শেখ হাসিনাকে ১৯ বার হত্যা চেষ্টা
অপরাধ তথ্যচিত্র ডেস্ক: ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর থেকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে এ পর্যন্ত অন্তত ১৯ বার হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছে। এ ছাড়া দেশি-বিদেশি পর্যায়ে তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছে আরও অন্তত পাঁচ দফা। শেখ হাসিনার ওপর এসব হামলার ঘটনায় অন্তত ৬৬ জন দলীয় নেতা-কর্মী নিহত হওয়ার হিসাব আছে। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার। এসব ঘটনায় যাদের প্রাণহানি ঘটেছে সেই পরিবারগুলো এখনো বিচার পায়নি। এইচ এম এরশাদ রাষ্ট্রপতি থাকাকালে দুটি, ১৯৯১ থেকে ’৯৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি সরকারের আমলে চারটি, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে চারটি, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত সরকার আমলে চারটি, সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে একটি ও আওয়ামী লীগের বর্তমান আমলে চারটি হত্যাচেষ্টার কথা জানা যায়। সরাসরি শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করেই হামলা চালানোর ১৪টি ঘটনায় মামলা হলেও বুধবার পর্যন্ত তিনটি মামলার বিচারকার্য সম্পন্ন হয়েছে। আরও ১১টি মামলা এখনো বিচারাধীন রয়েছে। শুধু ঢাকাতেই শেখ হাসিনার ওপর সশস্ত্র হামলা চালানো হয় সাতবার। এর মধ্যে ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর সচিবালয়ের সামনে তার গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। তখন মারা যান যুবলীগ কর্মী নূর হোসেন। ’৮৯ সালের ১১ আগস্ট ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনে হামলা করে ফ্রিডম পার্টি। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলাটির বিচারকার্য অতিসম্প্রতি সম্পন্ন হয়েছে। তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে ’৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর উপনির্বাচন চলাকালে রাজধানীর গ্রিন রোডে ও ’৯৫ সালের ৭ ডিসেম্বর ধানমন্ডির রাসেল স্কোয়ারে জনসমাবেশে গুলিবর্ষণ করা হয়। এরপর ’৯৬ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে বক্তৃতা দেওয়ার সময় মাইক্রোবাস থেকে সভামঞ্চ লক্ষ্য করে গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করা হয়। ২০১৫ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভায় যাওয়ার পথে কারওয়ান বাজারে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় জেএমবি। আর সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা চালানো হয় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে। সেখানে অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেলেও মারা যান আওয়ামী লীগের ২৪ নেতা-কর্মী। আলোচিত এ মামলাটির বিচারকার্য সম্পন্ন শেষে রায় দেওয়া হলো ১৪ বছর পর। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি, ঈশ্বরদীতে ’৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ও গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় হামলা হয় ২০০০ সালের ২০ জুলাই। কোটালীপাড়ার মামলাটির ইতিমধ্যেই বিচারকার্য সম্পন্ন হয়েছে। খুলনায় ২০০১ সালের ২৯ মে, একই বছর ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটে, ২০০২ সালের ৪ মার্চ নওগাঁয়, ৩০ আগস্ট সাতক্ষীরার কলারোয়ায় ও ২০০৪ সালের ২ এপ্রিল বরিশালে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র হামলা করে হুজি, জেএমবি, জামায়াত ও বিএনপি। সবশেষ গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর হাঙ্গেরি যাওয়ার পথে প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমানে ইঞ্জিনে ত্রুটি দেখা দেয়। বর্তমানে মামলাটি তদন্তাধীন।
বিচারের বাণী গুমরে কাঁদছে বছরের পর বছর : এরশাদ সরকারের আমলে ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে আটদলীয় জোটের জনসভা ছিল। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে মিছিল করে জনসভাস্থলে যাওয়ার পথে শেখ হাসিনার ট্রাকমিছিলে সশস্ত্র হামলা হয়। চট্টগ্রাম আদালত ভবনের পাশে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে নিহত হন ৩০ জন। ওই ঘটনায় শেখ হাসিনাকে মানববর্ম তৈরি করে রক্ষা করতে গিয়ে নয়জন নেতা-কর্মী নিহত হন। ওই হত্যাকাণ্ডের তিন দশক পেরিয়ে গেলেও আজও শেষ হয়নি বিচার। এর চার বছর পর ’৯২ সালের ৫ মার্চ আইনজীবী শহীদুল হুদা বাদী হয়ে চট্টগ্রামের তৎকালীন পুলিশ কমিশনার কাজী রকিবুল হুদা ও কোতোয়ালি জোনের পুলিশ পরিদর্শক (পিআই) গোবিন্দ চন্দ্র মণ্ডলসহ মোট ৪৬ জনকে আসামি করে মামলা করেন। কিন্তু তিন দশক পেরিয়ে গেলেও এ ঘটনার কোনো বিচার হয়নি। সাক্ষীর অভাবে থমকে আছে বিচারকাজ। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে ২০০১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটে হত্যাচেষ্টার মামলার বিচার দীর্ঘ ১৬ বছরেও শেষ হয়নি। আলোচিত এ মামলা সিলেটের জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। বর্তমানে মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। ইতিমধ্যে মামলার ৪৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। এ মামলার অন্যতম আসামি জঙ্গিনেতা মুফতি হান্নানকে গত বছরের ১২ এপ্রিল সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা মামলায় ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। তবে এ মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর শাকিল ও ওবায়েদ জামিন নিয়ে পালিয়ে গেছেন। তারা কোথায় আছেন, কী করছেন তাও জানা নেই সংশ্লিষ্ট কারও। মামলার অগ্রগতি না হওয়া প্রসঙ্গে জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) নওসাদ আহমদ চৌধুরী বলেন, যদি নির্ধারিত তারিখে আসামিদের আদালতে হাজির করা হতো তাহলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টা মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি হতো। ১৯৮৯ সালের ১০ আগস্ট মধ্যরাতে ফ্রিডম পার্টির অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী কাজল ও কবিরের নেতৃত্বে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবনে গুলি ও গ্রেনেড ছোড়া হয় বলে অভিযোগ আছে। শেখ হাসিনা তখন ওই বাসাতেই থাকতেন। ওই ঘটনায় বাড়ির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ কনস্টেবল জহিরুল ইসলাম একটি মামলা করেন। অতিসম্প্রতি এ মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর চতুর্থ জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনের সময় ধানমন্ডির গ্রিন রোডে ভোট কেন্দ্র পরিদর্শনে গেলে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। তার গাড়িতে গুলি লাগলেও অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান তিনি। এ ঘটনায় করা মামলার মীমাংসা হয়নি গত ২৭ বছরেও। ’৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ট্রেন মার্চ করার সময় পাবনার ঈশ্বরদী রেলস্টেশনে শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রেনের বগি লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। অসংখ্য গুলি লাগে তার বগিতে। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে অক্ষত থাকেন শেখ হাসিনা। ওই ঘটনায় ঈশ্বরদী থানায় মামলা হয়। এতে ১৩০ থেকে ১৩৫ জনকে আসামি করা হয়। পরে পুলিশ পৌর বিএনপির সভাপতি মোকলেছুর রহমান বাবলু, পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া পিন্টু, স্বেচ্ছাসেবক দল সভাপতি আজিজুর রহমান শাহীনসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় আদালতে। আসামিরা সবাই জামিনে আছেন। আসামিরা বার বার সময়ের আবেদন করে শুনানি আটকে রেখেছেন। ২০০০ সালের ২২ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার শেখ লুত্ফর রহমান সরকারি আদর্শ কলেজ মাঠে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশ করার কথা ছিল। ওই সমাবেশের প্যান্ডেল তৈরির সময় সন্ত্রাসীরা প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করার জন্য দুটি শক্তিশালী বোমা পুঁতে রাখে। সেনাবাহিনীর বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞরা ২০০০ সালের ২০ জুলাই ওই কলেজের পাশ থেকে ৭৬ কেজি ও একই সালের ২৩ জুলাই হেলিপ্যাডের কাছ থেকে ৪০ কেজি ওজনের দুটি শক্তিশালী বোমা উদ্ধার করে। ইতিমধ্যেই এ মামলার রায় ঘোষিত হয়েছে। ২০০১ সালের ৩০ মে খুলনার রূপসা সেতুর কাজ উদ্বোধন করতে যাওয়ার কথা ছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। ঘাতক চক্র সেখানে শক্তিশালী বোমা পুঁতে রাখে। বিস্ফোরণের আগেই বোমাটি উদ্ধার করতে সক্ষম হয় গোয়েন্দা পুলিশ। ২০০২ সালের ৪ মার্চ নওগাঁয় বিএমসি সরকারি মহিলা কলেজের সামনে তৎকালীন জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলা হয়। একই বছর ৩০ আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা সাতক্ষীরার কলারোয়ায় গেলে তার গাড়িবহরের ওপর গুলি ও বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় কলারোয়া মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোসলেমউদ্দিন ২৭ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত পরিচয় ৭০-৭৫ জনের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরার আদালতে মামলা করেন। আদালত মামলাটি তদন্তের জন্য নির্দেশ দিলে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ২০০৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর কলারোয়ার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম কিবরিয়া ঘটনা মিথ্যা বলে আদালতে প্রতিবেদন দেন। মামলাটি বার বার নিম্ন আদালত খারিজ করলেও বাদী মোসলেমউদ্দিন উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন। দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ১৮ জুলাই হাই কোর্টের বিচারক নিম্ন আদালতের আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ দিয়ে মামলার কার্যক্রম শুরুর নির্দেশ দেন। পরে এ-সংক্রান্ত তিনটি মামলায় ৫০ জনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দেওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলেই ২০০২ সালের ২ এপ্রিল বরিশালের গৌরনদীতে শেখ হাসিনার গাড়িবহরে গুলি করে দুর্বৃত্তরা। গৌরনদী বাসস্ট্যান্ডে ওই হামলা, গাড়ি ভাঙচুর, লুটতরাজের ঘটনায় প্রকৃত হামলাকারীদের পরিবর্তে উল্টো আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাদের আসামি করে মামলা করে পুলিশ। পরে ওই মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হলে প্রকৃত হামলাকারীরা পার পেয়ে যায়।