থামছেই না মানব পাচার, আবার সক্র্রীয়।

অপরাধ তথ্যচিত্র ডেস্ক:দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগে ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে একাধিক সংঘবদ্ধ মানব পাচার চক্র। এদের প্রধান টার্গেট রোহিঙ্গা নারী-শিশু। অর্থের বিনিময়ে তারা রোহিঙ্গাদের এদেশে অনুপ্রবেশে সহযোগিতা করার পাশাপাশি ভালো চাকরি ও উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে পাচার করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে মাঝেমধ্যে পাচারকারীদের কবল থেকে রোহিঙ্গাদের উদ্ধার ও চক্রের সদস্যরা গ্রেপ্তার হলেও এদের দৌরাত্ম্য কিছুতেই থামছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তোয়াক্কা না করে তারা অবৈধ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ,র্ যাব, বিজিবি ও কোস্টগার্ডসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার নানামুখী অভিযানের পরও বন্ধ হচ্ছে না মানব পাচার। নানা কৌশলে চলছে এসব অপরাধ। সবশেষ ১১ জানুয়ারি ভোরে বান্দরবানের আলীকদম সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অভিযোগে ৫৮ রোহিঙ্গাকে আটক করেছে বিজিবি। আটক রোহিঙ্গারা বিজিবি সদস্যদের জানিয়েছেন, তারা আলীকদম সীমান্তের ৫৬ ও ৫৭ নম্বর সীমান্ত পিলারের মাঝামাঝি মেনচং ম্রো পাড়া এলাকার সীমানা দিয়ে অনুপ্রবেশ করেছেন। এর আগে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে একাধিক সংঘবদ্ধ মানব পাচার চক্র সক্রিয় হয়ে ওঠার খবর বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার ও বাংলাদেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গা দালালরা থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও বিভিন্ন দেশে ভালো চাকরি এবং রোহিঙ্গা নারীদের বিয়ের কথা বলে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ২০২৩ সালের ৯ নভেম্বর ইন্দোনেশিয়ায় পাঠানোর কথা বলে দেড় শতাধিক রোহিঙ্গাকে ট্রলারে তোলা হয়। তাদের কাছ থেকে দুই-তিন লাখ টাকা করে নেওয়া হয়।
সূত্রগুলো জানায়, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন-পরবর্তী পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে কক্সবাজার অঞ্চলে সক্রিয় হয়ে ওঠে মানব পাচারকারী চক্র। শীত মৌসুমে সমুদ্র অনেকটা শান্ত থাকায় সাগরপথে মানব পাচারকারী চক্র বাড়তি সুবিধা পায়। সদ্য বিদায়ী বছরের ১৮ নভেম্বর রাতে র‌্যাব পাচারকারী চক্রের আস্তানা থেকে ৩১ জনকে উদ্ধার করে। গোয়েন্দা সূত্রমতে, মানব পাচারকারী চক্রের সঙ্গে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের যোগসাজশে অপহরণ, মুক্তিপণ ও মানব পাচারের সংঘবদ্ধ নেটওয়ার্ক রয়েছে উখিয়া টেকনাফে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মানব পাচারের জন্য ব্যবহার হচ্ছে কক্সবাজার সদরের চৌফলদ্বন্ডির ঘাট, উখিয়া ও টেকনাফের ছয়টি নৌঘাট। এসব নৌঘাট দিয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় লোক পাচার করা হচ্ছে। উখিয়া জালিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান ছৈয়দুল আলম বলেন, দীর্ঘদিন পাচার প্রক্রিয়া বন্ধ ছিল। আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সিন্ডিকেট সদস্যরা। তাদের খপ্পরে পড়ে অনেক পরিবার নিঃস্ব হচ্ছে। জানা যায়, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কাছে মাঝেমধ্যে সিন্ডিকেট সদস্যরা ধরা পড়লেও আইনের ফাঁকফোকরে জেল থেকে বেরিয়ে আবারও শুরু করে মানব পাচার। মানব পাচারকারীরা একলাছ মিয়াকে নির্যাতন করে দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি এবং মুক্তিপণের টাকা না দিলে মালয়েশিয়ায় পাচার করে দেবে বলে হুমকি দেয়। একপর্যায়ে ভিকটিম একলাছ মিয়ার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেও মুক্তিপণের টাকা না পাওয়ায় ১৬ নভেম্বর একলাছকেসহ ১৫-২০ জনকে ট্রলারে মালয়েশিয়ায় পাচারের উদ্দেশ্যে পাহাড়ের চূড়ার খুপরি ঘর থেকে সাগরপাড়ে ট্রলারের কাছে নেওয়ার সময়ে কৌশলে পালিয়ে আসে। পরে তার সঙ্গে থাকা চাচাতো ভাইসহ অন্যরা পাচারকারীদের হেফাজতে থাকায় তাদের উদ্ধারের জন্যর্ যাবের সহায়তা কামনা করেন। একলাছ মিয়া কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সূত্র ধরে পাহাড়ের চূড়ায় একটি গোপন আস্তানায় অভিযান চালিয়ে মানব পাচারকারীদের হেফাজত থেকে ৫ বাংলাদেশি ও ২৬ রোহিঙ্গা নাগরিকসহ ৩১ জনক উদ্ধার এবং পাচার চক্রের দু’জনকে গ্রেপ্তার করে।বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির কাছে ২০১৮-১৯ সালের জুন পর্যন্ত এক বছরে ১৬০০ রোহিঙ্গা পাচারের তথ্য রয়েছে। এ সময় ১৫ জন মারা গেছেন। ২০১৯ সালের মার্চ থেকে ২০২০ মার্চ পর্যন্ত ১৫ হাজার রোহিঙ্গা পাচার হয়েছে। যার মধ্যে বড় অংশ ছিল নারী ও শিশু। এ ছাড়া ২০১৭ আগস্ট থেকে ২০১৮ ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত ২৮টি নৌকা ডুবির ঘটনায় ১৯৭ জনের মরদেহ উদ্ধার হয় এবং অন্তত ৫০০ জন নিখোঁজ হন।ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসানের মতে, বাংলাদেশের শিক্ষিত ও সাধারণ উভয় ধরনের মানুষেরই দেশের বাইরে যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে। সম্প্রতি ব্র্যাক-এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণ মানুষের মাত্র ৫ শতাংশ মাইগ্রেশন এবং ট্রাফিকিং আলাদা করে বোঝে। বাকিরা যে পাচার হচ্ছে তারা তা বুঝতেই পারে না। তার কাছে প্রবাসে যাওয়াটাই সব। কীভাবে গেল, সেটা মুখ্য নয়।এদিকে, ইউএনএইচসিআর বলছে, সমুদ্রপথ দিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে যেসব দেশের মানুষ ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করে, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশ-ভারত এবং বাংলাদেশ-মিয়ানমার আন্তঃসীমান্ত পাচার হচ্ছে। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে নেওয়ার কথা বলে মেয়েদের অন্য দেশে বিক্রি করে দেওয়ার ঘটনা আছে।অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ‘ট্রাফিকিং ইন পারসনস (টিআইপি) রিপোর্ট ২০২৪’ মোতাবেক, মানব পাচার নির্মূলের নূ্যনতম মান পুরোপুরি অর্জন করতে পারেনি বাংলাদেশ। মানব পাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশ সরকার বিগত বছরের তুলনায় সামগ্রিকভাবে ক্রমবর্ধমান প্রচেষ্টা চালিয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান আগের মতো দ্বিতীয় ধাপেই (টিয়ার-২) রয়ে গেছে। বিভিন্ন গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মাদক ব্যবসা ও অস্ত্র পাচারের পর মানব পাচার হচ্ছে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অপরাধমূলক কার্যক্রম। মানব পাচারের সঙ্গে প্রথম দুটি অপরাধও প্রায়ই জড়িয়ে থাকে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্রগুলোর সবচেয়ে দ্রম্নত বর্ধনশীল কার্যক্রম হচ্ছে মানব পাচার। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও এই অপকর্মের জন্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।মানব পাচার চক্রের তৎপরতা অবিলম্বে বন্ধ করা না গেলে সাগরপথে মরণযাত্রা বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। পাচারকারীদের অনেক প্রচেষ্টা পুলিশ নিষ্ফল করে দিলেও তা পর্যাপ্ত নয় বলে দাবি করেছেন অনেকে। তারা দাবি করেছেন, পাচারকারীদের তালিকা করে তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া গেলেই এই তৎপরতা কমতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *