‘ওয়েলকাম! আপনার মোবাইল নম্বর পাঁচ লক্ষ টাকা জিতেছে!’
‘ওয়েলকাম! অমুক কোম্পানির পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগত। আপনার নম্বরটি আমাদের লটারিতে উঠেছে। আপনি জিতেছেন নগদ পাঁচ লক্ষ টাকা।’
ডিসপ্লের নম্বরটা বেশ দারুন। +88****222333444 একসঙ্গে অনেকগুলো সংখ্যা পর পর সাজানো। এমন ভিআইপি নম্বর সাধারণ মানুষের থাকে না। এ নিশ্চয়ই বড় কোনও কোম্পানির! গলার স্বর বদলে গেল কল রিসিভকারীর।
‘তাই নাকি! কিভাবে কী করতে হবে ভাই!’
‘তেমন কিছুই করতে হবে না স্যার। আমাদের কোম্পানির কিছু ফরমালিটিস আছে। আপনার লটারির মোট টাকার টু পারসেন্ট ট্যাক্স, সার্ভিস চার্জ, এগুলো অ্যাডভান্স করতে হবে।’
‘ওহ আচ্ছা। বলুন কিভাবে পেমেন্ট করবো!’
ব্যস এটুকু বলা মানেই শিকার টোপ গিলেছে বুঝতে হবে। এবার মওকা বুঝে ধীরে ধীরে টান দিলেই উঠে আসবে টাকা। মোট টাকার দুই তিন কিংবা পাঁচ শতাংশ ট্যাক্স আর সার্ভিস চার্জের নামে চাওয়া হবে বড়জোর পাঁচ দশ হাজার টাকা। পাঁচ লাখ টাকার লোভে সেই পাঁচ-দশ হাজার তো তখন কিছুই না।
মোবাইলে প্রতারণার এ নয়া কৌশলের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ওয়েলকাম’। স্বাগত জানিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। প্রতারিত যিনি হয়েছেন, তার বুঝতেও বেশ খানিকটা সময় লাগবে। বুঝতে পারার পরও সাধারণত কিছু না করে খানিক্ষণ নিজের চুল ছিড়েই ইস্তফা দেন। কারণ অনিবন্ধিত সিমের কারণে প্রতারক ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে, এমনটা ভেবে অনেকেই আছেন আর থানা-পুলিশে যেতে চান না। তা ছাড়া যা গেছে তা তো গেছে, নতুন করে ‘অত ঝামেলা’য় কে জড়াবে কিংবা বন্ধুবান্ধবরাও জানলে হাসবে; এতসব ভেবেও চেপে যান নিজের বোকামি।
এ কৌশলেই দেশের সহজ-সরল মানুষগুলোর কাছ থেকে লটারির লোভ দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারকচক্র। বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা প্রতারকচক্রের সদস্যদের গ্রেফতার করলেও আইনের ফাঁকে বেরিয়ে যায় তারা। অগত্যা সচেতনতাই মোক্ষ। প্রতারক চক্রের প্রলোভনে সাড়া না দিতে সাধারণ মানুষদের আহ্বান জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা।
সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেওয়া প্রতিবেদনে বলেছে, এক শ্রেণির প্রতারক চক্র বিভিন্ন নম্বর থেকে ফোন করে সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ওই প্রতিবেদনে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে প্রতারণার কিছু ধরনও উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ টেলিরেগুলেটরি কমিশনকেও (বিটিআরসি) চিঠি দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, কিছু অসাধু ব্যক্তি বা চক্র বিভিন্ন মোবাইল ফোন অপারেটরের কলসেন্টারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার পরিচয় দিয়ে সাধারণ গ্রাহকদেরকে ফোন করে বলে, তার ব্যবহৃত নম্বরটি লটারিতে লাকি নম্বর হয়েছে। যার বিনিময়ে আছে লাখ টাকা, গাড়ি, বাড়ি কিংবা সমপরিমাণ অর্থ। তারপর যথারীতি পুরস্কার পেতে ট্যাক্সসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতার কথা বলা হয়। আর সেই টাকা পাঠাতে বলা হয় ফ্লেক্সিলোড বা বিকাশ-এ। এখানেই শেষ নয়। এরপর প্রতারকচক্র বিভিন্ন ডায়াল কোড বা নম্বর উল্লেখ করে তাতে ডায়াল করতে বলে। ওই নম্বরে ডায়ালের মাধ্যমে গ্রাহকের ফোনটি স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে গ্রাহকের কাছে প্রতারকের আর কোনও তথ্যও থাকে না। এ প্রতারণার শিকার হয়ে বাড়িঘর ও জমিজমা বিক্রি করে নিঃস্ব হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে!
সর্বশেষ গত ২৯ এপ্রিল র্যাবের অভিযানে মোবাইল ফোনে প্রতারণাকারীদের একটি চক্র ধরা পড়লে বেরিয়ে আসে নিত্যনতুন কৌশল।
র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের উপ-পরিচালক মেজর মাকসুদুল আলম জানান, চক্রটির প্রথম গ্রুপ বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরের সার্ভিস সেন্টার থেকে একই ডিজিটের ভিআইপি সিম সংগ্রহ করে নিজেদের নামে রেজিস্ট্রেশন করে। পরে এ চক্রটি অন্য প্রতারক চক্রের কাছে উচ্চ দামে ওই সিম বিক্রি কিংবা ভাড়া দেয়। সিম সংগ্রহকারী ও প্রতারক চক্রের সঙ্গে আর্থিক ব্যাপারে বনিবনা না হলে ওই নম্বরটির সংযোগ বিছিন্ন করে আবার নিজের নামে একই নম্বরের সিম সংগ্রহ করে।
মাকসুদুল আলম জানান, মোবাইলে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার এ কৌশলটা চক্রগুলোর কাছে ‘ওয়েলকাম’ নামে পরিচিত। টাকা হাতানোর পর প্রতারচক্র নিজের ব্যক্তিগত নম্বরে বিকাশে টাকা নিয়ে নিজের এলাকার বাইরে গিয়ে এজেন্টের কাছ থেকে টাকা উঠিয়ে নেয়।
গত ২ ফেব্রুয়ারি সাভার থানার ডগরমোড়া গ্রামের একজন নারীকে প্রতারক চক্র গ্রামীণফোনের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে লটারি জেতার কথা বলে। পরে তার কাছ থেকে ট্যাক্স, ভ্যাট ও সার্ভিস চার্জের নামে নানা অজুহাতে লটারির টাকা দেওয়ার নাম করে তিন লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। একইভাবে গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের জনৈক সংগীত শিল্পীর নিকট থেকে মাসুদ রানা নামের একজন কল সেন্টার কর্মী পরিচয় দিয়ে তিন লাখ ছাব্বিশ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। এ ছাড়াও সাভার সেনানিবাসের আরেক ব্যক্তির কাছ থেকে দুই লাখ বিরানব্বই হাজার টাকা ও বারিধারা বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একজনের কাছ থেকে ৩৮ লাখ টাকা টাকা হাতিয়ে নেয়। প্রতারিতরা লোকলজ্জার ভয়ে নিজের পরিচয় দিতেও অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। তারা র্যাবের কাছে অভিযোগ করলে র্যাবের গোয়েন্দা ইউনিট এ চক্রের সন্ধানে মাঠে নামে।
র্যাবের এই কর্মকর্তা আরও জানান, এ ধরনের একটি প্রতারকচক্রের একটি গ্রুপে চার থেকে পাঁচজন জড়িত থাকে। তারা নিজেদের পারদর্শিতার বিচারে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির বিভিন্ন উচ্চপদের কর্মকর্তা সেজে প্রতারিত ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে। প্রতারিত ব্যক্তিকে তার নম্বর এবং পুরস্কারের নিরাপত্তার জন্য পুরস্কার প্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত কাউকে না জানাতে পরামর্শ দেয় তারা।
এ চক্রের অপর একটি গ্রুপ আরও উচ্চ প্রযুক্তির সহায়তায় সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে বিকাশ এজেন্টদের সংশ্লিষ্ট অপারেটর এবং সংশ্লিষ্ট নম্বর থেকেও ফোন করে বিকাশ এজেন্টদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। প্রতারণার এ মাধ্যমটি এখনও সীমিত হলেও জনসচেনতা না বাড়লে এটিও বিস্তার লাভ করবে বলে জানান মেজর মাকসুদ।
গোপন সংবাদ পেয়ে র্যাব-৪ এর একটি দল গত ২৯ এপ্রিল বুধবার সাভারের হেমায়েতপুরে অভিযান চালায়। সেখানকার বাসস্ট্যান্ডের কাছে গাজী আশরাফ শপিং কমপ্লেক্সের সামনে থেকে এবং সাভারের উলাইল বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে গত বৃহষ্পতিবার রাতে অভিযান চালিয়ে প্রতারণাকারী চক্রের ১০ সদস্যকে গ্রেফতার করে। তাদের কাছ থেকেই প্রতারণার এসব কৌশল জানতে পারে র্যাব।