পাইকগাছা কয়রায় করোনা ভাইসারে কাঁকড়া, কুচিয়া এবং বাগদার পোনা সংকটে রপ্তানিমূখী অর্থনীতি ধ্বংসের মূখে

প্রমথ সানা, পাইকগাছা: পাইকগাছা-কয়রায় বিভিন্ন কারণে রপ্তানীমূখী অর্থনীতিতে ধস নেমেছে। এ অঞ্চলের উৎপাদিত রপ্তানিমূখী বাগদা,কাঁকড়া এবং কুচিয়া এই তিনটি খাতের মাছ বিদেশে পাঠিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি কে শক্তিশালী করতে ভূমিকা রেখে আসছে। মুলত এই তিনটি খাতের উপর এলাকার অধিকাংশ মানুষের রুটিরুজি নির্ভরশীল। পাইকগাছার কাঁকড়া ৯০% এবং কুচি মাছ ১০০% চীনে রপ্তানী হতো। বর্তমানে প্রাণঘাতী নতুন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে বিদেশে এই জাতীয় মাছ নিষিদ্ধ হওয়া বিশেষ করে চীনে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ব্যাপক ক্ষতির সম্মূখীন হচ্ছে।
বিভিন্নসূত্রে জানা যায়, অঞ্চলটি সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকা হওয়ায় এলাকার চিংড়ি, কাঁকড়া ও কুঁচিয়া উৎপাদনের জন্য অত্যান্ত সমৃদ্ধ। এখানকার উৎপাদিত শিলা কাঁকড়া সুস্বাদু হওয়ায় বিদেশে প্রচুর চাহিদা রয়েছে। উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা পবিত্র কুমার দাস জানান, অত্র উপজেলায় ২শ হেক্টরে শুধুমাত্র কাঁকড়া এবং ১৭ হাজার হেক্টর মিশ্র ঘের থেকে কাঁকড়া উৎপাদন হয়ে থাকে। অনুরূপভাবে এসব উৎস থেকে কুচিয়াও উৎপাদন হয়। উপজেলা মৎস্য দপ্তরের সূত্রমতে, অত্র এলাকা থেকে গত বছর ৪ হাজার ১শ মেট্রিক টন কাঁকড়া ও ৩শ মেট্রিক টন কুচিয়া উৎপাদন হয়। উৎপাদিত কাঁকড়া ও কুচিয়া চীন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও হংকং সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। যার মধ্যে ৯০ ভাগ কাঁকড়া শুধুমাত্র চীনেই রপ্তানি হয়। মাস দুই আগে চীনে করোনা ভাইরাস দেখা দেওয়ায় গত ২৫ জানুয়ারী থেকে বাংলাদেশ থেকে চীনে কাঁকড়া ও কুচিয়া রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বিপাকে পড়েন অত্র এলাকার সরবরাহকারী, ব্যবসায়ী, খুচরা বিক্রেতা ও উৎপাদনকারী চাষীরা। প্রায় দুই মাস রপ্তানি বন্ধ থাকায় ধস নেমেছে কাঁকড়া ও কুচিয়া ব্যবসায়। অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে অলস সময় পার করছে ব্যবসায়ীরা। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান চালু রাখলেও সরবরাহ ও কেনা-বেচা নেই বললেই চলে। দামও নেমে এসেছে কয়েকগুণ। মূলত ৪টি গ্রেডে স্ত্রী কাঁকড়া এবং ৫টি গ্রেডে পুরুষ কাঁকড়া বিক্রি হয়ে থাকে। গ্রেড অনুযায়ী দামও কমবেশি হয়ে থাকে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকাকালীন সময়ে ২১০ গ্রামের ডবল এফ-১ স্ত্রী কাঁকড়ার কেজি প্রতি মূল্য ছিল ১৬শ থেকে ২ হাজার। যা নেমে এসেছে ৫শ টাকায়। ৫শ গ্রাম ওজনের ডবল এক্স এল পুরুষ কাঁকড়ার কেজি প্রতি মূল্য ছিল ১১-১২শ টাকা। যা বর্তমানে চলছে ৫শ টাকা।
এদিকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বাগদার ও যথেষ্ঠ ভূমিকা রয়েছে।কিন্তু পাইকগাছায় – কয়রায় মৌসুমের শুরুতেই বাগদার পোনা সংকটের কারণে ঘের ব্যবসায়ীরা সময়মত বাগদা পোনা ছাড়তে পারছে না।ফলে প্রতিদিন চাহিদার তুলনায় ঘাটতি থাকছে ৩ থেকে সাড়ে ৩ কোটি পোনা। প্রতিদিন ৫ কোটি পোনার চাহিদার স্থলে সরবরাহ মিলছে এক থেকে দেড় কোটি। সরবরাহ কম থাকায় গত বছরের চেয়ে এ বছর পোনার দাম বেড়েছে অনেক বেশি। বর্তমানে পোনা নিয়ে মহাবিপাকে রয়েছেন ঘের প্রস্তুতকারী চিংড়ি চাষীরা। প্রাকৃতিক উৎস থেকে পোনা আহরণ বন্ধ, স্থানীয় হ্যাচারীতে সরবরাহ না থাকা, কক্সবাজারের হ্যাচারীর কম সরবরাহ ও প্রয়োজনীয় মা চিংড়ির অভাবে এ ধরণের পোনা সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট পোনা ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
তথ্যানুসন্ধানে আরও জানা যায়, উপকূলীয় পাইকগাছা ও কয়রা উপজেলা চিংড়ি চাষের জন্য সমৃদ্ধ এলাকা হিসেবে বিবেচনা। মৎস্য দপ্তরের সূত্র অনুযায়ী পাইকগাছায় প্রায় ২০ হাজার হেক্টর এবং কয়রা উপজেলায় ৫ হাজার হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ হয়ে থাকে। প্রতিবছর জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী মাসে ঘের গুলো নতুনভাবে প্রস্তুত করে চাষ শুরু করা হয়। ইতোমধ্যে এলাকার অর্ধেকেরও বেশি ঘের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে।
সাধারণত শীত শেষে গরমের শুরুতে সব চাষীদের ঘের প্রস্তুত সম্পন্ন করে ঘেরে পোনা মজুদ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কিন্তু চাহিদার তুলনায় সরবরাহ না থাকায় চিংড়ি পোনার তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। প্রতিদিন অসংখ্য চিংড়ি চাষী পোনা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানে এসে পোনা না নিয়েই ফিরে যাচ্ছেন। সকালে কক্সবাজারের পোনা এলাকায় পৌছানোর পর পোনা নেওয়ার জন্য সরবরাহকারী এজেন্টদের নিকট ভীড় জমাচ্ছে চাষীরা।
সবুজ মৎস্য খামারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলহাজ্ব ইসতিয়ার রহমান জানান, মৌসুমের শুরুতেই চিংড়ি পোনা নিয়ে বিপাকে রয়েছি। ঘের প্রস্তুত করার পরও প্রতিদিন যে পোনার প্রয়োজন তা একমাসেও মেলাতে পারছি না। শুরুতেই এ ধরণের পোনা সংকট থাকলে উৎপাদনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।
পাইকগাছার বিশিষ্ট্য ব্যবসায়ী মোঃ দাউদ শরীফ জানান, ঘের ব্যবসায়ীরা অন্যের জমিতে হারি দিয়ে ঘের নিয়ে প্রোসেসিং করে পানি উঠায়ে বসে আছে,পোনা দিতে পারছে না। এ বিষয়ে যদি দ্রুত সমাধান না হইলে আমরা ঘের মালিকরা দেউলিয়া হয়ে যাবো। এ ব্যাপারে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
খুলনা বিভাগীয় পোনা ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক, পুরস্কার প্রাপ্ত চিংড়ি চাষী ও হ্যাচারী মালিক গোলাম কিবরিয়া রিপন জানান, পোনা ব্যবসায়ীদের নিকট জানতে চাইলে বলেন, মাদার সংকটের কারণে প্রোডাকশন বিপর্যয়। দ্রুত এ বিষয়ে নিস্পত্তি করতে না পারলে আরও বিপর্যয়ের সম্ভাবনা আছে। এব্যাপারে নাম প্রকাশে অনেচ্ছুক একজন পোনা ব্যবসায়ী জানান, পোনার কৃত্রিম সংকটের কারণে রপ্তানীমূখী বাঁধা গ্রহস্ত হচ্ছে। পোনা ব্যবসায়ীরা এবং উৎপাদনকারী উভয় সেন্ডিকেড করে পোনার দাম বাড়াচ্ছে এমনও অভিযোগ অনেকেই করেছেন। অদৃশ্য কারণে ২০০টাকার বাগদা পোনার হাজার এখন ১হাজার টাকা দিয়েও পাওয়া দুষ্কর।
বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য সূত্রে জানা যায়, সারা দেশে ডিসেম্বর মাসে কাঁকড়া ৩৪ মেট্রিকটন রপ্তানিতে বৈদেশিক মুদ্রা .৫১১ মিলিয়ন ইউএস ডলার এবং কুচিয়া ১৪২৮মেট্রিকটন রপ্তানিতে ৩.৭১মিলয়ন ইউএস ডলার অর্জন করে।সেখানে জানুয়ারী ও ফেব্রুয়ারি মাসে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন তলানিতে ঠেকেছে। সিনিয়ার মৎস্য কর্মকর্তা পবিত্র কুমার দাসের সাথে আলোচনা ক্রমে জানান,চাষীরা উৎপাদন করলেও বাজারে চাহিদা না থাকায় তারা রপ্তানি করতে পারছে না। তবে তিনি আশা করেন-খুব দ্রুত এ সমস্যার সমাধান হবে। সর্বশেষ এনওসি’র কারণে কাঁকড়া, কুঁচিয়া রপ্তানী বন্ধ রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *