ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ক্রয় করা জমিতে সচিবদের জন্য বিলাসবহুল ফ্ল্যাট

সেখ রাসেল, সহকারী দপ্তর সম্পাদক, অনলাইন ডেস্ক:
উত্তরায় মনোরম পরিবেশে গড়ে উঠছে আধুনিক ফ্ল্যাট প্রকল্প। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য কেনা এই জমিতে ফ্ল্যাট নির্মাণ হচ্ছে সচিবদের জন্য। ইতিমধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।
সরকারি প্রকল্পের জমিতে তৈরি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটগুলো সচিব ও প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের জন্য বরাদ্দের ঘটনায় জনমনে তীব্র প্রশ্ন ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের (বাসেক) অধীনে গৃহীত প্রকল্পের আওতায় অধিগ্রহণকৃত জমিতে গড়ে ওঠা এসব ফ্ল্যাট প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য বরাদ্দকৃত ভূমিতে নির্মিত হলেও সেগুলোর বেশিরভাগই শেষ পর্যন্ত চলে গেছে প্রভাবশালী আমলাদের হাতে। সরকারি অর্থে নির্মিত ফ্ল্যাটগুলো নিজেদের জন্য বরাদ্দ নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহারের নজির গড়েছেন তাঁরা।

এই ঘটনায় সেতু কর্তৃপক্ষের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবরা সরাসরি জড়িত ছিলেন। তাঁরা পর্ষদে বসেই নিজেদের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করে নিজেদের নামে খুবই অল্প মূল্যে এসব ফ্ল্যাট বরাদ্দ নিয়েছেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এটিকে রাষ্ট্রীয় অনাচার হিসেবে অভিহিত করে বলেন, এটি স্পষ্টভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের একটি উদাহরণ, এবং এ ঘটনায় দোষীদের বিচারের আওতায় আনা উচিত।

ফ্ল্যাট প্রাপ্তদের তালিকায় রয়েছেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব খোন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, মাহবুব হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব আহমেদ কায়কাউস, সাবেক বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারসহ আরও অনেক প্রভাবশালী আমলা। তাঁদের বেশিরভাগই ছিলেন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন। এছাড়া অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপসচিব, এমনকি সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যেও এসব ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ মাত্র কয়েক মাস সেতু বিভাগে দায়িত্ব পালন করেই এই ফ্ল্যাট পেয়েছেন, এমনকি এমন কিছু কর্মকর্তা রয়েছেন যাঁদের সেতু বিভাগের সঙ্গে কোনো যোগসূত্রই ছিল না।

উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকায় এই ফ্ল্যাটগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে অত্যাধুনিক ও সুপরিকল্পিত নকশায়। খোলা জায়গা, জলাধার ও প্রশস্ত রাস্তা সমন্বিত মনোরম পরিবেশে নির্মাণাধীন ভবনগুলোর প্রতিটি ফ্ল্যাটের আয়তন প্রায় ১,৬০০ বর্গফুট, যার বাজারমূল্য প্রায় ২ কোটি টাকা হলেও সচিবদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে মাত্র ৬০ লাখ টাকা করে। অন্যদিকে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য নির্মিত ফ্ল্যাটগুলো ছোট আয়তনের (১,১০০–১,৩০০ বর্গফুট) এবং ঘনবসতিপূর্ণ স্থানে, যা বিক্রি করা হচ্ছে প্রায় একই দামে।

সেতু বিভাগের তথ্যমতে, উত্তরা মডেল টাউনের তৃতীয় পর্বের বড়কাঁকর, বাউনিয়া ও দ্বিগুণ মৌজায় অধিগ্রহণ করা ৪০ একর জমির মধ্যে ১.১৫ একর জমিতে চারটি ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে তিনটি ভবন শুধুই সচিব ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জন্য, যাদের জন্য বরাদ্দকৃত ফ্ল্যাটের সংখ্যা ১৬৮টি, যার ১৪০টির বরাদ্দ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। এসব ভবনের নাম দেওয়া হয়েছে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা। একটি ভবন রাখা হয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মচারীদের জন্য, যেখানে রয়েছে ১১২টি ফ্ল্যাট।

সেতু কর্তৃপক্ষের মূল দায়িত্ব এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বাস্তবায়ন হলেও এ প্রকল্পের আওতায় সংযুক্ত করা হয় সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রজেক্ট’ শীর্ষক পুনর্বাসন প্রকল্পটি, যার ব্যয় ২০১১ সালে ছিল ৩২১৭ কোটি টাকা। সেটি বাড়তে বাড়তে বর্তমানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৪৯১৮ কোটি টাকায়। এই প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে অধিগ্রহণ করা ৪০ একর জমির কিছু অংশ সচিবদের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে। অথচ সেতু কর্তৃপক্ষ আইন অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তাদের ফ্ল্যাট বরাদ্দের কোনো বিধান নেই।

২০১৮ সালের ৩১ মে অনুষ্ঠিত ১০৭তম বোর্ড সভায় সচিব ও কর্মকর্তাদের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। বোর্ড সভায় বলা হয়, পুনর্বাসনের জন্য নির্ধারিত জমির একটি অংশ ব্যবহৃত হচ্ছে না এবং সেটি অন্য কোনো কাজে ব্যবহারযোগ্য নয় বলেই জাতীয় গৃহায়ণ নীতিমালার আলোকে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে এই বক্তব্যের পেছনে যে উদ্দেশ্য ছিল, তা পরিষ্কার বাড়তি জমি অধিগ্রহণ করে নিজেরা সুবিধাভোগী হওয়ার সুযোগ তৈরি করা।

এই পুরো প্রকল্পে জড়িতদের মধ্যে রয়েছেন সেতু বিভাগের সাবেক সচিব ও নির্বাহী পরিচালক খোন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, যিনি পরবর্তীতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে নিয়োগ পান এবং সেখান থেকেও প্রভাব খাটিয়ে আরও অনেক কর্মকর্তাকে ফ্ল্যাট বরাদ্দের ব্যবস্থা করেন। বর্তমানে তিনি পলাতক এবং তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। এই ফ্ল্যাট প্রকল্পের নির্মাণের দায়িত্ব পেয়েছে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ক্যাসল কনস্ট্রাকশন। তিনটি ভবনের নির্মাণচুক্তি হয়েছে প্রায় ৯০ কোটি টাকায়। আরেকটি ভবনের কাজ এখনো শুরু হয়নি।

সেতু বিভাগের অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, এই বরাদ্দে প্রকৃতপক্ষে সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অধিকারের চরম অবজ্ঞা করা হয়েছে। তারা দীর্ঘদিন সেখানে কাজ করলেও তাঁদের জন্য আবাসন সুবিধা বরাদ্দ হয়নি। বরং প্রশাসন ক্যাডারের কিছু কর্মকর্তা মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ফ্ল্যাট পেয়ে গেছেন। এছাড়া বোর্ড সদস্য না হয়েও জনপ্রশাসন, অর্থ, প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র, ভূমি, আইএমইডি, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অনেক কর্মকর্তাকেও প্রভাব খাটিয়ে ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছে।

উল্লেখযোগ্যভাবে, এই প্রকল্পে উত্তরায় অধিগ্রহণকৃত জমির পরিমাণ ৪০ একর হলেও প্রকৃত প্রয়োজনের তুলনায় এটি অতিরিক্ত ছিল। স্থানীয়দের মতে, উত্তরা তৃতীয় পর্বের প্রতি শতাংশ জমির দাম ১ কোটি ৩০ লাখ থেকে দেড় কোটি টাকা পর্যন্ত, অর্থাৎ সচিবরা যে ১১৫ শতাংশ জমিতে ফ্ল্যাট পেয়েছেন, সেটির বাজারমূল্য প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। অথচ এর আগে রাজউক ও জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের অধীনে নির্মিত ফ্ল্যাটগুলো সাধারণ মানুষের জন্য লটারির মাধ্যমে বরাদ্দ দেওয়া হতো। কিন্তু সেতু বিভাগের অধীনে নির্মিত এসব ফ্ল্যাট শুধুমাত্র প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে।

সরকারি এই অনিয়মের বিরুদ্ধে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক স্পষ্টভাবে বলেন, আমলাতন্ত্র বিভিন্ন সময় একত্র হয়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদ নিজেরা ভাগাভাগি করেছে। এই অনিয়মের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত জরুরি এবং দোষীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। অন্যদিকে, প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য, অর্থাৎ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এর নির্মাণও আজও শেষ হয়নি। ২০১০ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পটি এখনও ঝুলে আছে নানা জটিলতায়। বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শেয়ার নিয়ে দ্বন্দ্ব, আইনি জটিলতা এবং প্রশাসনিক বিলম্বের কারণে প্রকল্পটির কাজ কয়েকবার বন্ধ হয়েছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, জুনের শেষ নাগাদ কাজ আবার শুরু হতে পারে বলে জানানো হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *