যারা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সাহস রাখেন না, তাদের জন্য সাংবাদিকতা নয়: কাদের গণি

অপরাধ তথ্যচিত্র ডেস্ক:পতন ও পচনমুখী করে এমন সাংবাদিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) মহাসচিব কাদের গণি চৌধুরী।

তিনি বলেন, বিগত সময়ে সাংবাদিকতার নামে কী হয়েছে, সেটা সবার জানা। সাংবাদিকদের ‘ওয়াচ ডগ’ এর ভূমিকায় থাকার কথা ছিল, কিন্তু একটা অংশকে পোষা কুকুরের ভূমিকায় দেখা গেছে। যাদের মধ্যে অনেকেই পলাতক। কেউ আবার কারাগারে। এমন পতন ও পচনমুখী সাংবাদিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সব ভয়-ভীতি ও লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠে জাতির সামনে সত্য তুলে ধরতে হবে। যারা এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সাহস রাখেন না, তাদের জন্য অন্তত সাংবাদিকতা নয়।

শনিবার (১১ জানুয়ারি) বিকেলে রংপুর টাউন হলে রংপুর সাংবাদিক ইউনিয়ন (আরপিইউজে) আয়োজিত বিভাগীয় সাংবাদিক সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন।

সমাবেশের উদ্বোধন করেন ২৪-এর জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে শহীদ সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়’র মা ও জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সদস্য শামসি আরা জামান কলি।

সমাবেশে কাদের গণি চৌধুরী বলেন, সাংবাদিকতা হতে হবে পুরো সত্য, আংশিক নয়। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে হবে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য দরকার সাংবাদিকের লড়াকু মন, গণমাধ্যমের প্রাতিষ্ঠানিকতা আর গণতান্ত্রিক শাসন। কিন্তু এ তিনটিরই বড্ড অভাব রয়েছে। নানা কারণে সাংবাদিকরা এখন সাংবাদিকতাকে স্রেফ পেশা হিসেবে নিয়েছেন, মিশন বা ভিশন হিসেবে নয়। সাংবাদিকতা আসলে কেবল তথ্য-উপাত্ত ও ঘটনার বিবরণ সংগ্রহের পেশা নয়; এটির ভিত্তি হচ্ছে তথ্য যাচাই করাও।

নিয়োগ আছে কিন্তু বেতন নেই- এমন গণমাধ্যম তৈরি না করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, দু-একটি বাদ দিলে বেশির ভাগ গণমাধ্যম হাউসগুলোর কোনো প্রাতিষ্ঠানিকতা নেই। তাই তারা সাংবাদিকদের নিরপেক্ষ অবস্থানকে সমর্থন করতে পারে না এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সুরক্ষাও দিতে পারে না। বরং অধিকাংশ গণমাধ্যম মালিক রাজনীতি ও ব্যবসার ঢাল হিসেবে গণমাধ্যমকে ব্যবহার করছেন। অনেকে যেনতেনভাবে একটা পত্রিকা বের করে সম্পাদক বনে যাচ্ছেন। ৫০ কপি পত্রিকা বের করে তা বগলে চেপে সচিবালয়ে ঢোকেন। এসব বগল সম্পাদকের দাপটে আসল সম্পাদকরা কোণঠাসা। এসব বগল সম্পাদকরা তথ্য সন্ত্রাসকে পুঁজি করে বিপুল অর্থের মালিক বনে যাচ্ছেন। অপসাংবাদিকতা, হলুদ সাংবাদিকতা ও তথ্য সন্ত্রাস সাংবাদিকতার মর্যাদাকে ম্লান করে দিচ্ছে। তারা নিয়োগ দেন কিন্তু বেতন দেন না, এমন গণমাধ্যম তৈরির দরকার নেই।

বিএফইউজে মহাসচিব বলেন, রাজনীতিকরা, আমলারা এবং বিজ্ঞাপনদাতারা গণমাধ্যমকে তাদের মতো করে ব্যবহার করতে চায়, কখনো কখনো এরা গণমাধ্যম ও গণমাধ্যম কর্মীদের জীবনও বিপন্ন করে তোলে। গত ১৫ বছরে ষাটের অধিক সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন এসব কারণে। তাই গণমাধ্যমের প্রাতিষ্ঠানিকতা খুব দরকার। বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের দেশে দু-একটি বাদ দিলে গণমাধ্যম হাউসগুলোর কোনো প্রাতিষ্ঠানিকতা নেই। তাই তারা সাংবাদিকদের নিরপেক্ষ অবস্থানকে সমর্থন করতে পারে না এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সুরক্ষাও দিতে পারে না। রাজনৈতিকদের ক্রোধ আর চতুরতার এবং তাদের দুর্নীতি ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকতার মর্যাদা সাহসের সঙ্গে বজায় রাখতে হবে প্রতিষ্ঠানকেই। সেই প্রাতিষ্ঠানিকতা এখন কী সত্যিই আছে?

কাদের গণি চৌধুরী বলেন, বস্তুনিষ্ঠতা মানে হলো কোনো ঘটনাকে বা বিষয়কে বাড়িয়ে বা কমিয়ে না বলা। রিপোর্টারের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ যাই থাক কোনো মন্তব্য থাকবে না রিপোর্টে। যাকে বা যার প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের তিনি রিপোর্ট করবেন তার বক্তব্য অবশ্যই থাকতে হবে। ঘটনা এবং বিষয়ে অনিবার্যভাবে একাধিক পক্ষ থাকে। সবার সাথে কথা বলে রিপোর্ট করতে হবে। এক পক্ষের কথা শুনে অন্য পক্ষকে ঘায়েল করা সাংবাদিকতা নয়। মনে রাখবেন, সাংবাদিকদের হতে হবে পক্ষহীন। পক্ষপাতহীনতা মানে সাংবাদিক কোনো পক্ষে নেই এবং ভারসাম্যপূর্ণভাবে সব পক্ষের কথা তথ্যের মধ্যে দিয়েছেন। ন্যায্যতা মানে দুজনের দাবিই যত ন্যায্যভাবে সম্ভব তুলে ধরা রিপোর্টে। তথ্য সংগ্রহ, প্রতিবেদনের গঠন এবং রিপোর্টারের নিজস্ব বর্ণনা সব কিছু ঘটনার সাথে জড়িতদের অবস্থান থেকে দূর এবং স্বতন্ত্রভাবে করতে হবে। সাংবাদিককে নিরপেক্ষ থাকতে হয়। এটা না করলে আপনি ‘সাংবাদিক’ না আপনি ‘সাংঘাতিক’। আপনাকে মানুষ ঘৃণা করবে। আপনাকে জনরোষে পড়তে হবে। দেখছেন না জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর অনেক দালাল সাংবাদিককে পালাতে হয়েছে। এটা গণমাধ্যমের জন্য লজ্জার।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওবায়দুর রহমান শাহীন বলেন, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত গণমাধ্যম। গণতন্ত্র, সুশাসন ও আইনের শাসনের নিরন্তর সহযোগী। কাজেই যে সরকারই আসুক সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন কোনোভাবেই কাম্য নয়।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহিদুল ইসলাম বলেন, ভালো সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পাশাপাশি অপসাংবাদিকতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। গত ১৫ বছর দেশে সাংবাদিকতা বলে কিছুই ছিল না। সাংবাদিকরা যেন স্বস্তি নিয়ে কাজ করতে পারে সে লক্ষ্যে সাংবাদিক ইউনিয়ন কাজ করছে।

রংপুরে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত রংপুর বিভাগীয় সাংবাদিক সমাবেশে রংপুর জেলা ছাড়াও পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও বগুড়া জেলার সাংবাদিকরা যোগ দেন। সমাবেশে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের সাংবাদিক নেতারা বক্তব্য দেন।

সমাবেশ থেকে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড, ২৪-এর ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ পাঁচ সাংবাদিকসহ দেশের সব সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত করে বিচার ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত, হামলা-মামলা-হয়রানি বন্ধ, সাইবার নিরাপত্তা আইনসহ গণমাধ্যমের স্বাধীনতাবিরোধী সব নিবর্তনমূলক আইন বাতিল, সাংবাদিক সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও ফ্যাসিবাদমুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার দাবি জানানো হয়।

রংপুর সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি সালেকুজ্জামান সালেকের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক সরকার মাজহারুল মান্নানের সঞ্চালনায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন বিএফইউজের সহকারী মহাসচিব ড. সাদিকুল ইসলাম স্বপন, সাংগঠনিক সম্পাদক এরফানুল হক নাহিদ, বাসসের পরিচালনা পর্ষদ সদস্য মমতাজ শিরীন ভরসা।

এ ছাড়াও সম্মানিত অতিথি ছিলেন পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি আমিনুল ইসলাম, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফায়সাল, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রংপুর জেলার আহ্বায়ক ইমরান আহমেদ ও মহানগরের মুখপাত্র নাহিদ হাসান খন্দকার প্রমুখ। এতে স্বাগত বক্তব্য দেন রংপুর সাংবাদিক ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সমাবেশ আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক রেজাউল করিম মানিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *