ভাল নেই সুন্দরবনের হরিণ
মংলা (বাগেরহাট) প্রতিনিধি: ভাল নেই সুন্দরবনের হরিণ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খাদ্য ঘাটতি সহ নানা কারনে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের চিত্রা হরিণের বংশবিস্তার এখন হুমকির সম্মুখীন। প্রতিনিয়ত সরকার সুন্দরবন সুরক্ষায় পদক্ষেপ নিচ্ছে। বছরে শত শত কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে এ খাতে। অথচ সম্ভাবনা স্বত্বেও হরিণ প্রজনন ব্যবস্থা নিরাপদ রাখা যাচ্ছে না। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন ও বনাঞ্চলের আয়তন কমে যাওয়া এবং চিত্রা হরিণের প্রধান খাদ্য কেওড়া পাতা লবনাক্ততার কারনে দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় হরিণের বংশ বিস্তার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বনের খুলনা, সাতক্ষীরা ও সাউথখালী অঞ্চলে হরিণ শিকার নিত্যদিনের ঘটনা। এছাড়া প্রতি বছর নভেম্বরে সুন্দরবনের দুবলার চরের আলোর কোলে রাশপূর্নিমা উৎসব মেলায় শত শত হরিণ ফাঁস দিয়ে মেরে ভুরিভোজ করা হয়। ফলে হরিণের সংখ্যা কমে গেলে বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় রয়েল বেঙ্গল টাইগারও হুমকির মুখে পড়বে। কেননা হরিণই বাঘের প্রধান খাদ্য। সুন্দরবনে সারা বছর হরিণ শিকার চলে হরহামেশা। প্রতিবছর রাস মেলায়ও ব্যাপক হারে হরিণ নিধন হয়। সূত্রমতে, প্রতি বছর সুন্দরবনের রাশ মেলাকে ঘিরে চলে শিকারীদের হরিণ নিধন। রাশ মেলা শুরু হওয়ার ১০-১৫ দিন পূর্বে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে হরিণ শিকারীরা প্রবেশ করবে বনের অভ্যন্তরে। গহীন বনে থেকে তারা নিধন করে সুন্দরবনের মায়াবী চিত্রল হরিণ। রয়েল বেঙ্গল ন্যায় শিকারীদের কালো থাবা, কুমির ও বাঘের আক্রমন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোগাক্রান্ত বনভূমি উজার সহ নানা কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত প্রায় সুন্দরবনের মায়াবী চিত্রল হরিণ। বাঘের থাবা ও কুমিরের ছোবল থেকে মাঝে মধ্যে শেষ রক্ষা পেলও শিকারীদের ফাঁদ ও বন্দুকের তাক থেকে শেষ রক্ষা পাচ্ছে না পৃথিবীর শেষ আশ্রয় কেন্দ্র সুন্দরবনের চিত্রল হরিণ। গত অর্ধযুগে চোরা শিকারীদের দ্বারা প্রায় ১০ হাজারের অধিক হরিণ শিকারের চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিমাসে গড়ে শিকারীরা বন থেকে প্রায় ৩-৪শ’ হরিণ শিকার করছে বলে জানা গেছে। বন্যপ্রানী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষন বিভাগ সহ বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ২০০১ সালের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী সুন্দরবনের হরিণের সংখ্যা দেড় থেকে দুই লাখ। জানা যায়, প্রতিবছর হরিণ দুইবার বাচ্চা দেয়। গত ৮ বছরে ৫০-৮০ হাজার হরিণ বৃদ্ধির কথা ছিল বলে একটি গবেষনায় মতামত প্রকাশ করা হয়। সূত্র দাবি করেন ৮-১০ বছরের ব্যবধানে ৪০-৫০ হাজার হরিণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সুন্দরবনের ২২ প্রজাতির উভচর, ১৪৩ প্রজাতির সরিসৃপ ও ১১৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হল মায়াবী চিত্রল হরিণ। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, গত একযুগে রাশ মেলাকে ঘিরেই চোরা শিকারীরা সুন্দরবনে হাজার হাজার হরিণ শিকার করেছে। সূত্র আরো জানায়, তবে গত বছরের চিত্র ছিল কিছুটা ভিন্ন। বিশেষ টহল দল গত বছর বিভিন্ন স্থান থেকে হরিণ মারার ফাঁদ ও হরিণের মাংস উদ্ধার সহ দোষীদের আটক করে। যা ছিল রেকর্ড পরিমান। গত বছরের টহল সকল পর্যটকদের নজর কাড়ে। সূত্র জানায়, রাশমেলা উপলক্ষে ব্যাপক নিরাপত্তা গ্রহণ করা হলেও শিকারীগন বনবিভাগ থেকে মাছ ধরার এবং কাকড়া মারা পারমিট নিয়ে মেলা শুরুর পূর্বে বনের মধ্যে প্রবেশ করে ফাঁদের উপকরণ রেখে আসে। জানা যায়, মোড়লগঞ্জ, মংলা, বাগেরহাট, খুলনা, রামপাল, পাইকগাছা, কয়রা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া, সাতক্ষীরা ও শ্যামনগরের শিকারীরা শিকারের উপকরণ রেখে আসার পর মেলা শুরুর ১০-১৫ দিন আগে বনের মধ্যে প্রবেশ করে হরিণ শিকার করে। বনের মধ্যে প্রবেশের সময় ২শ’ হাত সাইজের দড়ির কাচির ফাঁদ নিয়ে যায়। প্রতিটি নৌকায় খাবার পানির ড্রাম, নৌকার নীচে বেঁধে বা মাটির মাইটের তলায় আল্টা বানিয়ে এসব ফাঁদ নেয়া হয়। বনের ভিতর প্রবেশ করে তৎক্ষনাৎ এগুলো প্লাষ্টিকের বস্তায় ঢুকিয়ে গভীর জঙ্গলে মাটির মধ্যে পুতে রাখা হয়। মেলা আরম্ভ হবার পর শিকারীরা তীর্থ যাত্রীদের সাথে একত্রিত হয়ে মিলে যায়। পরবর্তীতে রাশ মেলার আনন্দে মেতে ওঠা দর্শনার্থী ও নিরাপত্তা কর্মীদের চোখ ফাকি দিয়ে এ ফাঁদ দিয়ে মেতে ওঠে হরিণ নিধন যজ্ঞে। সূত্রমতে, এই সকল হরিন শিকার ও পাচারের পিছনে উপকূলীয় অঞ্চলের লোকজন, স্থানীয় ও বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, কথিত জনপ্রতিনিধিরা জড়িত রয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলে গোপনে হরিনের মাংস চামড়া মাথা ও শিং উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়ে থাকে । হরিণ শিকারীরা বিভিন্ন সময় অবস্থা বুঝে ডাকাত সেজে নিরীহ জেলেদের স্বর্বস্ব কেড়ে নেয়। কখনো কখনো শিকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও জামিনে বেরিয়ে এসে তারা আবারো ওই কাজে লিপ্ত হয়। হরিণ শিকার সুন্দরবনের ব্যবসায়ীদের লাভজনক ব্যবসা। সহজেই হরিনের মাৎস বিক্রিয় করা যায়। চামড়া উচ্চ মুল্যে বিক্রি হয়। মাথা ও শিং দিয়ে তৈরী করা হয় শোভাবর্ধক কারুপন্য। সুন্দরবনের শরনখোলা রেঞ্জে সবচেয়ে বেশী হরিণ শিকার করা হয়। এছাড়া সাতক্ষীরা ও খুলনা রেঞ্জেও হরিণ শিকার করা হয়। বর্তমানে খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জে হরিণ শিকার অনেকটা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। তবে এখনো কিছু চিহ্নিত ফাঁদ পাতা শিকারী রয়ে গেছে ধরা ছোয়ার বাইরে। পরিবেশ ও মানবাধিকার বাস্তবায়ন সোইটির মহাসচিব মো: আজগর হোসেন বলেন, বন বিভাগ আরেকটু সজাগ হলেই ফাঁদ পাতা শিকারীদের উচ্ছেদ করতে পারে। চিত্রা হরিণের উপর পিএইচডিধারী বন কর্মকর্তা ড. তপন কুমার দে বলেন, বনাঞ্চলের আয়তন কমে যাওয়ায় চিত্রা হরিণ ধীরে ধীরে দক্ষিণে সরে যাচ্ছে। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে সুন্দরবনে ঘন ঘন বন্যা ধীরে ধীরে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলটির বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল সংকুচিত করে চলেছে। তিনি বলেন ১২ লাখ লোকের জীবিকার উৎসস্থল এই বনাঞ্চলকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সকলের।