আওয়ামী লীগের হেফাজত কানেকশন ক্ষমতায় যাওয়ার আপসকামিতা

pm_hefajot_45408_1492892361
অপরাধ তথ্যচিত্র ডেস্ক : হেফাজতের সঙ্গে ঘটা করে আওয়ামী লীগের সখ্যের বিষয়টি এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। এর অন্তর্নিহিত রহস্য উদঘাটনে রাজনৈতিক মহলে আলোচনার শেষ নেই। সবার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে নানা প্রশ্ন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক মহলও বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন। তারাও বুঝতে চান, জানতে চান কেন এই সখ্য? কেননা কোনোভাবেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে হেফাজতের এমন গাঁটছড়া বাঁধার বিষয়টি মানা যায় না। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শুধু আগামী নির্বাচনের বৈতরণী পার হতেই অবিশ্বাস্য এই আঁতাতের পর্দা উন্মোচিত হয়েছে। এছাড়া ক্ষমতায় যাওয়ার সমীকরণে উপমহাদেশে ধর্মভিত্তিক ও সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে আপসের যে রাজনীতি শুরু হয়েছে, তার হাওয়া এখানেও লেগেছে। এটিও একটি বড় ফ্যাক্টর হতে পারে। আর সবকিছু ছাপিয়ে যে বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে তা হল- আগামী নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য খুব সহজ পরীক্ষা হবে না। বেশ কিছুদিন থেকে জনমনে একটা পারসেপশন তৈরি হয়েছিল যে, বিএনপির ভোট যতই বেশি থাকুক না কেন, আগামী নির্বাচনে ফের ক্ষমতায় আসবে আওয়ামী লীগ। কিন্তু হেফাজতের সঙ্গে সরকারি দলের এমন সখ্যের বিষয়টি সামনে চলে আশায় সে বিশ্বাসে এখন অনেকটা চিড় ধরেছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন, যেহেতু হেফাজতের মতো একটি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক শক্তিকে আওয়ামী লীগ গুরুত্ব দিচ্ছে তাহলে ধরে নিতে হবে, আগামী নির্বাচন সত্যি সত্যিই ভোটের লড়াইয়ে পরিণত হবে। কেননা আওয়ামী লীগ ভোটের রাজনীতির নানা সমীকরণ মেলাতে আগেভাগে এ রকম সমঝোতার পথে পা বাড়িয়েছে। এর সঙ্গে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ১৫১ আসনকে টার্গেট করা ছাড়া ভিন্ন কোনো আদর্শ নেই। তারা বলেন, কারণ যাই হোক, হয়তো আওয়ামী লীগ মনে করছে, গত নির্বাচন যেভাবে হয়েছে এবার আর সেভাবে হবে না। ওয়ান-ইলেভেন-পরবর্তী ২০০৮ সালের প্রেক্ষাপট এখন নেই, আবার ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচনে না যাওয়ার ঐতিহাসিক ভুলও আর বিএনপি করবে না। ফলে একটি অংশীদারিত্ব এবং প্রতিযোগিতামূলক জাতীয় নির্বাচন সবার জন্য অপেক্ষা করছে। এছাড়া কেউ কেউ মনে করেন, আঞ্চলিক ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থের প্রশ্নে এখানে অনেক বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রও আগামী নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ দেখতে চায়। পর্দার আড়ালে মহলবিশেষ এমনটিও চায়, যেন এককভাবে কোনো দল ক্ষমতায় না আসে। ঝুলন্ত পার্লামেন্ট হলে ভালো। চায়ের টেবিলের এ রকম নানা বিশ্লেষণকে সামনে রেখে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল এখন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে চায়, যে যার সুবিধামতো চারদিক থেকে রাজনৈতিক বক্তব্য যেভাবেই দিক না কেন, সবার সামনে এখন একটি কঠিন নির্বাচনী পরীক্ষা অপেক্ষা করছে এবং তা বেশি দূরে নয়। বলা যায়, ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে জাতীয় নির্বাচন। সূত্র জানায়, এ রকম একটি বাস্তবতাকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ফের ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সমঝোতার রাজনীতির পথে পা বাড়িয়েছে। তাদের মতে, শুধু যুদ্ধাপরাধী ও চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তারা এখন যে কারও সঙ্গে আপস করতে রাজি। কারণ ক্ষমতায় যেতে পারলে সব আপসকামিতা ইতিহাসের পাতায় সঠিক সিদ্ধান্ত বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়লে কোনো নীতি-আদর্শ দলের নানামুখী ক্ষতি পুষিয়ে দিতে পারবে না। এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক্ষমতাসীন দলের একজন সিনিয়র নেতা প্রতিবেদককে বলেন, যুদ্ধ আর রাজনীতির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যুদ্ধে যেমন শক্তির পাশাপাশি রণকৌশল বড় নিয়ামক, রাজনীতিতেও লাগে ‘রাজকৌশল’। সময়ের দাবির প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ সেটিই করছে। ’৯১-এর নির্বাচনে বিএনপি এমন সমঝোতার রাজকৌশল বেছে নিয়েছিল। বিপরীতে আওয়ামী লীগ তা করেনি বলেই সে সময় ক্ষমতায় যেতে পারেনি। তিনি বলেন, ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে এবং আওয়ামী লীগ সে শিক্ষা গ্রহণ করে সেটিই করছে। এর মধ্যে দোষের কিছু নেই। প্রসঙ্গত, ১২ এপ্রিল হেফাজতের শীর্ষ নেতা আল্লামা শফীসহ এ ধারার কয়েকজন নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। হেফাজত তথা কওমি শিক্ষার সঙ্গে জড়িতরাও বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারকে সহযোগিতা এবং সরকারের সঙ্গে কণ্ঠ মেলান। এরপর থেকে ভিন্ন এক উত্তাপে বিষয়টি সরাসরি রাজনীতির মাঠে চলে আসে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, আগামী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ জিতবে তাতে খুব একটা সন্দেহ নেই। নির্বাচন অতীতে যেভাবে হয়ে আসছে আগামীতেও সেভাবেই হবে। তিনি বলেন, আত্মরক্ষার্থে জনসমর্থন দরকার। আর ধর্মীয় শক্তিগুলো যেভাবে জেগে উঠেছে হয়তো আওয়ামী লীগ তাদের নিজের সঙ্গে নিয়ে আগামী নির্বাচনে জিততে চায়। কেননা হয়তো ক্ষমতাসীন দলটি মনে করছে, আগামীতে একটি গ্রহণযোগ্য এবং প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনে বিজয়ী হয়েই সরকারে আসতে হবে। প্রবীণ এ শিক্ষক বলেন, বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার পর থেকেই আওয়ামী লীগ ধর্মীয় শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে আসছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দেশে ফিরে আসার পর থেকেই তার বারবার হজ করা, ভোরে উঠে ফজরের নামাজ পড়ার কথা বলা, তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ার কথা বলা, হিজাব পরে দোয়া করার ছবি, মদিনা সনদ অনুযায়ী দেশ চালানোর ঘোষণা দেয়ার ধারাবাহিকতার অংশই আজকের হেফাজতের সঙ্গে সম্পর্ক। তিনি বলেন, ভারতে কংগ্রেস দীর্ঘদিন একক বৃহৎ শক্তি থাকলেও গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে সেভাবে ধারণ না করায় তাদের যতটা না ক্ষতি হয়েছে তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ধর্মীয় শক্তিগুলোকে কাছে না টানায়। ক্ষতি হিসেবে তাদের এখন সংসদে ছোট পরিসরে নেতৃত্ব দিতে হচ্ছে। বিপরীতে বিজেপি হিন্দুত্ববাদকে ধারণ করে সর্বোচ্চ সাফল্য পেয়েছে এবং বিধানসভার নির্বাচনেও সে জয় অব্যাহত আছে। নতুন করে প্রাধান্য পাওয়া এই রাজকৌশল এখন বাংলাদেশেও ভর করেছে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এদেশের রাজনৈতিক দলগুলো আগের তুলনায় ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে নতুন মাত্রায় আপস করছে। এ নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন আহমেদও আবুল কাসেম ফজলুল হকের সঙ্গে অনেকটা একমত। তিনি বলেন, রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবেই হেফাজতের সঙ্গে আপস করেছে আওয়ামী লীগ। আগামী নির্বাচনে ধর্মভিত্তিক শক্তিগুলোকে কাছে পাওয়া, তাদের রিজার্ভ ভোট অধিকার করা এবং যাতে এসব শক্তি নির্বাচনের আগে বিরোধিতা না করে সেজন্যই আওয়ামী লীগ হেফাজতকে কাছে টেনেছে। পাশাপাশি আগামী নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে এই শক্তিকে হাতে রাখাও আরেকটি অন্যতম কারণ। কেননা আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে মনে হচ্ছে, তারা আগামীতে একটি সিরিয়াস নির্বাচনে জয়ী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। যদিও রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ-হেফাজত সম্পর্কের ইতিবাচক কোনো ফল দেখছেন না তিনি। হাফিজ উদ্দিন বলেন, এদেশের দলীয় রাজনীতি বরাবরই কলুষিত। ক্ষমতায় আসার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো যে কোনো ধরনের আপস করতে দ্বিধা করে না। অতীতে বিএনপি-আওয়ামী লীগ দু’দলই তা করেছে। এসব কারণে রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব বাড়ছে বলে মনে করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা। তিনি বলেন, উপমহাদেশের অনেক দেশেই ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে ব্যবহার করে কিছু রাজনৈতিক দল সাফল্য ঘরে তুলেছে, ক্ষমতায় গিয়েছে। বাংলাদেশেও তাই ঘটছে। যদিও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, হেফাজতের নেতা হিসেবে নয়, কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িতদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তারপরও থেমে থাকেনি সমালোচনা। কোনো ধরনের সিলেবাস রিভিউ ছাড়া কওমিকে স্বীকৃতি দেয়ায় বিভিন্ন মহলে বিরূপ সমালোচনা হয়। এমনকি আলিয়া ধারার সঙ্গে যুক্তরা এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে আসছেন। প্রগতিশীল ধারার অনেক রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী হেফাজতের সঙ্গে সম্পর্ক এবং কওমিকে স্বীকৃতি দেয়ার কঠোর সমালোচনা করছেন অনেক আগে থেকে। সুজন সম্পাদক বলেন, সারা বিশ্বেই ধর্মাশ্রয়ীতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের দেশে তা সুস্পষ্টাভাবেই পাচ্ছে। রাজনীতিবিদরাও এর বাইরে নন। ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট ভোটের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলে। সামনে জাতীয় নির্বাচন। স্বাভাবিকভাবেই ধর্মভিত্তিক দল বা শক্তিগুলোকে রাজনৈতিক দলগুলো কাছে টানবে। তিনি মনে করেন, আওয়ামী লীগ ও হেফাজতের সঙ্গে যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে সেটা এরই অংশ। আগামী নির্বাচনে তাদের পাশে পাওয়াটাই অন্যতম লক্ষ্য হতে পারে। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে, সাময়িকভাবে এসব শক্তি পাশে থাকলেও তাদের লক্ষ্য এদেশে ইসলামী রাষ্ট্র ও শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠা করা। যে কারণে সার্বিকভাবে বিএনপি বা আওয়ামী লীগের জন্য এসব শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক দীর্ঘমেয়াদে কোনো সুফল বয়ে আনবে না। এদেশের রাজনীতির জন্যও ইতিবাচক কিছু হবে না। যদিও এ দুটি দলই অতীতেও এ ধরনের আঁতাত গড়ে তুলে রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করেছে। জামায়াতসহ অন্যান্য ধর্মীয় দলের সঙ্গে বিএনপি অনেক আগে থেকে সম্পৃক্ত, অতীতে আওয়ামী লীগও খেলামত মজলিসের মতো দলের সঙ্গে ৫ দফা চুক্তি করেছে। সুজন সম্পাদক বলেন, হয়তো সরকার চাচ্ছে একটি প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন। তাদের সাংগঠনিক প্রস্তুতি, সরকারের কর্মকাণ্ড এবং ধর্মভিত্তিক শক্তির সঙ্গে আপসও তাই বলে। স্বাভাবিকভাবেই সে নির্বাচনে জিতে আবারও সরকারে থাকতে চাইবে আওয়ামী লীগ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *