মামলার নামে বাণিজ্য: ভয়ঙ্কর চক্রের ও একটি রাজনৈতিক দলের নতুন ব্যবসা
অপরাধ তথ্যচিত্র ডেস্ক:
ছয় বছর আগে ঢাকার ধামরাইয়ে বনেরচর গ্রামের মনোয়ার হোসেন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ছয় বছর পর তাঁর বোন জেসমিন সুলতানা ওরফে আসমা আক্তার তাঁর ভাই মনোয়ারকে হত্যা করা হয়েছে দাবি করে গত বছর অক্টোবরে আদালতে মামলা করেন। বর্তমানে সেই মামলা তদন্ত করছে ধামরাই থানা পুলিশ। মামলায় আসামি করা হয়েছে এলাকার ধর্নাঢ্য ব্যক্তি, পুলিশ এবং বাদীর সাবেক স্বামীকে। সম্পূর্ণ মিথ্যা তথ্য দিয়ে করা এ ধরনের মামলা থেকে আসামিদের নাম কেটে দিতে মামলাবাজ চক্রের সদস্যরা দাবি করছে লাখ লাখ টাকা। দেশজুড়ে বর্তমানে একটি চক্র এভাবে করছে ‘মামলা বাণিজ্য’।
গত বছর আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর ‘মামলা বাণিজ্য’ শুরু হলে ঢাকার আশুলিয়া এলাকায় পিতা-পুত্র মিলেও গড়ে তোলেন একটি ‘মামলা বাণিজ্য’ চক্র। বাড়ির ভাড়াটিয়া এক নারীকে দিয়ে ভুয়া মামলা দায়ের করার মাধ্যমে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন তাঁরা। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। পুলিশ ওই মামলার চূড়ান্ত রিপোর্ট দিয়ে চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে।
গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশে মামলা বাণিজ্যের একটি অসাধু চক্র গড়ে ওঠে। এই চক্র ভুয়া মামলায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের নাম ঢুকিয়ে আবার কেটে দেওয়ার নামে কামিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। দেশজুড়ে এই চক্রটি এক আতঙ্কের নাম।
‘মামলা বাণিজ্য’ চক্রের সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন স্থানীয় রাজনীতিক, অসাধু আইনজীবী এবং পুলিশ।
তবে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন দায়িত্বশীল মহল থেকে বলা হয়েছে, বানোয়াট এসব মামলা তদন্তের সময় পর্যালোচনা করা হবে। দায়িত্বশীলদের এমন বক্তব্যর পর কোনো কোনো এলাকায় পুলিশ গুরুত্ব দিয়ে মামলার তদন্তকাজ করলেও বেশির ভাগ থানার পুলিশ রহস্যজনকভাবে নীরব রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব মামলা তদন্তের নামে ‘মামলা বাণিজ্যে’ জড়িয়ে পড়ছেন অনেক পুলিশ কর্মকর্তা। তাঁরাও মামলার আসামি থেকে নাম বাদ দেওয়ার নাম করে কামিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা।
যে কারণে পুলিশের ভূমিকাকে অনেকে রহস্যজনক বলে উল্লেখ করেছেন। আবার মামলায় যেসব পুলিশ সদস্যকে আসামি করা হয়েছে, তাঁদের কাছ থেকেও চাঁদা দাবি করছেন ‘মামলা বাণিজ্য’ চক্রের সদস্যরা।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, চাঁদাবাজি, পূর্বশত্রুতা ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে এসব বানোয়াট মামলা করা হচ্ছে। এসব বানোয়াট মামলার পেছনে রয়েছে জমি দখল এবং হয়রানি করার ঘটনাও।
আর ‘মামলা বাণিজ্য’ করতে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, সরকারি কর্মকর্তাসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকে আসামি করা হয়েছে। আবার অনেক মামলার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, বাদী যেমন আসামিকে চেনেন না, আসামিও বাদীকে চেনেন না। কোনো কোনো মামলায় বাদী হিসেবে নিজের নাম দেখে বাদী নিজেই চমকে উঠছেন।
রাজধানীর খিলগাঁও থানায় করা একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় ১৮০ জন আসামির মধ্যে ৩৬ জন আসামি পুলিশ কর্মকর্তা। মামলা থেকে নাম কাটাতে এই পুলিশ কর্তকর্তাদের কাছেও লাখ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়েছে।
তবে পুলিশ কর্মকর্তারা দাবি করা সেই চাঁদা দেননি। তার পরও থেমে নেই ‘মামলা বাণিজ্য’ চক্রের সদস্যরা। মামলার আসামিদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায়ে কৌশল পাল্টাচ্ছেন তাঁরা।
গত ৪ আগস্ট সিলেটের গোলাপগঞ্জে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ঘোষগাঁওয়ের মোবারক আলীর ছেলে গউছ উদ্দিন। এ ঘটনায় গত ২৩ আগস্ট গউছ উদ্দিনের ভাতিজা রেজাউল করিম বাদী হয়ে থানায় মামলা করেন। ফেসবুকের মাধ্যমে রেজাউল যখন জানতে পারেন মামলাটির বাদী তিনি, তখন তিনি মামলাটি দায়েরের বিষয় অস্বীকার করে জানান, তাঁর স্বাক্ষর জাল করে থানায় মামলা করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গোলাপগঞ্জ থানার ওসি মনিরুজ্জামান মোল্লা টেলিফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, “বাদীর স্বাক্ষর জাল কি না, সে বিষয়ে আমাদের কাছে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। মামলায় ১৩৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ মধ্যে ‘মামলা বাণিজ্য’ হচ্ছে বলেও আমাদের কাছে খবর আসছে। তবে আমরা মামলাটি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি। যিনি মারা গেছেন তাঁর পরিবারের বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আসামিদের বলেছি, নিরপরাধ কাউকে গ্রেপ্তার করা হবে না। নাম কাটানোর জন্য কারো সঙ্গে যোগাযোগ না করতেও বলেছি। তবে এক শ্রেণির সুযোগ সন্ধানী লোক তো আছেই। আর মামলার বাদী আমাদের কাছে এমন কোনো অভিযোগ করেননি যে তাঁর স্বাক্ষরটি জাল।”
একটি বিশেষ সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ জুড়ে একটি রাজনৈতিক দল দুটি গুরুপে বিভক্ত হয়ে, একটি গুরুপে দিচ্ছে মামলা, আর একটি গুরুপে মামলাটি মিটিয়ে দিয়ে দু গুরুপে টাকা ভাগাভাগির করে নিচ্ছে, এমনটি জানিয়েছে।