SPCALবিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে হরিণ বাড়লেও থেমে নেই মহোৎসব! বনরক্ষার ব্যর্থতা না শিকারিদের দাপট ?? ? গত তিন মাসে৬৪১ কেজি হরিণের মাংস জব্দ আটক ২২

বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে হরিণ বাড়লেও থেমে নেই মহোৎসব! বনরক্ষার ব্যর্থতা না শিকারিদের দাপট ?? ? গত তিন মাসে৬৪১ কেজি হরিণের মাংস জব্দ আটক ২২ এস.এম. সাইফুল ইসলাম কবির, সুন্দরবন থেকে ফিরে: বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে হরিণ শিকারের হিড়িক পড়েছে। ফাঁদ পেতে আর বিষটোপ দিয়ে হরিণ শিকার করা হচ্ছে। শিকারিচক্র রীতিমতো হরিণ শিকারে মেতে উঠেছে। শিকারিদের বিকল্প পেশায় ফেরানোর দাবি। বন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে সুন্দরবন থেকে হরিণ পাচার বৃদ্ধি পেয়েছে।সুন্দরবনসংলগ্ন লোকালয়ে দীর্ঘদিন ধরে হরিণ শিকারিচক্র গড়ে উঠেছে।সংঘবদ্ধ চোরা শিকারি চক্র প্রতিনিয়ত সুন্দরবনে হরিণ নিধন করে চলেছে। গত তিন মাসে কোস্ট গার্ডের হাতে উদ্ধার হয়েছে ৬৪১ মণ হরিণের মাংস। আটক হয়েছে ২২ হরিণ শিকারিসহ হরিণ ধরা ফাঁদ ও ট্রলার। সুন্দরবনের কচিখালি এখন হরিণ পাচারের নিরাপদ রুট। হরিণ পাচার প্রতিরোধে বনরক্ষীদের ভূমিকা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
শিকারিদের ফাঁদে আটক হওয়ার পর সুন্দরবনের ভেতরেই হরিণ হত্যা করা হয়। এরপর খণ্ড খণ্ড করে মাংস প্রস্তুত করে বিক্রি করার জন্য লোকালয়ে আনা হচ্ছে। ধরা না পড়লে জানার উপায় নেই সুন্দরবনে কী পরিমাণ হরিণ নিধন হচ্ছে।পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনে সবচেয়ে বেশি দেখা মেলে হরিণের। বিশেষ করে সুন্দরবনের ঘাসবনে এই হরিণ সহজে চোখে পড়ে। কেউ দলে, কেউ আসে একা একা। সোনালি থেকে লালচে বাদামি দেহের ওপর ছোপ ছোপ গোলাকার সাদা ফোঁটা থাকে। যার কারণে এ হরিণের নাম দেওয়া হয়েছে চিত্রা হরিণ। সুন্দরবনে পর্যটন স্পটে এখন হরহামেশাই হরিণ দেখতে পান পর্যটকেরা। মানুষের শব্দ পেলেই ঘন বনে লুকোবার চেষ্টা করে লাজুক এ প্রাণী।

হরিণের নিয়মিত যাতায়াতের পথে ফাঁদ পাতেন শিকারিরা। যাতায়াতের সময় হরিণগুলো আটকে যায়। এক রাতে পেতে আসা হয় ফাঁদ। পরের রাতে গিয়ে আবার দেখা হয়। যেসব এলাকায় হরিণের বিচরণ বেশি সেসব স্থানে নাইলনের জাল পেতে, বিষ মাখিয়ে, স্প্রিং বসানো ফাঁদ পেতে, কলার সঙ্গে বড়শি ঝুলিয়ে, চেতনানাশক ওষুধ দিয়ে ও তীর অথবা গুলি ছুড়ে হরিণ শিকার করা হয়।

মাছ ধরার পারমিট নিয়ে হরিণ শিকারিরা রাতের আঁধারে গোপনে বনে ঢোকেন। নাইলনের দড়ির এক ধরনের ফাঁদ ব্যবহার করেন তারা। হরিণের নিয়মিত যাতায়াতের পথে এগুলো পাতা হয়। যাতায়াতের সময় হরিণগুলো আটকে যায়। এক রাতে ফাঁদ পেতে আসা হয়। পরের রাতে গিয়ে আবার ফাঁদ দেখা হয়। অনেক সময় এসব ফাঁদে আটকে হরিণ মারাও যায়। আবার অনেক সময় ফাঁদে পা আটকে জালে জড়িয়ে থাকে।

এসব ফাঁদ বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে হিরণ পয়েন্ট, দুবলার চর, বঙ্গবন্ধুর চর, কটকা, তালপট্টি, কচিখালি, দুবলা চান্দেরশ্বর, বগি, চরখালি এলাকায়। বিভিন্ন উপলক্ষে চোরা শিকারিদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায় এসব এলাকায়। শিকারিরা বনের ভেতর থেকে হরিণ শিকার করে এনে লোকালয়ে থাকা সহযোগীদের হাতে পৌঁছে দেন। বিভিন্ন জায়গায় হাতবদল হয়ে হরিণ পৌঁছে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে।

গত তিন মাসে সুন্দরবন বিভাগ ও কোস্ট গার্ড সদস্যরা পৃথক অভিযান চালিয়ে ৬৪১ কেজি হরিণের মাংস জব্দ করেছেন।
এ সময় শিকারিদের কাছ থেকে হরিণের মাথা, চামড়া, মৃত হরিণ, হরিণের পা, ফাঁদ এবং নৌকা ও ট্রলার জব্দ করা হয়। হাতেনাতে ২২ জনকে আটক করা হয়েছে। মাঝেমধ্যে হরিণের মাংস জব্দ এবং শিকারিচক্রের সদস্যরা আটক হলেও থামছে না হরিণ শিকার। এভাবে হরিণ শিকার চলতে থাকলে সুন্দরবন একসময় হরিণসংকটে পড়তে পারে।

স্থানীয় জেলেরা বলছেন, হরিণ শিকার রোধ করতে হলে কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ করতে হবে এবং শিকারিদের চিহ্নিত করে তাদের বিকল্প পেশায় ফেরাতে হবে। বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবনে বাঘ শিকারের চেয়েও হরিণ শিকার ভয়ংকর। বাঘের প্রধান খাবার হরিণ। তাই হরিণ না থাকলে সুন্দরবনে বাঘ থাকবে না।সম্প্রতি সুন্দরবনে হরিণের সংখ্যা বেড়েছে। সুন্দরবনের প্রতিটি কোনায় এখন হরিণ দেখা যায়। হরিণকে প্রায়ই বনের খাল বা নদীর ধারে দল বেঁধে চলাফেরা করতে দেখা যায়। সুন্দরবনে দুটি প্রজাতির হরিণ রয়েছেÑ মায়া ও চিত্রা। তবে চিত্রা হরিণের সংখ্যাই বেশি। এই হরিণ শিকার বন্ধ করার জন্য অভিজ্ঞ মহল শেষমেশ নিরুপায় হয়ে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করছে, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) ডিসেম্বর ২০২৩ সালের একটি সমীক্ষা অনুসারে, বর্তমানে সুন্দরবনে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬০৪টি হরিণ রয়েছে। এর আগে ২০০৪ সালে হরিণের সংখ্যা ছিল ৮৩ হাজার। সেই হিসাবে ১৯ বছরের ব্যবধানে সুন্দরবনে হরিণ বেড়েছে ৫৩ হাজার ৬০৪।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্থানীয় পদ্ধতিতে হরিণের মাংস, চামড়া, মাথাসহ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংরক্ষণ করে পাচার করে চোরা শিকারিরা। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে এজেন্ট-ব্যবসায়ীদের। এই এজেন্টদের মাধ্যমে কখনো অগ্রিম অর্ডার, আবার কখনো মাংস এনে তারপর বিক্রি করা হয়। এই চক্রের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যায় হরিণের মাংস।
ক্রেতারাও অনেক সময় প্রতারণা ভেবে হরিণ নিজ চোখে না দেখে মাংস কিনতে চান না। তাই চোরা শিকারিরা জীবন্ত হরিণ লোকালয়ে এনে জবাই করেন। সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় প্রতি কেজি হরিণের মাংস ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় পাওয়া যায়।
তবে জেলা শহরে প্রতি কেজি হরিণের মাংসের দাম ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত। আর আস্ত একটি জীবিত হরিণের দাম চাওয়া হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। অবৈধ জেনেও হরিণের মাংস কেনেন মানুষ।

সুন্দরবন পূর্ব ও পশ্চিম বিভাগ এবং মোংলা কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোনের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত পৃথক অভিযান চালিয়ে ৬৪১ কেজি হরিণের মাংস, একটি জবাই করা হরিণ, একটি মৃত হরিণ, হরিণের দুটি চামড়া, দুটি মাথা, আটটি পা, চারটি ট্রলার, পাঁচটি নৌকা, ১৬০টি ফাঁদ, একটি মাইক্রোবাস, সাতটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।
এ সময় ২২ জনকে আটক করা হয়েছে। এ ঘটনায় ২৫টি মামলা করা হয়।

বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলাধীন সুন্দরবনসংলগ্ন শরণখোলা গ্রামের জেলে ও কমিউনিটি প্যাট্রলিং গ্রুপের (সিপিজি) সদস্য জামাল গাজীর তথ্য মতে, শরণখোলা উপজেলায় প্রায় ১০০ জন হরিণ শিকারি রয়েছে। কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি হরিণ শিকারিচক্রের সঙ্গে জড়িত। শিকারিরা অবৈধভাবে সুন্দরবনে প্রবেশ করে ফাঁদ পেতে হরিণ আটক করছে। এরপর সুন্দরবনের মধ্যে হরিণ জবাই করে মাংস প্রস্তুত করে বিক্রির জন্য লোকালয়ে নিয়ে আসে। এভাবে হরিণ শিকার চলতে থাকলে একসময় সুন্দরবনে হরিণসংকট তৈরি হবে।

শিকারিদের নাম প্রকাশ না করার শর্তে জামাল গাজী জানান, বিভিন্ন সময় তিনি নিজে শিকারিদের সঙ্গে কথা বলে সুন্দরবনে হরিণ শিকার না করার জন্য অনুরোধ করেছেন। এতে শিকারিরা তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে হুমকি দিয়েছে।

জামাল গাজী আরো জানান, সুন্দরবনে হরিণ শিকার বন্ধ করতে হলে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং তার যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। একই সঙ্গে তালিকা করে তাদের বিকল্প পেশায় যুক্ত করা গেলে হরিণ শিকার বন্ধ করা সম্ভব হবে বলে তিনি মনে করেন।

সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মুহাম্মদ নূরুল করিম জানান, হরিণ শিকার ঠেকাতে বন বিভাগের সদস্যরা সার্বক্ষণিক সতর্ক অবস্থায় রয়েছেন। বন বিভাগের কেউ শিকারিদের সঙ্গে আপস করবে না। বন বিভাগের টহলের পাশাপাশি স্মার্ট প্যাট্রলিং বাড়ানো হয়েছে। বিশেষ করে সুন্দরবনসংলগ্ন দাকোপ, চাঁদপাই, শরণখোলা, মোংলাসহ বেশ কয়েকটি পয়েন্ট বন বিভাগের নজরদারিতে রয়েছে।

সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) এ জেড এম হাসানুর রহমান জানান, হরিণ শিকার ঠেকাতে সুন্দরবনের বিভিন্ন পয়েন্টে সন্দেহজনক নৌকা বা ট্রলারে তল্লাশি করা হয়। শিকারিদের ধরতে বিভিন্ন সময় বনে অভিযান পরিচালনা করা হয়। বনের বিভিন্ন পয়েন্টে বন বিভাগের টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে।বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ও ওয়াইল্ড টিমের প্রধান নির্বাহী অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, “সুন্দরবনসংলগ্ন গ্রামের মানুষকে সুন্দরবনের সম্পদ রক্ষায় সম্পৃক্ত করতে হবে। মানুষকে বোঝাতে হবে যে হরিণ বাঘের খাবার, নিজেরা হরিণ খাব না। হরিণের মাংসের চাহিদা বন্ধ করতে হবে। চাহিদা বন্ধ করা না গেলে সরবরাহ বন্ধ হবে না। রাজধানী ঢাকায়ও হরিণের মাংস পাওয়া যায়। সুন্দরবন থেকে এত পথ অতিক্রম করে কিভাবে যে ঢাকায় হরিণের মাংস পৌঁছে যায়, তা ভাবতেও কষ্ট হয়। এ অবস্থায় ‘হরিণের মাংসকে না বলি’—এমন স্লোগান বাস্তবায়ন করা জরুরি।”

অধ্যাপক কাদির বলেন, বন্যপ্রাণী শিকার নিষিদ্ধ হলেও আইন অমান্য করে সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ চিত্রা হরিণ শিকার করছে কয়েকটি চক্র। যে পরিমাণ হরিণের মাংস ও চামড়া আটক হয়, তার থেকে কয়েক গুণ বেশি পরিমাণ হরিণ শিকার করা হয়।
মাঝে-মধ্যে দুই একটি অভিযানে হরিণের মাংস, চামড়া, মাথা উদ্ধার হলেও মূল চোরা শিকারি ও পাচারকারীরা আটক হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে হরিণের মাংস বহনকারীরাই ধরা পড়ে। আর যারা আটক হয়, তারা দুর্বল আইনের কারণে কয়েক দিন পর জেল থেকে ফিরে একই কাজে লিপ্ত হয়। খুলনা অঞ্চলের প্রধান বন কর্মকর্তা মিহির কুমার দো বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বনের জীববৈচিত্র্যে পরিবর্তন এসেছে। সুন্দরবনে গেলে এখন এমন হরিণ দেখতে পাবেন, যা আগে ছিল না। হরিণের সঙ্গে বাঘও দেখতে পাচ্ছেন সুন্দরবন দর্শনার্থীরা।
তিনি বলেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বন বিভাগের নিয়মিত টহল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বন বিভাগের নিয়মিত টহল এবং বনে দস্যু কমার পাশাপাশি রাসমেলা বন্ধ হওয়ার কারণে হরিণ শিকার আগের তুলনায় অনেকাংশে কমেছে।
বনে সারা বছরই দস্যুরা এবং বছরের শেষের দিকে দুবলারচরে রাসমেলায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ আসত। ওই সময় বিপুল পরিমাণ হরিণ শিকার করা হতো। অল্প লোকবল দিয়ে এত মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব হতো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *