খুলনা অপরাধ জগতের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে গ্রেনেড বাবু ও আশিক।
সেখ রাসেল, ব্যুরো চিফ, খুলনা।
১২ শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তালিকায় খুলনা মহানগরীর তিন সন্ত্রাসী টিমের প্রধান আশিক, নূর আজিম ও গ্রেনেড বাবু দের নাম। এদের মধ্যে গত ১ জানুয়ারি কেএমপি’র ডিবি পুলিশের একটি টিম ঢাকায় বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের অন্যতম লিডার নূর আজিম ও তার সহযোগী রিয়াজুলকে আটক করে। নূর আজিম গ্রেফতারের পর বর্তমানে গ্রেনেড বাবু ও আশিক গ্রুপে নিয়ন্ত্রণে চলছে খুলনার অপরাধ জগৎ। এদেরকে গ্রেফতারের জন্য ইতিমধ্যে পুরস্কার ঘোষনা করেছেন বর্তমান কেএমপি কমিশনার। এরা পুরো খুলনা শহরের মাদক ব্যবসা, ভূমি দস্যুতা, চাঁদাবাজি, অস্ত্র বিক্রি ও ভাড়াটে খুনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। খুলনার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
গ্রেনেড বাবু : পুলিশ ও একাধিক গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ২০০১ সালে বোমা তৈরি করে চরমপন্থিদের কাছে সাপ্লাই দিয়ে এবং বোমা নাশকতার সঙ্গে জড়িত থাকায় পুলিশ-র্যাব’র শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় উঠে আসে গ্রেনেড বাবু। এরপর মাদক বিক্রয়, চাঁদাবাজি, জুয়ার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ন্ত্রণ করতে গ্রেনেড বাবু নিজস্ব বাহিনী গড়ে তোলে। ২০১০ সালের ১০ই জুন সন্ধ্যায় ট্যাংক রোডের বাসিন্দা হাকিম মো: ইলিয়াস হোসেনের ছেলে জাহাঙ্গীর হোসেন কচিকে হত্যা করে গ্রেনেড বাবু ও তার সহযোগীরা। এ মামলায় বাবুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ২০২৩ সালের ২৭ মার্চ এ হত্যা মামলায় আসামি রনি চৌধুরী ওরফে বাবু ওরফে গ্রেনেড বাবুকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেন আদালত। একইসঙ্গে তাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ১ বছরের সশ্রম কারাদ- দেয়।
খুলনার একাধিক আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র মতে, খুলনা শহরে সব থেকে বেশি দিন ধরে ত্রাসের রাজত্ব চালাচ্ছে গ্রেনেড বাবুর গ্রুপ। ওই গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছেন রনি চৌধুরী। তিনি নগরীর সামশুর রহমান রোডের বাসিন্দা। বর্তমানে তার নামে মামলা রয়েছে ১৩টি। আর তার গ্রুপে অস্ত্রধারী সদস্য রয়েছেন ৬ জন। তাদের নামে মোট মামলা রয়েছে ৩৩টি। গ্রেনেড বাবু গ্রুপের অস্ত্রধারী সদস্য মো: শাকিল, মো: সাব্বির শেখ, আসাদুজ্জামান রাজু ওরফে বিল রাজু ও বিকুলের নামে তিনটি করে মামলা রয়েছে। একাধিক পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্রেনেড বাবু বর্তমানে পলাতক রয়েছেন। তবে তার অস্ত্র ও মাদকের ব্যবসা খুলনাতে সক্রিয় রয়েছে।
আশিক গ্রুপ : খুলনা শহরের বর্তমানে সব থেকে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে আশিক গ্রুপ। ওই বাহিনীর প্রধান আশিক নিজ নামে দলটি গঠন করেছে। তিনি খুলনা মহানগরীর সদর থানাধীন চানমারী এলাকার বাসিন্দা। ২০১৮ সালে ৬ সেপ্টেম্বর প্রথম হত্যা মামলায় জড়িয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে যুক্ত হন। এ পর্যন্ত তার নামে বিভিন্ন থানায় পাঁচটি মামলা হয়েছে। বর্তমানে তিনি পলাতক রয়েছেন। তার দলে সদস্য রয়েছেন ২৩ জন। তাদের নামে মোট মামলা রয়েছে ১১০টি। আশিক গ্রুপের প্রধান সহকারী ফয়সাল। তিনি খুলনা সদর থানাধীন দক্ষিণ টুটপাড়া এলাকার বাসিন্দা। ২০১৬ সালে তিনিও হত্যা মামলায় জড়িয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে যুক্ত হন। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে আশিকের গ্রুপের সঙ্গে কাজ শুরু করেন। তার নামে এ পর্যন্ত বিভিন্ন থানায় আটটি মামলা হয়েছে।
এ ছাড়া ওই গ্রুপের সদস্য আব্দুল¬াহর নামে ৯টি, জাহিদুল ইসলামের নামে ৩টি, বস মিজানের নামে ৭টি, পালসার সোহেলের নামে ৪টি, কাউট বাসারের নামে ২টি, হেলালের নামে ৮টি, পারভেজের নামে ৬টি, দুলালের নামে ৮টি, নাদিমের নামে ২টি, ডালিমের নামে ৩টি, অপুর নামে ৩টি, জিহাদ হোসেন জিয়ার নামে ৫টি, মো. সাগর লেলিনের নামে ৮টি, শেখ গোলাম মোস্তফা ওরফে ট্যারা মোস্তর নামে ২৭টি, আরমানের নামে ৭টি, সাইফুল ইসলাম পিটিলের নামে ৩টি, মো. ইয়াছিনের নামে ৫টি, মো. নিয়াজ মোর্শেদের নামে ৮টি, স্পিকার মিরাজের নামে ৩টি ও শেখ বাবুল শেখের নামে ২টি মামলা রয়েছে। এসব মামলাগুলো হত্যা, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, অস্ত্র ব্যবসা ও নারী নির্যাতনের ঘটনায় হয়েছে। এদের মধ্যে বস মিজান, পারভেজ, অপু, জিহাদ হোসেন জিয়া, মো. সাগর লেলিন বর্তমানে বিভিন্ন মামলায় কারাগারে রয়েছেন। অন্যদিকে ওয়ারেন্ট জারি থাকলেও আশিক, ফয়সাল, ইমন, দুলাল পলাতক রয়েছেন। বর্তমানে শহরের শীর্ষ মাদক সরবরাহকারীও আশিক গ্রুপ। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৭ অক্টোবর নৌবাহিনী বাহিনীর অভিযানে মহানগরীর শীর্ষ মাদক কারবারি ‘ইয়াবা সম্রাট’ সজীবসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ মাদক, গুলি ও মোবাইল সেটসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। সজীবের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ১১টি মামলা রয়েছে। সে ক্রসফায়ারে নিহত সুন্দরবনের বনদস্যু জুলফিকার আলী ওরফে জুলফির ছেলে। তার ছোট ভাই আশিক ইসলাম নগরীর ভয়ঙ্কর কিশোর গ্যাং ‘আশিক গ্রুপ’-এর প্রধান। এর আগে ২০২৩ সালের ১ আগস্ট খুলনার রূপসা সেতু টোল প্লজা থেকে ৯ হাজার ৩৫০ পিস ইয়াবাসহ সজীবকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
চলতি বছরের গত ১৯ জানুয়ারি নিরাপদ খুলনা’ গড়ার প্রত্যয়ে পরিকল্পনা সংক্রান্ত কেএমপি কমিশনারের প্রেসবিফ্রিং করেছিলেন। ওই সময় পুলিশ কমিশনার মো: জুলফিকার আলী হায়দার বলেছিলেন “পুলিশ যতোই চেষ্টা করুক জনসাধারণের সহযোগিতা ছাড়া আইনশৃঙ্খলার উন্নতি খুব বেশি উন্নতি করা সম্ভব নয়। পুলিশ একা চেষ্টা করে খুব বেশি দূর এগোতে পারবে না। জনগণের সহযোগিতা দরকার। ওই সময় তিনি বলেছিলেন কেএমপির তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে। বাকীদের গ্রেফতারের জন্য তাদের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে।