প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর
বিশেষ প্রতিনিধি:ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুক্রবার নয়াদিল্লি যাচ্ছেন সাত বছর বিরতির পর। খসড়া চূড়ান্ত করেও ছয় বছর ধরে ঝুলে থাকা তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি যে প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরে সই হচ্ছে না, সেটা একরকম নিশ্চিতই বলা যায়। অভিন্ন নদীটির পানিবণ্টন চুক্তি না হলেও দুই প্রতিবেশী দেশের শীর্ষ বৈঠকে প্রতিরক্ষা, মহাকাশ, পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। নতুন এসব বিষয়সহ উন্নয়ন, অবকাঠামো, বাণিজ্য, জ্বালানি, বিনিয়োগের ব্যাপারে অন্তত ৩৩টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সইয়ের কথা আছে। গত মঙ্গলবার ঢাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সাংবাদিকদের এসব চুক্তি ও সমঝোতার কথা জানান।
তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে জানতে চাইলে মাহমুদ আলী দুই দেশের সম্পর্ককে সামগ্রিকভাবে দেখার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমাদের সম্পর্ক এখন যে অবস্থানে আছে, সেখানে আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি। সেখানে একটি বিষয় হলো কি হলো না, সেটি তেমন বড় কিছু নয়। এটা নিয়ে এখন আর কিছু বলতে চাই না।’
বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিষয় তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে এবারের সফরে এ দেশের মানুষের প্রত্যাশা রয়েছে, সেটি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ভারত। কিন্তু ভারত তাদের কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থার কারণে পশ্চিমবঙ্গকে নিয়েই এর সমাধান করতে চায়। ভারতের একটি কূটনৈতিক সূত্রে আভাস পাওয়া গেছে, এই সফরে তিস্তা চুক্তি সই না হলেও খুব শিগগির তা হয়ে যাবে। শেখ হাসিনা এবার দিল্লি সফরের সময় ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির আমন্ত্রণে রাষ্ট্রপতি ভবনে থাকবেন। গতকালের ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এখন একটি নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। আমরা নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করব।’ দুই দেশের কূটনীতিকদের মতে, প্রতিরক্ষা সহযোগিতার রূপরেখা সইয়ের মাধ্যমে বিষয়টির একটি কাঠামো তৈরি, মহাকাশ এবং পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে সহযোগিতা দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন পথে নিয়ে যাচ্ছে।প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতায় চুক্তি, নাকি সমঝোতা স্মারক সই হবে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘সেটা না হলে বলা যায় না। হলেই দেখা যাবে। যা হবে তা সবাই জানতে পারবেন। কোনো কিছু গোপন করা হবে না। আর নিন্দুকেরা যা বলছেন, তার কিছুই হবে না।’ nবাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিরক্ষা সহযোগিতার রূপরেখা নিয়ে দুই দেশ একটি সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রস্তুতি নিয়েছে, চুক্তি নয়। প্রধানমন্ত্রীর সফরের জন্য অপেক্ষমাণ চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের মধ্যে আছে ৫ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার দুটি ঋণবিষয়ক সমঝোতা স্মারক। এর মধ্যে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার দেওয়া হবে ১৮টি প্রকল্পে সহায়তার জন্য এবং বাকি ৫০০ মিলিয়ন সমরাস্ত্র কেনাকাটার জন্য। ভারতের এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাংক বা সংক্ষেপে এক্সিম ব্যাংক এই ঋণ দেবে। জানা গেছে, আগের দুটি ঋণ সহায়তায় টাকার পরিমাণ ঠিক করে প্রকল্প চূড়ান্ত করা হয়েছিল। এবার প্রাথমিকভাবে ২৭টি প্রকল্পের মধ্যে ১৮টি প্রকল্প বাছাই করে মোট অঙ্ক যোগ করে ঋণের পরিমাণ ঠিক করা হয়েছে। তবে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণে শর্তগুলো আগের মতো থাকবে। এ ঋণের সুদের হার ১ শতাংশ, ২০ বছরের মধ্যে পরিশোধযোগ্য এবং প্রথম পাঁচ বছর গ্রেস পিরিয়ড (অতিরিক্ত সময়) থাকবে। প্রকল্পে ব্যবহৃত ৭৫ শতাংশ পণ্য ভারত থেকে কিনতে হবে এবং প্রকল্পভেদে প্রয়োজন পড়লে এটি কমতে পারে।
প্রতিরক্ষা ও ঋণ সহায়তা ছাড়া যেসব বিষয়ে চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক সই হবে, তার মধ্যে রয়েছে সীমান্ত হাট স্থাপন, তথ্য ও সম্প্রচার, বেসামরিক পারমাণবিক সহযোগিতা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, স্যাটেলাইট ও মহাকাশ গবেষণা, ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞান, কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতা।
এই সফরের সময় দুই প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থের হিন্দি সংস্করণের মোড়ক উন্মোচন করবেন। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আত্মজীবনীর হিন্দি সংস্করণটি প্রকাশ করেছে। ভারতীয় শহীদদের সম্মানন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী ভারতীয় সেনাসদস্যদের ‘মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। এ জন্য ১ হাজার ৬৬১ জনের একটি তালিকা করা হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী গতকাল ঢাকায় সাংবাদিকদের জানান, প্রধানমন্ত্রী দিল্লি সফরের সময় সাত ভারতীয় শহীদ পরিবারের নিকটজনের হাতে সম্মাননা পদক ও সম্মাননাপত্র তুলে দেবেন। এর সঙ্গে কোনো অর্থ থাকবে না। সম্মাননা প্রদানের অনুষ্ঠানটিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও বক্তৃতা করবেন।
প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে ভারত সফর করবেন আইন ও বিচারমন্ত্রী আনিসুল হক, পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম।