খুলনার বিতর্কিত শিক্ষক কিরীটী রায় ভূয়া মেডিকেল সার্টিফিকেটে দুই মাস ছুটিতে

সেখ রাসেল, ব্যুরো চিফ, খুলনা:
​ খুলনার বিতর্কিত প্রাইমারী শিক্ষক কিরীটি রায় সরকারি নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করেন না। সম্প্রতি তিনি ভূয়া মেডিকেল সার্টিফিকেটে টানা ২ মাস ৭ দিন চিকিৎসা ছুটিতে স্কুলে অনুপস্থিত আছেন। গত বছরের ৪ নভেম্বর রায়ের মহল বিদ্যানিকেতন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্কুল সংলগ্ন রাস্তায় তাকে মারধরের অভিযোগ তুলে তিনি ডাকযোগে জেলা শিক্ষা অফিসার বরাবর এই ছুটির আবেদন করেন। ১৮ নভেম্বর তার শারীরিক অসুস্থতা সম্পর্কে খুলনা সিভিল সার্জন বরাবর মতামত চাওয়া হয়। ২৬ নভেম্বর সকাল ১০টার তাকে শারীরিক পরীক্ষার জন্য সময় দেওয়া হলে তিনি আসেননি। ২ ডিসেম্বর তাকে রিপোর্ট দেখাতে বলা হলে তিনি আসেননি। ৮ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় তার শারীরিক পরীক্ষা হয়। খুলনা সিভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল বোর্ড তার চিকিৎসা ছুটি বাতিল করে তাকে স্কুলে যোগদানের নির্দেশ দেন। প্রথমে ১ মাস ৭ দিন ছুটি কাটানোর পর তিনি আরও একমাস চিকিৎসা ছুটি নিয়েছেন। গতকাল সোমবার তার দ্বিতীয় দফা শারীরিক পরীক্ষা হয়।
এ বিষয়ে খুলনার ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. শেখ মো. কামাল হোসেন জানিয়েছেন, শারীরিক পরীক্ষায় তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ। তাকে স্কুলে যোগদানের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তখন কিরীটি রায় নিজেকে মানসিক রোগী বলে দাবি করেছেন। এ বিষয়ে খুলনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার শেখ অহিদুল আলম জানিয়েছেন, বিতর্কিত শিক্ষক কিরীটি রায় একাধিক বিভাগীয় মামলায় অভিযুক্ত। তার বিরুদ্ধে বিনা অনুমতিতে ১২ বার বিদেশ ভ্রমণের সুস্পষ্ট তথ্য আছে। এই মামলার জবার না দেয়ার জন্য তিনি নানাবিধ তালবাহানা করছেন। বর্তমানে তিনি ভূয়া মেডিকেল সার্টিফিকেটে টানা ২ মাস ৭ দিন চিকিৎসা ছুটির আবেদন করে স্কুলে অনুপস্থিত আছেন। এর জন্য তার বিরুদ্ধে আরও একটি বিভাগীয় মামলা হবে। আগে তিনি একাধিকবার চাকরি থেকে সময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। এখন সকল অভিযোগ যাচাই বাছাই করে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিরীটি রায় চলতি মাসের ১১ তারিখে অতিসংগোপনে পিটিআই সংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। গত বছরের ২৮ নভেম্বর কিরীটী রায়কে পিটিআই সংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয়ে সংযুক্তিতে যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হয়। তখন পিটিআই সুপার তাকে অন্যত্র বদলির জন্য ডিজি বরাবর আবেদন করেন। কিছু দিন আগে খুলনার পিটিআই সুপার মোল্যা ফরিদ আহম্মেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের খবর প্রকাশিত হয়। তারপর কিরীটী রায় পিটিআই সুপারের সহায়তার এই স্কুলে যোগদান করেন। ২০১২ সালের জুলাই মাসে কিরীটি রায় একটি বিভাগীয় মামলায় অভিযুক্ত হয়ে অনুনমোদিত ছুটি কাটিয়েছিলেন। সেই মামলায় তার বিরুদ্ধে সন্দেহাতিতভাবে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বিধিমালার ৪(৩) ডি ধারায় তাকে চাকরি থেকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত হয়। পরে মানবিক বিবেচনায় তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়নি। তখন তিনি নিজেকে মানসিক রোগী দাবি করেছিলেন। এবারও কী একই অজুহাত দেখাবেন?
কিরীটী রায়ের বিরুদ্ধে বিনা অনুমতিতে ১২বার বিদেশ ভ্রমণের গুরুতর অভিযোগ আছে। বাংলাদেশ পুলিশের রাজারবাগের ইমিগ্রেশন শাখার স্পেশাল ব্রাঞ্জের তথ্য অনুযায়ী কিরীটী রায় বিনা অনুমতিতে ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত ইচ০৮৩৫৩৬৫ এবং ই০০১৩৯০১০ নম্বরের ২টি পাসপোর্টে ভারত ভ্রমণ করেছেন। এর আগে ২০১৩ সালের অক্টোবরে কিরীটী রায়ের বিরুদ্ধে সন্দেহাতীতভাবে আরও একটি গুরুদন্ড প্রমাণিত হয়েছিল। তখন তাকে মানবিক বিবেচনায় চাকরি থেকে বরখাস্ত না করে বেতন স্কেল কর্তন করে লঘুদন্ড দেওয়া হয়।
কিরীটী রায় বিনা অনুমতিতে বিদেশ ভ্রমণ করায় তার বিরুদ্ধে ২০১৮ এর ৩(খ) ও ৩(গ) এর বিধি মোতাবেক অসদাচারণ ও পলায়নের আওতায় শাস্তি হবে। সেক্ষেত্রে তাকে বাধ্যতামূলক অবসর, চাকরি থেকে অপসারণ, বরখাস্ত ও বেতন গ্রেডের অবনমিতকরণ করার বিধান আছে। যেহেতু তাকে পূর্বে ২ বার (২০১৩, ২০২৩) লঘুদন্ড দিয়ে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং একাধিকবার বেতন গ্রেড কর্তন করা হয়েছে। এখন কী হবে?
এখনও তার বিরুদ্ধে ৭টি বিভাগীয় মামলা ঝুলে আছে। কিরীটী রায় ২০০৯ সালে প্রথমবার উদয়ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। ২০১২ সালে তিনি উদয়ন স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র জয় কুমার শীলকে অমানবিক প্রহার করে অভিযুক্ত হন। তখন তাকে অন্য স্কুলে বদলি করা হয়। আবার তিনি ২০১৬ সালে দ্বিতীয় দফায় এই স্কুলে যোগদান করেন। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মনিরুল ইসলামকে তিনি বদলি করিয়েছেন। তিনি ৫ জন নারী শিক্ষকের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন ১শত পৃষ্ঠার মিথ্যা অভিযোগপত্র প্রস্তুত করে তাদেরকে বদলির ব্যবস্থা করছেন। ২০২৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির দুইজন ছাত্রীর যৌন পীড়নের মামলায় তিনি কয়েক মাস জেল খাটেন। ঐ দিন পুলিশের হাতে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে কিরীটী রায়ের মোবাইলে অসংখ্য বিতর্কিত ছবি ও একজন নারী শিক্ষকের সাথে বিদেশ ভ্রমণের তথ্য পাওয়া যায়। তাকে স্কুল থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এরপর ঐ স্কুলের ৫ জন নারী সহকারী শিক্ষক তার বিরুদ্ধে শরীরের স্পর্শকাতর অংশের ছবি তোলার জন্য লিখিত অভিযোগ করেন। এই অভিযোগে তার নামে আরও একটি বিভাগীয় মামলা হয়। সেই মামলা এখনও চলমান আছে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর কিরীটী রায়কে আড়ংঘাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি করা হয়। সেখানে তিনি ক্ষুব্ধ এলাবাসী ও অভিভাবকদের বাধার মুখে যোগদান করতে পারেননি। পরে তাকে পুলিশ প্রহারায় স্কুল থেকে উদ্ধার করা হয়। এরপর থানা শিক্ষা অফিসে তার হাজিরার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর তাকে নুরনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি ককেয়জন শিক্ষকের সাথে দুর্ব্যবহার করেন। এরপর গোপনে তাকে রায়ের মহল বিদ্যানিকেতন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করানো হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *