সুন্দরবনে উপকূলে অভয়ারণ্যে বন কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করে বিষ দিয়ে মাছ শিকার জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে

এস.এম. সাইফুল ইসলাম কবির, সুন্দরবন থেকে ফিরে:বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের মৎস্যভান্ডার নামে খ্যাত বিভিন্ন নদী ও খালে পরিবেশ বিধ্বংসী নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই বিষ প্রয়োগে মাছ শিকার চলছে। এতে বনের ভেতরে থাকা অভয়ারণ্যে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও মাছের পোনা প্রতিনিয়ত ধ্বংস হচ্ছে।

ফলে বনের জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে। এতে বনের মৎস্য সম্পদ ও জলজসহ বিভিন্ন প্রাণীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, এক শ্রেণির অসাধু বনরক্ষীদের নিয়মিত মাসোহারা দিয়ে জেলেরা বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকার করছেন। এ জন্য ট্রলার প্রতি ১০ হাজার এবং নৌকা প্রতি ৫ হাজার টাকা গুনতে হয় তাদের।

বন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে তারা অভয়ারণ্যের খালে বিষ দিয়ে অল্প সময়ে অধিক মাছ শিকার করে থাকেন। এ ছাড়া জেলেদের শিকার করা মাছ নিরাপদে লোকালয়ে পৌঁছাতেও টাকা দিতে হয় স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। মাঝেমধ্যে ২-১ জন ধরা পড়লেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় অপরাধচক্রটি দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের ৩১ শতাংশ জায়গাজুড়ে রয়েছে জলাভূমি। বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের বৃহৎ অংশজুড়ে রয়েছে মৎস্যসম্পদ। জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে ৪৫০টি নদ-নদী। এসব নদনদীতে রয়েছে ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ।

এর মধ্যে রয়েছে ২৬ প্রজাতির চিংড়ি ও ১৩ প্রজাতির কাঁকড়াসহ অসংখ্য জলজ প্রাণী। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে বনবিভাগের কিছু অসাধু বনরক্ষী ও কর্মকর্তা উৎকোচের বিনিময়ে এসব দেখেও না দেখার ভান করেন। ফসলের পোকা দমনে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক দিয়ে এসব মাছ শিকার করা হয়। এর মধ্যে ডায়মগ্রো, ফাইটার, রিপকর্ড ও পেসিকল নামক কীটনাশকই বেশি ব্যবহার করেন জেলেরা।

সরকার প্রতি বছর এই মৎস্যসম্পদ থেকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় করে থাকে। কিন্তু কিছু অসাধু জেলে কম পরিশ্রমে অধিক মুনাফার আশায় বৈধভাবে পাস পারমিট নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করেন। কিন্তু বনের অভ্যন্তরে প্রতিটি খালে ও নদীতে পরিবেশ বিধ্বংসী বিষ প্রয়োগে করে মাছ শিকার করছেন। এমনকি মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে খ্যাত নিষিদ্ধ খালেও।

অভিযোগ রয়েছে, আর্থিক চুক্তিতে এ কাজে সহযোগিতা করছেন বন বিভাগের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারী।

সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত তিন মাসের জন্য সুন্দরবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এ সময় বনের নদী-খালে মাছ ও কাঁকড়া ধরার পাশাপাশি পর্যটক প্রবেশেও নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার।

এই বন্ধ মৌসুমে সুন্দরবনে খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে গেল তিনমাসে ১১৬টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ সময় ১২৪ জেলেকে আটক করা হয়েছে।

জানা যায়, নিষিদ্ধ সময়ে সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জ অবৈধ প্রবেশের দায়ে ২৭টি পিওআর মামলা, ৩৪টি ইউডিওআর মামলা ও ১টি সিওআর মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ সময় ২৩ জন আসামিকে আটক করা হয়। এ ছাড়া একটি ইঞ্জিনচালিত ট্রলার, ৬৩টি নৌকা, ৪টি মোটরসাইকেল, ১৬ কেজি হরিণের মাংস, ৬৩৯ কেজি চিংড়ি-সাদা মাছ, ৩৫ কেজি শুঁটকি চিংড়ি, ১৯০ কেজি কাঁকড়া, ৬০০টি হরিণ ধরার ফাঁদ ও ১৪টি বিষের বোতল জব্দ করা হয়েছিল।

সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জ থেকে গত তিনমাসে ৮টি ইঞ্জিনচালিত ট্রলার, ১৩০টি নৌকা এবং অবৈধ কাঁকড়া পরিবহনকালে একটি পিকআপভ্যান জব্দ করা হয়। এ সময় ১০১ জনকে আটক করা হয়েছে। ৭টি পিওআর মামলা, ৩১টি ইউডিওআর মামলা এবং ১৬টি সিওআর মামলা দায়ের করা হয়েছিল।

জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মধ্য ভাটার সময় খালের একপাশে জাল পেতে অন্যপাশে বিষ দেওয়া হয়। বিষক্রিয়ায় কিছুক্ষণের মধ্যে মাছগুলো ছটফট করতে করতে দুর্বল হয়ে ভাসতে ভাসতে জালে এসে আটকা পড়ে। এ কাজে সাধারণত রিপকট, ক্যারাটে, হিলডন, ওস্তাদ ও বিষ পাউডারসহ বিভিন্ন বিষ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

মোরেলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, বিষমিশ্রিত মাছ খেলে সাধারণত মানুষের কিডনি, হার্ট ও লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। দীর্ঘদিন এভাবে চলতে থাকলে একসময় কিডনি ও লিভার নষ্ট হয়ে যায়। বিষমিশ্রিত পানি খেলে বিভিন্ন প্রাণীরও একই সমস্যা হতে পারে। তবে প্রাণীর ক্ষেত্রে দ্রুত প্রভাব পড়ে।

এ বিষয়ে মোরেলগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা রণজিৎ কুমার জানান, যে খালে বা জলাশয়ে বিষ প্রয়োগ করা হয়, সে খালে কমপক্ষে তিন থেকে পাঁচদিনের মধ্যে কোনো মাছ প্রবেশ করতে পারে না। আর এভাবে চলতে থাকলে একসময় এসব খালে মাছের স্বাভাবিক প্রজনন কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হয়।

পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) দ্বীপন চন্দ্র দাস বলেন, ‘এ পর্যন্ত বেশ কয়েকজন জেলের জাল ও নৌকা জব্দ করা হয়েছে। কিন্তু কোনো জেলেকে আটক করা যায়নি।’

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষক অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, ‘বিষ প্রয়োগ করলে ছোট-বড় সব প্রজাতির মাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মাছের পোনা মারা যায়। এ ছাড়া বিষমিশ্রিত পানি ভাটার টানে যখন গভীর সমুদ্রের দিকে যায়, তখন সেই এলাকার জলজ প্রাণীও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’

তিনি বলেন, ‘এ ছাড়া আশপাশের মাটিতে মিশে বিষের প্রভাব দীর্ঘ সময় থাকে। ফলে জলজ প্রাণীদের প্রজনন ক্ষমতা কমে যাওয়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দিন দিন জলজ প্রাণীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। পাখি ও বড় যেসব প্রাণী আছে, যারা এসব মাছ খেয়ে বেঁচে থাকে, তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে মাছ, পাখি ও মাছের ওপর নির্ভরশীল অন্যান্য প্রাণীদের জীবনচক্রের পরিবর্তন আসছে।’

এ ব্যাপারে কথা হয় সাতক্ষীরা সহকারী বোন সংরক্ষক মশিউর রহমানের সাথে। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জ এলাকায় বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকার চলছে, এটা সত্য। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি, এটা নিয়ন্ত্রণ করার।’

তিনি আরও জানান, সুন্দরবনে বিষ প্রয়োগের কীটনাশক ভেটখালী বাজার, হরিনগর বাজার, শ্যামনগর বাজার, বংশীপুর বাজার, মুন্সিগঞ্জ বাজার, নওয়াবেকি বাজার, বুড়ি গোয়ালিনি বাজার, পাতাখালী বাজার, বাবুরা বাজার, ডুমুরিয়া বাজার, চাঁদনীমুকা বাজার ও ঘড়িলাল বাজার থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী আছে, ১০০ টাকার কীটনাশক ২০০ টাকায় বিষ প্রয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করছে।

তিনি বলেন, বিষ প্রয়োগকারীরা অনেক সময় নিজেরা এই কীটনাশক বহন করেন না। তাদের নিয়োজিত ভাড়ার মোটরসাইকেল অথবা কীটনাশক ব্যবসায়ীরা ফোন করলে তাদের দায়িত্বে কীটনাশক এই অসাধু ছেলেদের বাড়িতে পৌঁছে দেয়। এই সমস্ত অসাধু কীটনাশক বিক্রি যারা করে, তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নিতে বনবিভাগসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবাইকে উদ্যোগ নিতে হবে। সেই সাথে উদ্যোগ নিতে হবে সমাজের বিবেকবান মানুষের।

সুন্দরবন শুধু বন বিভাগের নয় উল্লেখ করে এই কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের অধিকার রয়েছে সুন্দরবনের ওপর। সে কারণে সবাইকে এই অপরাধ প্রতিরোধের জন্য এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে আমাদের সুন্দরবনের জাতীয় মৎস্যসম্পদ রক্ষা পাবে। তা না হলে অচিরেই সুন্দরবনে মৎস্যসম্পদ নষ্ট হয়ে যাবে।

অভিযোগ করে মশিউর বলেন, ‘আমরা বিষ প্রয়োগকারীদের ধরে মামলা দিয়ে জেলহাজতে পাঠালে আইনের ফোকর দিয়ে অপরাধীরা থেকে মুক্তি পেয়ে যায়।’

সুন্দরবনে বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকার প্রসঙ্গে জলবায়ু পরিবেশ ও বন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়া হাসান বলেন, ‘সুন্দরবনের সব খালের মাথায় একজন করে লোক দাঁড় করে রাখার মতো জনবল তো আমাদের নেই। জনগণ নিজেরাই সুন্দরবনের সম্পদ নষ্ট করলে আমরা কী করে রক্ষা করব।’

তিনি বলেন, ‘কয়রা বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জসহ সুন্দরবন এলাকায় অনেক খাল রয়েছে। একটা খালকে পাহারা দেওয়া যায়। শ শ খাল কে পাহারা দেবে? মানুষ যদি নিজেরা ঠিক না হয়। রাজহাঁস সোনার ডিম পাড়বে, ওরা সেই রাজহাঁসটাকেই মেরে খেয়ে নিতে চায়। তাহলে খাক তারা। আমি কী করব? এত বোঝালেও বোঝে না। শুধু বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ নয় সারা সুন্দরবনে সব জায়গায় বিষ দিয়ে মাছ শিকারের সমস্যা রয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘যে সমস্ত দুষ্কৃতী মহল বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের নদী-খালে বিষ প্রয়োগ করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া আছে। তারা যেন আর কখনো সুন্দরবনে প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য তাদের বিএলসি বাতিলের নির্দেশ দেওয়া আছে। সেই নির্দেশ মোতাবেক বন বিভাগ কাজ করবে।’

এই উপদেষ্টা বলেন, ‘তারপরও সুন্দরবন দেখার দায়িত্ব শুধু বন বিভাগের নয়, বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের সুন্দরবন রক্ষার ও সুন্দরবনের নদী-খালে বিষ প্রয়োগকারীদের রুখে দেওয়ার দায়িত্ব রয়েছে। আসুন, সবাই সুন্দরবনে হরিণ শিকার, বিষ দিয়ে মাছ শিকারকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই।##

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *