বাসদের নির্বাচনী ইশতেহার
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে ‘মই’ প্রতীকে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ। ইশতেহারে বাসদ মনোনীত প্রার্থীদের ‘মই’ প্রতীকে ভোট দিয়ে ও ভোটের খরচ যুগিয়ে গণআন্দোলনের শক্তি বৃদ্ধি ও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শামিল হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। শনিবার (২২ ডিসেম্বর) সেগুনবাগিচাস্থ স্বাধীনতা হলে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ ইশতেহার ঘোষণা করেন বাসদের সাধারণ সম্পাদক কমরেড খালেকুজ্জামান। এসময় উপস্থিত ছিলেন- বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড বজলুর রশীদ ফিরোজ, রাজেকুজ্জামান রতন, ঢাকা-৭ আসনের প্রার্থী খালেকুজ্জামান লিপন, ঢাকা-৮ আসনের প্রার্থী শম্পা বসু, ঢাকা-১৭ আসনের প্রার্থী এস. এম. আহসান হাবিব বুলবুল, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের প্রার্থী আবু নাঈম খান বিপ্লব প্রমুখ।
ইশতেহার যা রয়েছে:
রাজনৈতিক, গণতন্ত্র-সুশাসন, রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য, স্বশাসিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা, অসম্পূর্ণতা দূর করে ’৭২ এর সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল, বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ সকল কালাকানুন ও ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল, সাংবিধানিক সকল পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে মানদ- নির্ধারণ করে সাংবিধানিক কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ এবং স্বাধীনভাবে পরিচালনার ঘোষণা দেয়া হয়।ইশতেহারে রিমান্ডে, পুলিশ হেফাজতে শারীরিক মানসিক নির্যাতন বন্ধ, বিচার বহির্ভূত হত্যা, গুম, খুন বন্ধ, অতীতের বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিচার, দুর্নীতি বন্ধ, আয়ের সাথে সঙ্গতিহীন সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা, বিদেশে পাচারকৃত টাকা ফেরৎ আনা, বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা ৫৯ থেকে কমিয়ে আনা, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনসহ নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কার, না ভোটের বিধান চালু, প্রতিনিধি প্রত্যাহারের বিধান চালু, সংসদ সদস্যদের ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি আমদানী বন্ধ, সর্বজনীন শিক্ষা চালু, শিক্ষাখাতে জিডিপির ৬% বরাদ্দ, ডাকসুসহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান, পিইসি, জেএসসি বাতিল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিন্ন টিউশন ফি নির্ধারণ, সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত, জিডিপির ৫% স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ, উন্নয়ন বরাদ্দের ৪০% কৃষি খাতে বরাদ্দ, কৃষি খাতে ভর্তুকী বাড়ানো, ক্রয় কেন্দ্র চালু, ফসলের লাভজনক দাম নিশ্চিত, উৎপাদক ও বিক্রেতা সমবায় গড়ে তোলা, গ্রাম-শহরের শ্রমজীবীদের জন্য আমিং রেটে রেশনিং চালু, পরিবেশ রক্ষায় কার্যর উদ্যোগ গ্রহণ, বন, পাহাড়, নদী দখল ও দূষণ মুক্ত করা, পুনর্বাসন ছাড়া বস্তি-হকার, রিক্সা উচ্ছেদ না করা, জাতীয় স্বার্থবিরোধী সকল চুক্তি বাতিল করা, সুন্দরবন বিনাশী রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাতিল, ঝুঁকিপূর্ণ রুপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাতিল ও জাতীয় কমিটির বিকল্প জ্বালানি নীতি বাস্তবায়ন, সকল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ, পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের ভূমির অধিকার নিশ্চিতসহ তাদের জীবনের বিকাশের পথ অবারিত করা, সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান, ফতোয়া নিষিদ্ধের আদালতের রায় বাস্তবায়ন, নারী-শিশু নির্যাতন বন্ধে পদক্ষেপ নেয়া, বিয়ের বয়স ২০ বছর করা, সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন বৃদ্ধি করে সরাসরি নির্বাচন, সিডও সনদ পূর্ণ বাস্তবায়ন, ইউনিফরম সিভিল কোড চালু, সমকাজে সমমজুরি, চাইল্ড কেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠা, সক্ষম সকল নারী-পুরুষকে সামরিক প্রশিক্ষণ দান, বাজেটসহ প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সকল বিষয়ে পার্লামেন্টের কাছে দায়বদ্ধ রাখা, সক্ষম সকল মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা, বেকার ভাতা প্রদান, কোটার যৌক্তিক সংস্কার, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ৬ দফা বাস্তবায়ন, তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমানো, পানি নীতি প্রণয়ন, যুবক ও তারুণ্যের শক্তিকে মাদক, হতাশা, অনিশ্চয়তা মুক্ত করে দেশ গড়ার কাজে নিয়োগ, অপসংস্কৃতি-অশ্লীলতা রোধ, পর্ণোগ্রাফী, অশ্লীল চলচ্চিত্র, পর্ণো পত্রিকা তৈরি ও আমদানী বন্ধ করা, জোট নিরপেক্ষ পরারাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করাসহ সতের দফা অঙ্গীকার ও করণীয় ঘোষণা করা হয়।
ইশতেহারে বলা হয়, আমরা নির্বাচিত হলে পার্লামেন্টের ভিতরে ও বাইরে জনস্বার্থে করণীয় কাজ ও দাবি আদায়ের সংগ্রাম জোরদার করবো যাতে সরকারের যে কোন গণবিরোধী পদক্ষেপকে মোকাবিলা করে তা থামানো যায় এবং যে মাত্রায়ই হোক, গণদাবি আদায় করা সম্ভব হয়। যে আলামত দেখা যাচ্ছে তাতে ভোট কেন্দ্র দখলের নির্বাচন যদি হয়, তাতে আমরা পার্লামেন্টে যেতে না পারলেও জনস্বার্থে করণীয় কাজ ও দাবি আদায়ের সংগ্রাম আমরা দলগত এবং জোটগতভাবে চালিয়ে যাবো। আন্দোলনকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে এবং ক্রমাগত চাপবৃদ্ধি করে গণদাবি আদায়ে সাফল্য আনার ও সংগঠন-আন্দোলন বিকশিত ও শক্তিশালী করার চেষ্টা চালাবো যাতে ভবিষ্যতে রাষ্ট্র শাসন ক্ষমতা দখলের পথ সুগম হয়। ভবিষ্যতে জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল ক্ষমতা লাভে কৃতকার্য হলে আমরা স্বল্পমেয়াদি ও সুদূরপ্রসারী কার্যক্রম গ্রহণ করবো। দেশের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সকল শক্তির সহযোগে ও বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা বাস্তবায়নে আমরা অগ্রসর হবো। আমাদের দলের দাবিনামা ও করণীয় কর্তব্য কর্মের দিকদিশা রয়েছে। নির্বাচনের হালচাল দেখে আমরা পরবর্তীতে সেগুলি আরও বিশদ ও সুনির্দিষ্ট করে হাজির করার চেষ্টা করবো। ইশতেহার ঘোষণার সময় খালেকুজ্জামান বলেন, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮। এই মাস আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাস। স্বজন হারানোর অসীম বেদনা, জীবনবাজী রাখা অসম সাহসী লড়াই শেষে আমরা ১৯৭১ সালের এই মাসে স্বাধীনতার বিজয় পতাকা উড়িয়েছিলাম। এখন স্বাধীনতার ৪৮ বছর হতে চললো। দেশবাসী আশা করেছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আকাঙ্ক্ষা পূরণের একটা উঁচু শিখরে উঠে আমরা অনেক গ্লানি ব্যর্থতার কালিমা মুছে উজ্জ্বল আলোকে আমাদের অঙ্গীকার শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন জাতীয় বিকাশের বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিশ্বের সামনে তুলে ধরবো। কিন্তু ভ্রষ্ট পথে পরিচালিত নষ্ট রাজনীতি করতে গিয়ে শাসক বুর্জোয়া শ্রেণি গোটা জাতিকে আবারও লজ্জিত করলো। জনগণের ক্ষমতায়ন অর্থে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা ভোটার জনগণ ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবে কিনা, গেলে ভোট দিতে পারবে কিনা, ভোট কেন্দ্রগুলো ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনের সময়কার চেহারা নেবে কিনা, হামলা-মামলা, গ্রেপ্তার বাণিজ্য, ভীতিকর পরিবেশ এইভাবে চলতে এবং বাড়তে থাকবে কিনা এইসব আতঙ্ক ও সংশয় বাড়ছে দিনকে দিন। অথচ আর মাত্র ৭ দিন বাকি আছে নির্বাচন অনুষ্ঠানের।’ তিনি বলেন, ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট ১৩১টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে, তার মধ্যে আমাদের দল ৪৫টি আসনে প্রার্থী দাঁড় করিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি। সেই নির্বাচনকে সামনে রেখে আমরা আমাদের দলের বক্তব্য (ইশতেহার) প্রকাশ করছি।’