থামছেইনা বন্যপ্রাণী পাচার ও হরিণ শিকার!
অপরাধ তথ্যচিত্র ডেস্ক:
ব্যপক হারে বেড়েছে সুন্দরবনে হরিণ শিকারের সংখ্যা। শুধু হরিণ নয়, প্রতি বছর দেশে প্রায় ৪ হাজারেরও বেশি বন্যপ্রাণী শিকার বা পাচার হচ্ছে।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচারের (আইইউনিএন) ২০২৩ সালের গবেষণা তথ্য বলছে, সুন্দরবনে হরিণ, বানর, শুকরসহ পাঁচ ধরনের বন্যপ্রাণীর সংখ্যা বেড়েছে। তবে আশঙ্কার কথা সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে হরিণ শিকার বা পাচারও। সুন্দরবনের ভিতরে ফাঁদ দিয়ে হরিণ শিকার এখন অনেকটা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে ১০ হাজার মিটারের বেশি হরিণ ধরা ফাঁদ উদ্ধার করা হয়েছে, যা বাস্তব সংখ্যা থেকে অনেক কম।এসব হরিণের মাংস আবার বন সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকায় হরহামেশাই বিক্রি হচ্ছে। সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় স্থানীয় বাজারেও হরিণের মাংস বিক্রি হয় হরহামেশাই। এমনকি গরু কিংবা খাসির মাংস থেকে কম মূল্যে বিক্রি হয় হরিণের মাংস।
স্থানীয়দের অভিযোগ, শিকারীদের ধরতে সুন্দরবনে বন বিভাগের নিয়মিত টহল থাকলেও অদৃশ্য কারণে হরিণ শিকার কমছে না। বনবিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ম্যানেজ করে, আবার কখনও তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করা হয়। সুন্দরবন সংলগ্ন স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, জেলেদের একটি বড় অংশ হরিণ শিকারের সঙ্গে জড়িত। যারা হরিণ শিকার করে তারা একসঙ্গে ১০/১২টা করে হরিণ নিয়ে আসে। বন বিভাগের লোক মাঝে মধ্যে ধাওয়া দিলেও তাদের অপরাধ থামানো যায় না। হরিণ শিকার রোধে সম্প্রতি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় থেকে সুন্দরবন বন বিভাগকে তৎপরতা বাড়াতে নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।
শুধু হরিণ নয়, বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের তথ্য বলছে, সারা দেশে গড়ে প্রতি বছর চার হাজারেরও বেশী বন্যপ্রাণী পাচার বা শিকার হয়। সবশেষে জানুয়ারি মাসে পাচার বা শিকারের সময় ৪৫৮টি বন্যপ্রাণী উদ্ধার করেছে বন্যপ্রানী দমন ইউনিট। ডিসেম্বর মাসে এ সংখ্যা ছিল ১৬৫৬টি। যার মধ্যে ৮৭০টি বিশেষ ধরনের কাছিম রয়েছে।
সুন্দরবনে হরিণ ধরার ফাঁদ পাতা হয়েছে। এদিকে বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করা আরেক সংস্থা ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি অব বাংলাদেশের গবষেণা বলছে, বন্য প্রাণীর মধ্যে সবচে বেশি ৩৫ শতাংশ পাচার বা শিকার হয় বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। এরপর ২৮ শতাংশ স্তন্যপায়ী প্রাণী। আর স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে সব থেকে বেশি শিকার হয় সুন্দরবনের হরিণ।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাঘের খাদ্য হিসেবে বিবেচিত হরিণ শিকার এখনই প্রতিরোধ করা না গেলে সুন্দরবনের খাদ্য শৃঙ্খল নষ্ট হবে, যা পুরো সুন্দরবনের ইকোসিস্টেমের ওপর প্রভাব ফেলবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সব দফতরের আরও সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন।সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে সুন্দরবনের ভেতরে হরিণ শিকারের খবর খুবই উদ্বেগজনক। আশঙ্কাজনক হারে হরিণ নিধন বেড়েছে। এভাবে হরিণ নিধন চলতে থাকলে বাঘের খাদ্য সংকট দেখা দেবে। যা সুন্দরনের পুরো ইকোসিস্টেমের ওপরই প্রভাব ফেলবে। এ জন্য হরিণ শিকারীদের আইনের আওতায় আনতে আইনের প্রয়োগ আরও জোরদার করতে হবে।ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ ন্যাচারের গবেষণা দলের সদস্য মো. মফিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘বন বিভাগের সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে সুন্দরবনে আগের তুলনায় বেড়েছে বাঘের সংখ্যা। এরও আগে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচারের তত্ত্বাধায়নে সুন্দরবনে বন্যপ্রাণীর ওপর জরিপ চালায়। ২০২৩ সালের সেই জরিপে দেখা যায়, সুন্দরবনে চিত্রা হরিণ, বানর, বন্য শূকর, সজারুসহ বেশ কয়েক জাতের বন্য প্রাণীর সংখ্যা বেড়েছে। বাঘ বা এই বন্য প্রাণীর সংখ্যা ধরে রাখতে বণ্য প্রাণী সংরক্ষণ খুবই জরুরি। এরই মধ্যে বনবিভাগ থেকে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বন্য প্রাণী সংরক্ষণ করা না গেলে সুন্দরবনের ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়বে।
এদিকে সবশেষ এক বছরে সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থান থেকে ১০ হাজারের বেশি হরিণ ধরা রশি বা ফাঁদ উদ্ধার করেছে বন বিভাগ। এক বছরে কয়েক হাজার কেজি হরিণের কাঁচা মাংসও উদ্ধার হয়েছে। এসব ঘটনায় ১৩২ জন আসামি করে ৪০টির মতো মামলা হয়েছে। তবে বন বিভাগ গেল এক বছরের ঘটনায় মাত্র ৩২ জনকে গ্রেফতার করতে পেরেছে। যদিও বন বিভাগের দাবি, হরিণসহ বন্যপ্রাণী পাচার রোধে কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এজেডএম হাসানুর রহমান বলেন, ‘সুন্দরবনের হরিণ শিকার বা পাচার রোধে কার্যক্রম আগের তুলনায় জোরদার করা হয়েছে। বনের ভিতর টহল বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া সুন্দবন সংলগ্ন এলাকায় এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে নিয়মিত উঠান বৈঠক করে থাকি। আশা করছি, সামনের দিনগুলোতে এ ধরনের অপরাধ অনেকটা কমে আসবে।’ সুন্দরবনে প্রায় ৩৭৫ প্রজাতির বণ্যপ্রানী রয়েছে। এর মধ্যে ৩০০ প্রজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৮ প্রজাতির উভচর।