বিজ্ঞান শিক্ষা প্রকল্পে পদে পদে দুর্নীতি
বিশেষ প্রতিবেদক, অপরাধ তথ্যচিত্র।
দেশের সরকারি কলেজগুলোতে বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণে প্রকল্প (ফোসেপ) নামে একটি প্রকল্প নিয়েছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল কলেজগুলোর ভবন নির্মাণ, আসবাবপত্র স্থাপন, কম্পিউটার ল্যাব স্থাপনসহ আনুষঙ্গিকসহ অন্যান্য কাজ। অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অনেক কলেজে ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার মতো কাজ করা হয়েছে অর্থ নয়ছয় করার উদ্দেশ্যে। যেমনÑ স্থাপনা নির্মাণ না করেই আসবাবপত্র কিনে ফেলায় পড়ে থেকে নষ্ট হয়েছে, গচ্ছা গেছে সরকারি অর্থ। আবার কোথাও কোথাও নিম্নমানের ফার্নিচার দেওয়ায় সেগুলো ব্যবহারের উপযোগিতা হারিয়েছে।
প্রকল্পে নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে আগের প্রকল্প পরিচালক প্রফেসর ড. খন্দকার মুজাহিদুল হক এবং প্রকল্পের সহকারী প্রকল্প পরিচালক-২ ফারজানা আবেদীন খানম, প্রকিউরমেন্ট ও অর্থ এবং গবেষণা কর্মকর্তা ইব্রাহিম মিয়ার বিরুদ্ধে। সেই অভিযোগ আমলে নিয়ে সরকার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে। তবে ক্ষমতার দাপটে সেই তদন্তকাজ আর এগোতে দেননি অভিযুক্তরা।
ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের পদধারী ইব্রাহিম মিয়া আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে দাপুটে কর্মকর্তা ছিলেন। যে কারণে তিনি যেভাবে চাইতেন প্রকল্প পরিচালক সেভাবেই নিয়োগ হতো। শুধু তাই নয়, তার কথায় চলতেন প্রকল্প পরিচালকসহ সুবিধাভোগী কিছু কর্মকর্তা। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগেও ৩ আগস্ট শিক্ষা ভবনে যেসব কর্মকর্তা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগকে রক্ষা করার জন্য মিছিল করেছিলেন তাদের সামনের সারিতে ছিলেন এই ইব্রাহিম মিয়া। ক্ষমতার পালাবদলে এখন তিনি জামায়াতের পতাকাতলে নিজেকে ঠাঁই দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক কর্মকর্তা। তিনি ২০০৭-২০০৮ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কমিটির সদস্য ছিলেন। সেই প্রভাব কর্মজীবনেও দেখিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ক্ষমতার পালাবদলে সেই ছাত্রলীগ নেতা এখন জামায়াত-শিবিরে ভিড়েছেন বলে একাধিক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে নিশ্চিত করেছেন।
ক্ষমতার দাপটে বিগত আওয়ামী লীগ শাসনামলে নিজের পদ-পদবিও বাগিয়ে নিয়েছেন ইব্রাহিম মিয়া। প্রকল্পের ডিপিপিতে গবেষণা কর্মকর্তা হতে হলে যেখানে অষ্টম গ্রেডের কর্মকর্তা হতে হয়, সেখানে তিনি নবম গ্রেডের কর্মকর্তা হয়েও গবেষণা কর্মকর্তা বনে যান। তা ছাড়া ৯ গ্রেডে যোগদানের পর চাকরিবিধি অনুযায়ী যেখানে কমপক্ষে যোগদানকৃত জায়গায় ২ বছর থাকা বাধ্যতামূলক, সেখানে তিনি এক বছরের মধ্যে ঢাকায় পদায়ন করে নেন।
প্রকল্পটি ছিল প্রায় ২ হাজার ৫৫০ কোটি টাকার। কিন্তু প্রকল্পের সবশেষ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা খরচ হলেও কাজের বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ৪৫ শতাংশ। তাই প্রশ্ন উঠেছে, বাকি ১ হাজার কোটি দিয়ে ৬৫ শতাংশ কাজ শেষ করা সম্ভব কিনা?
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আজাদ খান আমাদের সময়কে বলেন, আমি নতুন যোগদান করেছি। এই প্রকল্পের কিছু বিষয় নিয়ে অভিযোগ পেয়েছি। আমার ঊর্ধ্বতন মহল প্রকল্পের কাজ স্থগিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। আমি সেভাবেই সব কার্যক্রম আপাতত বন্ধ রেখেছি। যেহেতু আমার কাছে লিখিত কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই; তাই ব্যবস্থা নিতে পারছি না। যদি কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণ হয়, তা হলে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বর্তমানে প্রকল্প পরিচালক প্রফেসর মাহমুদ হোসেন আমাদের সময়কে দুই দিন সময় দিয়েও এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি। তবে তার সাথে কথা বলার পর যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ, সেই প্রতিষ্ঠানের মালিক এএন তরুণ দে নামে একজন ফোন করেন। তিনি নিজেকে বিএনপি নেতা পরিচয় দিয়ে বলেন, ফোসেপ প্রকল্প নিয়ে নিউজ করতে ফোন করেছিলেন স্যারকে। আমি এ বিষয়ে আপনাকে সহযোগিতা করতে পারি। এর পর তিনি দেখা করতে চান। এর পর গতকাল রবিবার বিকালে পুনরায় প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, প্রকল্পসংশ্লিষ্ট একজনকে বলে দিচ্ছি আপনার সব তথ্যের বিষয়ে তিনি জানাবেন।
গবেষণা কর্মকর্তা ইব্রাহিম মিয়া আমাদের সময়কে বলেন, প্রকল্প পরিচালক স্যার বলেছিলেন আপনার বিষয়ে। এর পর অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ইজিপিতে কোনো প্রতিষ্ঠানকে কাজ পেতে সহযোগিতা করার সুযোগ নেই। সরবরাহ করা ফার্নিচারের বিষয়ে যদি কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে লিখিত অভিযোগ আসে যে সেই প্রতিষ্ঠানের ফার্নিচার ত্রুটিপূর্ণ, তা হলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পারফরম্যান্স গ্যারান্টি নেওয়া আছে ৩ বছরের। এ সময়ের মধ্যে যে কোনো ত্রুটি সমাধান করতে বাধ্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। অনেক জায়গায় অভিযোগ পাওয়ার পর সমাধানও করা হয়েছে। বিগত সরকারের সময় দলীয় সুবিধা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কর্মজীবনে আসার পর আমার ছাত্রজীবনের ইতিহাসে ফিরতে চাই না।
প্রকল্পের কাজে যত অভিযোগ : বগুড়ার সান্তাহার সরকারি কলেজের ছয়তলা একাডেমিক ভবনের নির্মাণকাজ অসমাপ্ত ও আসবাবপত্র অযত্নে-অবহেলায় থাকার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সহকারী পরিচালক-২ অসীম কুমার বর্মণ স্বাক্ষরিত একটি চিঠি ইস্যু করা হয়েছিল ২০২৪ সালের ২৫ আগস্ট। এই চিঠিই প্রমাণ দেয় স্থাপনা গড়ে তোলার আগেই ফার্নিচার সরবরাহ করা হয়। শুধু অর্থ লোপাটের জন্য।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার আদিনা ফজলুল হক সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ নিম্নমানের পণ্য সরবরাহের অভিযোগ তুলে প্রকল্প পরিচালককে চিঠি দেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, টেন্ডার সিডিউলে ছিল প্রসেসর স্প্রিড ৩. ৪ গেগাহর্জ (জিএইচজে) কিন্তু সরবরাহ করা হয়েছে ২. ৫০ জিএইচজে, যা দিয়ে কাজ করা অসম্ভব। এ ছাড়া সেখানে নেটওয়ার্ক সার্ভার চালু করা হয়নি।
কলারোয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর এসএম আনোয়ারুজ্জামান প্রকল্প পরিচালক বরাবর ২০২৪ সালের ১৯ নভেম্বর চিঠি দেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, কলারোয়া সরকারি কলেজে আসবাবপত্র, ইলেকট্র্রিক ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী সরবরাহ করা হয়েছে। কিন্তু সরবরাহকৃত দ্রব্যসামগ্রী পিআইসি কমিটির পরিদর্শনপূর্বক নিম্নলিখিত ত্রুটি দৃষ্টিগোচর হয়েছে। আসবাবপত্র নির্ধারিত রুম অনুযায়ী স্থাপন/সেট করা হয়নি। অধিকাংশ চেয়ার ত্রুটিপূর্ণ (হাতল এবং সিট), ইলেকট্র্রিক ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী (কম্পিউটার, এসি, টিভি) ল্যাব এবং রুমভিত্তিক স্থাপন/ সেট করা হয়নি।
সিরাজগঞ্জ জেলার কাজিপুর সরকারি মনসুর আলী কলেজের অধ্যক্ষ প্রকল্প পরিচালককে চিঠি দিয়ে অবহিত করেন, অরনেট প্লাস নামক প্রতিষ্ঠানের সরবরাহকৃত মালামাল মানসম্মত নয়। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন সিঙ্গেল খাট ১৬৪টি, সেলফসহ পড়ার টেবিল ১৬৪, হাতলবিহীন কাঠের চেয়ার ১৬৪টি, নিউজ পেপার স্ট্যান্ড ১৬৪টি, ক্যারাম বোর্ড এমএস স্ট্যান্ডসহ ২টি, টেনিস টেবিল, নোটিশ বোর্ড, ডাইনিং টেবিল, হাতলবিহীন ডাইনিং চেয়ার, সেলফ, স্টিল আলমারি, ফাইল ক্যাবিনেট, এক্সিকিউটিভ টেবিল, হাতলসহ রিভলবিং চেয়ার। সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ আমলেও কাজ পেয়েছে মমতাজ ফার্নিচার নামক একটি প্রতিষ্ঠান। পটপরিবর্তনের পর এখন আরও বেশি সক্রিয় মমতাজ ফার্নিচারের অর্নেট প্লাস।
এই প্রকল্পের সহকারী প্রকল্প পরিচালক-২ ফারজানা আবেদীন খানম একাই অনেকগুলো প্রকল্পের সভাপতি ও সদস্য সচিব হিসেবে রয়েছেন। এ জন্য তিনি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এসব প্রকল্পে মিটিং বাবদ ভাতা তুলেছেন ২ লাখ ২৪ হাজার টাকা। একইভাবে ইব্রাহিম মিয়াও একাধিক প্রকল্পে সদস্য সচিব ও সদস্য হিসেবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভাতা তুলেছেন ২ লাখ ৯৭ হাজার ৬০০ টাকা।