যুবদল-যুবলীগ মিলেমিশে ঠিকাদারি, সাংবাদিকদের দেখে নেওয়ার হুমকি

পটুয়াখালী প্রতিনিধি:
পটুয়াখালীর জেলা যুবদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঠিকাদার মো. হুমায়ুন কবির সোহাগের বিরুদ্ধে সাংবাদিককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকির অভিযোগ উঠেছে। সোমবার দুপুর দেড়টার দিকে তার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের চলমান কাজের তথ্য জানতে চাইলে এমন হুমকি দেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এ ধরনের একটি অডিও ফাঁস হলে মুহূর্তেই তা ভাইরাল হয়।

হুমকি পাওয়া সাংবাদিকের নাম মো. সিদ্দিকুর রহমান। তিনি পটুয়াখালীর বাউফল রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি ও দেশ রূপান্তরের উপজেলা প্রতিনিধি। অডিওতে যুবদল নেতাকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি জেলা যুবদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ১৭ বছর পর একটি কাজ পেয়েছি। তুই কাজের সাইডে গেলি ক্যান। কীসের জন্য যাবেন? অনিয়ম করলে অফিস দেখবে, আপনি কেন যাবেন। আপনি কি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার? সাংবাদিকদের কাজ কি সাইডে। সাইডে খোট খাইতে যাও? আমি আসতেছি তুই ওখানে থাক। খোট খাওয়াইতে আছি তুই থাক। তুই অফিসে যোগাযোগ কর। সাইডে গেলে তোকে কি করতে হবে, সেটা দেখাইতেছি।’ শেষে ‘তুই থাক আমি বাউফল আসতেছি তুই থাক। তোকে দেখে নেব’ বলে ফোন কেটে দেন অভিযুক্ত যুবদল নেতা।

পটুয়াখালীর বাউফল পৌর শহরে পশ্চিম নূরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় এ কাজের ব্যয় ধরা হয়েছে ১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। প্রকল্পের আওতায় বহুতল ভবন নির্মাণের লক্ষ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে পাইলসহ দেড়তলা ভবন নির্মাণে টেন্ডার আহ্বান করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর।

নিয়মানুযায়ী মাটির ২০ ফুট নিচ পর্যন্ত ৭৯৯টি পাইল বসানোসহ বেইজ এবং ভবন নির্মাণ করবে ঠিকাদার। এরই মধ্যে অভিযোগ ওঠে, নির্ধারিত ৭৯৯টি পাইলের স্থলে ৬শরও কম পাইল করে তার ওপর চলছে বেইজ ঢালাই। এ বেইজ ঢালাইয়ের ক্ষেত্রেও করা হচ্ছে মারাত্মক অনিয়ম। বেইজের নিচে ৭৫ সেন্টিমিটার পুরু সিসি ঢালাই দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হচ্ছে ৪৫/৫০ সেন্টিমিটার করে। বালু-সিমেন্টের মিশ্রণেও চলছে ব্যাপক কারচুপি। এছাড়া সেন্টারিংয়ে স্টিল শিট ব্যবহারের কথা থাকলেও ব্যবহার করা হচ্ছে কাঠ ও বাঁশ। নির্মাণকাজে দুর্নীতির খবর পেয়ে সেখানে যান বাউফলের কয়েকজন সংবাদকর্মী। সরেজমিনে অনিয়মের প্রমাণ পেয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য তারা মোবাইল ফোনে কল করেন ঠিকাদার সোহাগকে। ফোনে না পেয়ে খুদে বার্তা দিয়ে রাখেন তাকে। এদিকে ঠিকাদারি সাইড থেকে সংবাদকর্মীদের সেখানে যাওয়ার খবর পান সোহাগ। দুর্নীতির বিষয়টি সংবাদকর্মীরা জেনে ফেলেছেন বুঝে ক্ষুব্ধ হন তিনি। পরে বাউফল রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি দেশ রূপান্তর প্রতিনিধি সিদ্দিকুর রহমানকে সোমবার মোবাইল ফোনে কল দিয়ে কেন সংবাদকর্মীরা নির্মাণস্থলে গেলেন, এর কৈফিয়ত চাওয়া হয়। ১৭ বছর পর একটি ঠিকাদারি কাজ পেয়েছেন উল্লেখ করে সাংবাদিককে দেখে নেওয়ারও হুমকি দেন। সেই সঙ্গে চলে গালাগাল। ওই অডিও রেকর্ড ভাইরাল হওয়ার পর খোঁজ নিতে গিয়ে বেরিয়ে পড়ে থলের বিড়াল।

বাউফল এলজিইডির সহকারী প্রকৌশলী আলী ইবনে আব্বাস বলেন, ‘ভাইরাল হওয়া অডিও রেকর্ডের বিষয়টি আমার কানেও এসেছে। কিন্তু এ কাজের ঠিকাদার হুমায়ুন কবির সোহাগ নন। কাজটি পেয়েছেন সবুজবাগ পটুয়াখালীর মনিবুর রহমান। ১০৪৪৮৯৩ নম্বর পরিচিতিতে তাকে বিদ্যালয় ভবন নির্মাণের ঠিকাদার নিযুক্ত করেছি আমরা। নির্ধারিত ১ কোটি ৫৭ লাখ ৪৬ হাজার ২৯৬ টাকার প্রাক্কলিত ব্যয়ের বিপরীতে ১ কোটি ৩৯ লাখ ৮৯ হাজার ৯৪৮ টাকা দরে টেন্ডার দিয়ে কাজটি পেয়েছেন তিনি। এখানে সোহাগ নামটি কী করে এলো, সেটাই তো বুঝতে পারছি না।’ বিষয়টি সম্পর্কে জানতে ঠিকাদার মনিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘কাজটি আমার লাইসেন্সের বিপরীতে পেয়েছি। তবে বর্তমানে সেটি করছেন সোহাগ।’ আপনার কাজ তিনি কীভাবে করছেন জানতে চাইলে বলেন, ‘শুরু থেকে আমিই করছিলাম। ৫ আগস্টের পর কাজের সুবিধার্থে সোহাগকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। হয়তো বুঝতে পারেনি বলে সে কাজে ভুল করেছে।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঠিকাদার মনিবুর পটুয়াখালী জেলা যুবলীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য। ফ্যাসিস্ট আমলে স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাবশালী ঠিকাদার হিসাবেও পরিচিতি ছিল তার। একসময়ের ছাত্রলীগ নেতা মনিবুর রহমানের যুবলীগ জেলা কমিটিতে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পটুয়াখালী পৌর যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক মনিরুল ইসলাম মনির।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের একটি সূত্র জানায়, ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর কাজ উঠানোর সুবিধার্থে যুবদল নেতা সোহাগের সঙ্গে অংশীদারত্বে যায় মনিবুর। এরপর থেকে তার ঠিকাদারি কাজগুলো সোহাগই দেখাশোনা করছেন। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য সোহাগের মোবাইল ফোনে কল করা হলে অন্য একজনকে দিয়ে তা রিসিভ করান তিনি। সংবাদকর্মী পরিচয় পাওয়ার পর সোহাগ ফোনের কাছে নেই বলে জানান। পটুয়াখালী জেলা যুবদলের সভাপতি মনিরুল ইসলাম লিটন বলেন, ‘৫ আগস্টের পর ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের কারও সঙ্গে রাজনৈতিক বা ব্যবসায়িক সম্পর্ক না রাখার স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। তারপরও যদি কেউ সেটা করে তবে তা সাংগঠনিক অপরাধ। বাউফলের বিষয়টি সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। সংবাদকর্মীকে হুমকি দেওয়ার বিষয়ে ইতোমধ্যে তাকে কেন্দ্র থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। যুবলীগ নেতার সঙ্গে মিলে ঠিকাদারি করার অভিযোগ তদন্তে প্রমাণ হলে হুমায়ুন কবির সোহাগের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *