তরুণদেরকে দেশ ও জাতির খেদমত করার সুযোগ করে দিতে চাই ও নারী সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট বাতিল করার অনুরোধ: জামায়াত আমির

বিশেষ প্রতিনিধি:
জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা: শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘আমরা তরুণদেরকে দেশ ও জাতির খেদমত করার সুযোগ করে দিতে চাই।’ এ সময় তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে তাদের সদিচ্ছা এবং সক্ষমতা প্রমাণ দেয়ার আহ্বান জানান। বলেন, ‘এতে যদি জনগণ সন্তুষ্ট হয় তাহলে পরবর্তী সময়ে আপনাদের পূর্ণ সমর্থন দেবো।’ প্রধান উপদেষ্টাকে দেশে ফিরে বিলম্ব না করে সবার আগে নারী সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট বাতিল করার অনুরোধও জানান তিনি। শুক্রবার (২৫ এপ্রিল) সকালে ময়মনসিংহ নগরীর সার্কিট হাউজ মাঠে ময়মনসিংহ জেলা ও মহানগর জামায়াতের কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

জামায়াতের আমির বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন বলেছে তারা নাকি ইতিহাসের সবচেয়ে ভালো একটা নির্বাচন উপহার দেবেন। আমরা তাদের একটি এসিড টেস্ট দেখতে চাই। তারা জাতীয় সংসদের নির্বাচন যেটা দিয়ে দেশ শাসন হবে পাঁচ বছরের জন্য জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে, সেই নির্বাচনের আগে জনগণ এখন সাফার করছে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিনিধি না থাকার কারণে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনটা দিন। আমরা দেখি আপনাদের সদিচ্ছা ও সক্ষমতা কতটুকু। এটার প্রমাণ আপনারা পেশ করুন। যদি এতে জনগণ সন্তুষ্ট হয় জনগণের পরবর্তী সময়ে খেদমতের জন্য জনগণ আপনাদের পূর্ণ সহযোগিতা দেবো। আর এখানে কোনো কিছু ধরা পড়ে তাহলে জনগণ আপনাদের হলুদ নয় লাল কার্ড দেখাবে।’

ডা: শফিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠীকে সুবিধা দেয়ার কোনো ধরণের সুপারিশ আমরা মানবো না। আমরা জনগণকে ১৮ কোটি মানুষকে সুবিধা দেয়ার যত সুপারিশ আছে তাই মানবো। সকালের কাছে আমাদের অনুরোধ নিজেকে গড়ুন। ঘরে ঘরে ন্যায় এবং সত্যের আওয়াজ পৌঁছে দিন। জনগণকে অসত্য ও অফরাধের বিরুদ্ধে সংগঠিত করুন। এটা বিচিত্র নয়, শুধু বক্ততায় নয়, হয়তোবা অপরাধীদেরকে দমন করার জন্য সরকারি সংস্থার সাথে সহযোগিতা করে আমাদের সবাইকে রাস্তায় নামতে হতে পারে।’ তার জন্য তৈরি হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

তিনি বলেন, ‘আমরা এমন একটি বাংলাদেশ চাই। যে বাংলাদেশে কোনো ধরনের জুলুম হবে না, শোষণ হবে না, নিপীড়ন হবে না, নতুন কোনো ফ্যাসিবাদের জন্ম হবে না। এমন একটি বাংলাদেশ চাই যেখানে মানুষে মানুষে কোনো বৈষম্য থাকবে না। দুর্নীতিতে আর চ্যাম্পিয়ন হবো না। দুর্নীতির কোনো দুর্গন্ধ থাকবে না। বিচারের বাণী আর নিভৃতে কাঁদবে না।’ তিনি বলেন, ‘আসুন আল্লাহ তালার কাছে প্রার্থনা করি অতীতের পচাঁগলা রাজনীতিতে নয়, বরঞ্চ নতুন রাজনীতির উত্থান হোক।’

এসময় তরুণদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘দুনিয়ার সমস্ত পরিবর্তন হয়েছে তরুণদের ওপর ভর করে। তাদের বাহুর ওপর ভর করে। এমনকি জুলাই-আগস্ট বিপ্লবও হয়েছে তরুণদের নেতৃত্বে। তোমরা যে আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন নিয়ে জীবন দেয়ার জন্য রাস্তায় নেমে এসেছিলে তোমাদের বহু সাথী চলে গেছেন। আল্লাহ তোমাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। তোমরা এই লড়াই থেকে বিশ্রাম নিও না। যতদিন পর্যন্ত তোমাদের ন্যায্য দাবিগুলো প্রতিষ্ঠিত না হবে। তোমরা হবে আমাদের আগামীর নেতা। ইনশাআল্লাহ আমরা হবো তোমাদের সহকর্মী। এমন একটি বাংলাদেশ গড়ে তোমাদের হাতে আমরা উপহার দিয়ে তোমাদেরকে দেশ ও জাতির খেদমত করার সুযোগ করে দিতে চাই।’ তিনি আরো বলেন, ‘সোনার মানুষ গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই। সমাজে ন্যায়বিচার কায়েম করতে হলে নিজের উপর ইনসাফ তৈরি করতে হবে। আল্লাহকে ভয় করতে হবে। আমাদের যদি দোষ-ত্রুটি থাকে তাহলে মানবিক বাংলাদেশ গড়বে কে? এজন্য দলমত নির্বিশেষে যারা দেশকে ভালোবাসেন, যারা আল্লাহকে ভালোবাসেন, যারা মহানবীকে ভালোবাসেন, যারা দেশের সমস্ত মানুষকে ভালোবাসেন তাদের প্রতি আমাদের অনুরোধ, আসুন আগে নিজেকে গড়িতার সাথে দেশ গড়ার কাজও হয়ে যাবে।’ জামায়াত আমির বলেন, ‘বর্তমানে দেশ যেভাবে চলছে অনেক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন আপনারা কী সন্তোষ্ট? আমরা বলি ফিফটি ফিফটি। দেশের সরকার হয়তো চেষ্টা করছে। সকলের দৃষ্টিশক্তি সবার সমান না। এটা কোনো দলীয় আদর্শের সরকারও না। কেউ কেউ টানে মক্কার দিকে আবার কেউ কেউ টানে মস্কোর দিকে। এই দু’টানা অবস্থায় জাতির মাঝে মাছে বড় ক্ষতি হয়ে যায়। মাঝে মাঝে এ ধরনের কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশের মুখোমুখি আমাদেরকে হতে হয়।’ নারী অধিকার সংস্কার বিষয়ক রিপোর্টের কথা উল্লেখ করে জামায়াত আমির বলেন, ‘নারী অধিকার সংস্কারের রিপোর্টের বেশ কিছু জায়গায় কুরআন ও সুন্নাহর সম্পূর্ণ খেলাপ কিছু সুপারিশমালা পেশ করা হয়েছে। আমাদের প্রথম কথা হচ্ছে, যে কয়েকজন এই সুপারিশ পেশ করেছেন তারা এদেশের সাড়ে নয় কোটি মায়ের প্রতিনিধিত্ব করেন না। তারা সমাজকে যে জায়গায় নিয়ে যেতে চান, আমরা সে জায়গায় তাদেরকে নিতে দেব না ইনশাআল্লাহ। এদেশের মানুষের একটা সংস্কৃতি একটা তাহযীম তাহাজ্জত আছে। তার বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে আঘাত করলে পুরো শৃঙ্খলা তছনছ হয়ে যাবে। এটা আমরা মানব না। এটা আমরা মানতে পারি না। আমরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে অনুরোধ করব, আপনি দেশে ফিরে বিলম্ব না করে আগে এই কাজটা বাতিল করেন। আর যদি এরকম কোনো কমিশন করতে হয় তাহলে সকল শ্রেণী-পেশার দল ও আদর্শের মানুষকে নিয়ে করতে হবে। সেখানে ঈমানদার নারীদেরও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। যারা কোরআন হাদিসের পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন। তার পরে দেখা যাবে কি আসে। তখন আমরা বিবেচনা করব।’

তিনি দ্রব্যমূল্য নিয়ে বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য রমজানে সহনীয় ছিল। মানুষ কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছিল। এখন আবারো উত্তপ্ত হচ্ছে। আমরা সরকারকে বলবো সেদিকে নজর দেন। সমাজে শৃঙ্খলা বিনষ্টের যারা কারণ তাদেরকে পাকড়াও করুন। যারা জুলাই-আগস্টে গণহত্যা করেছে তাদের কাউকে আইনের বাইরে রাখবেন না। তাদের বিচার নিশ্চিত করুন। বিগত সরকার যে জঞ্জাল সাড়ে ১৫ বছরে সৃষ্টি করেছে তার পর্যাপ্ত ন্যায়ানুগ সংস্কার সাধন করুন। কালো টাকা এবং পেশীশক্তি থেকে বের হয়ে আসার জন্য সমস্ত মানুষের ভোট এবং সঠিক প্রতিনিধিত্ব সংসদে নিশ্চিত করার জন্য পিয়ার সিস্টেমের ভোট নিশ্চিত করতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা শুনতে পাচ্ছি, সংসদ দুই কক্ষ বিশিষ্ট করার প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে। নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ। মূল কর্তৃত্ব থাকবে নিম্নকক্ষের হাতে। সেটা হবে বর্তমান সিস্টেমে আর উচ্চ করা হয়েছে পিয়ার সিস্টেমে। উচ্চকক্ষ যদি পিয়ার সিস্টেমে হয় তাহলে নিম্নকক্ষ নয় কেন? একই দেশে দুই পদ্ধতির প্রয়োজনটা কী? দুনিয়ার ৬২টা দেশ পিয়ার সিস্টেমে নির্বাচন করে।’
সম্প্রতি ইউরোপ সফরের কথা উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, “ইউরোপের ২৬টা দেশের মধ্যে ১৬টা দেশ পিয়ার সিস্টেমে নির্বাচন করে। তারা যদি এর সুফল যুগ যুগ ধরে পেয়ে থাকে তাহলে এই সুফল থেকে জাতিকে বঞ্চিত করার আমরা কে? সুতরাং এই অধিকার জাতির হাতে তুলে দিতে হবে। এটা যারা মানবেন না তারা হলো ‘বিচার মানি তালগাছটা আমার’। আমরা বলবো বিচার মানুন রায়ে তালগাছ যার তার কাছে চলে যাবে। এবং সেই বিচারটা হতে হবে ন্যায়বিচার।”

ডা: শফিকুর রহমান বলেন, ‘অতীতে যা চলেছে এখনো যদি তা-ই চলে তাহলে এত রক্ত কেন ঝরলো? এত জীবন কেন গেল? এই জাতির কাছে আমরা কিভাবে মুখ দেখাব?’ ‘জঞ্জাল, কলুষ, দুঃশাসন ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য প্রয়োজনে আরেকবার জীবন দিয়ে লড়াইয়ের জন্য আমরা প্রস্তুত থাকব,’ বলেন তিনি। জামায়াত আমির বলেন, ‘এ দেশ থেকে ২৮ লাখ কোটি টাকা আওয়ামী লীগ, তাদের দোসর ও প্রশাসনে কিছু কর্মকর্তা লুট করে নিয়ে গেছে। এ টাকা দেশের বাজেটের প্রায় ৪-৫ গুণ।’ এ টাকা জনগণের তহবিলে যোগ করার জন্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ বিদেশী প্রতিনিধিদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। জেলায় প্রথমবারের মতো উন্মুক্ত স্থানে জামায়াতের এই কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। হাজারো নেতাকর্মীর অংশগ্রহণে সকাল ৯টায় সম্মেলন শুরু হয়ে বেলা ১২টায় শেষ হয়। কর্মী সম্মেলন উপলক্ষে গোটা নগরী মিছিলে মিছিলে আর স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে। সর্বত্রই আলোচিত হয় এ সম্মেলন। মহানগর জামায়াতের আমির কামরুল আহসান এমরুলের সভাপতিত্বে সম্মেলনে আরো বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগীয় সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সেক্রেটারি ড. ছামিউল হক ফারুকী, জেলা জামায়াতের আমির আব্দুল করিম, ময়মনসিংহ জেলা নায়েবে আমির অধ্যক্ষ কামরুল হাসান মিলন, মহানগর নায়েবে আমির আসাদুজ্জামান সোহেল, কিশোরগঞ্জ জেলা আমির অধ্যাপক রমজান আলী, নেত্রকোনা জেলা আমীর অধ্যাপক সাদেক আহমেদ হারিছ, জামালপুর জেলা সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট আবদুল আওয়াল, ছাত্রশিবির সাবেক সভাপতি হাফেজ রাশেদুল ইসলাম, ময়মনসিংহ মহানগর সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক আল হেলাল তালুকদার, জেলা কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা বদরুল আলম, সনাতন ধর্মাবলম্বী নেতা উত্তম ভট্টাচার্য, মহানগর ছাত্রশিবির সভাপতি শরিফুল ইসলাম খালিদ, জেলা শিবির সভাপতি এমদাদুল ইসলাম, জুলাই শহীদ সাগরের বাবা আসাদুজ্জামান আসাদ, জুলাই শহীদ মাহিনের বাবা জামিল হোসেন সোহেলসহ বিভিন্ন উপজেলা ও সাংগঠনিক থানা আমির ও ছাত্রশিবির নেতারা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *