করে এসেছেন। আগে থেকে ঘোষণা দিলে কষ্ট করে দাতা-গ্রহীতারা আসতেন না। সাবরেজিস্ট্রার আবু তাহের মোহাম্মদ মোস্তফা বলেন, সুষ্ঠু বিচার না হওয়া পর্যন্ত দলিল রেজিস্ট্রি বন্ধ থাকবে।
এছাড়া সাবরেজিস্ট্রারকে মারধর করার ঘটনায় শরীয়তপুর, জামালপুর, চট্টগ্রামের চন্দনাইশ, ব্রা?হ্মণবাড়িয়ার কসবা, ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ, নাটোরের বাগাতিপাড়াসহ দেশের বিভিন্ন সাবরেজিস্ট্রার অফিসে রেজিস্ট্রেশন অ্যাসোসিয়েশন কর্মবিরতি পালন করছে। হামলার সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত বিচার ও সাবরেজিস্ট্রি অফিসের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার দাবিতে তারা এ কর্মসূচি পালন করছেন।