খাল দখল করেই বাগান বিলাস

অপরাধ তথ্যচিত্র ডেস্ক:ঢাকা উত্তরের খাল দখলে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন তৎকালীন মেয়র আতিকুল ইসলাম। দলবল নিয়ে প্রায়ই নেমে খালের বর্জ্য তুলে আলো কাড়তেন! তবে মুদ্রার উল্টো পিঠও দেখিয়েছেন আওয়ামী লীগের এ ব্যবসায়ী। গাজীপুরের শ্রীপুরে ‘লবণদহ’ খালের প্রায় দুই বিঘা জমি দখল করে বানিয়েছেন বাগানবাড়ি। নাম রেখেছেন ‘লবলঙ্গ পার্ক’। শুধু তাই নয়, ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে বাড়ি পর্যন্ত পিচঢালা রাস্তা করেছেন সরকারি অর্থে।স্থানীয়রা বলছেন, দখলে শ্রীপুরের ধনুয়া ও আজুগীরচালা গ্রামের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া লবণদহ খাল এখন অস্তিত্বহীন। তবে শেষ থাবা বসিয়েছেন আতিকুল। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তিনি খালের সঙ্গে শত বছরের পুরোনো সিএস, এসএ ও আরএস রেকর্ডে থাকা ২০-২৫ ফুট চওড়া সরকারি রাস্তা দখল করে বাগানবাড়ি করেছেন। সরকারের কাছে খাল ও রাস্তাটি দখলমুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন তারা।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ধনুয়া নতুন বাজার থেকে আতিকুলের লবলঙ্গ পার্ক পর্যন্ত ৪৩০ মিটার লম্বা ও ১৮ ফুট চওড়া রাস্তা করা হয়েছে। অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, প্রভাব খাটিয়ে নিজের কেনা জমির ওপর সরকারি টাকায় আতিকুল রাস্তাটি করেছেন।স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর গাজীপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ শাহজাহান আলী সমকালকে বলেন, রাস্তাটি নির্মাণে বরাদ্দ ৭৫ লাখ ৭৯ হাজার ৬৬০ টাকা। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে সম্প্রতি কাজ শেষ হয়েছে। জসীম এন্টারপ্রাইজ নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, গেজেটভুক্ত ছাড়া কোনো রাস্তায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর সংস্কার বরাদ্দ দেয় না। রাস্তাটি হয়তো গেজেটভুক্ত। এ কারণে প্রভাব খাটিয়ে আতিকুল বরাদ্দ করিয়েছেন। অধিদপ্তরের শ্রীপুর উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুস সামাদ পত্তনদার জানান, রাস্তাটি নির্মাণের ক্ষেত্রে তাদের কাজ ছিল শুধু তদারকি। কুমিল্লার সন্তান আতিকুল ইসলাম বিজিএমইএর সভাপতি ছিলেন। ২০১৯ সালে তিনি উপনির্বাচনে ঢাকা উত্তরের মেয়র হন। এর পর ২০২০ সালেও নির্বাচিত হন। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর আত্মগোপন করেন আতিকুল। গত ১৭ অক্টোবর মোহাম্মদপুর থানার মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কারাগারে থাকায় সমকাল তাঁর বক্তব্য জানতে পারেনি। আতিকুলের বাগানবাড়ির দায়িত্বে থাকা মশিউর রহমানও কথা বলতে রাজি হননি।জানা যায়, একটি শিল্পকারখানা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ২০০৮ সালের মাঝামাঝি শ্রীপুরে ফসলি জমি কেনা শুরু করেন আতিকুল। ধনুয়া গ্রামের বাবুল আহমেদের মাধ্যমে তিনি লবণদহ খালের পূর্ব পাশের সব জোতদারের জমি কেনেন। বাবুল আহমেদ সমকালকে জানিয়েছেন, ১১২ জোতদারের কাছ থেকে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা করে ৫২ বিঘা জমি কেনেন আতিকুল ইসলাম। জমি ফুরিয়ে গেলে তাঁর নজর পড়ে শত বছরের পুরোনো লবণদহ খালে। তিনি বলেন, শিল্পকারখানার জন্য জমি কিনলেও আতিকুল বাগানবাড়ি করেছেন। কাগজপত্রে এখন লবণদহ খালের অস্তিত্ব নেই।সরেজমিন দেখা যায়, আতিকের বাগানবাড়ি সীমানাপ্রাচীরে ঘেরা। একটি অংশে দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা থাকলেও খালের অংশ ফাঁকা। গাছগাছালিতে পূর্ণ। এখন আর খালি চোখে বোঝার উপায় নেই ভেতরে সরকারি কোনো রাস্তা ছিল।স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, ময়মনসিংহের ভালুকার খিরু নদী থেকে উৎপত্তি লবণদহ খালের। প্রায় ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ খালটি গাজীপুরের ওপর দিয়ে মিশেছে তুরাগ নদে। তিন দশক আগেও খালে বইত স্বচ্ছ পানি, পাওয়া যেত নানা প্রজাতির মাছ। কয়েক বছর আগেও শিল্পকারখানার তরল বর্জ্য দেখা যেত। কিন্তু এখন খালটি অস্তিত্বহীন।যতীন্দ্রমোহন রায় তাঁর ‘ঢাকার ইতিহাস’ বইয়ে লবণদহ খালের কথা লিখেছেন। ১৯১২ সালে প্রকাশিত বইয়ে রয়েছে– মধুপুরের জঙ্গল থেকে বহির্গত শালদহ, লবণদহ ও গোয়ালিয়র হয়ে খালটি মিলিত হয়েছে তুরাগ নদে।বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মনির হোসেন বলেন, ‘শত বছরের পুরোনো লবণদহ খাল রেকর্ডে না থাকলেও এখন তা সংশোধন করা উচিত। ক্ষমতা খাটিয়ে কেন, এমনিতেও নদী বা খাল দখল করে স্থাপনা নির্মাণ আইনবিরোধী। দখলকারীদের শাস্তি হওয়া উচিত।’বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল শ্রীপুর শাখার সভাপতি সাঈদ চৌধুরী বলেন, ‘খিরু নদী থেকে শ্রীপুরে এসে লবণদহ খালে পরিণত হয়েছে। মেয়র আতিকুল বাগানবাড়ির জন্য যেভাবে এটি দখল করেছেন, তা নদী হত্যার শামিল। দখলমুক্ত করার পাশাপাশি সরকারের কাছে এটিকে নদীর জায়গা হিসেবে রেকর্ডে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানাচ্ছি।’বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড গাজীপুরের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী রায়হান খান সমকালকে জানান, সম্প্রতি তারা পরিদর্শনে গিয়ে জানতে পারেন আতিকুল ইসলাম খালের একাংশ দখল করেছেন। শিগগির ওই অংশ পরিদর্শন করা হবে। প্রমাণ পেলে শুধু আতিকুল নন, বাকি দখলদারও উচ্ছেদ করা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *