মুশুদ্দিতে নদী দখল করে মন্ত্রী রাজ্জাকের কলেজ নির্মাণ, আমেরিকায় ১২ পেট্রোল পাম্প

টাঙ্গাইল জেলা প্রতিনিধি

রাহিদ রানা

রাজধানীর গুলশান ও বনানীতে বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট ও নিজ গ্রামের বাড়িতে ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে বিলাশ বহুল বাড়ি নির্মাণ করাসহ আমেরিকার ১২টি পেট্রোল পাম্পের শেয়ার আর সুপারশপসহ অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিক টাঙ্গাইল-১ (মধুপুর-ধনবাড়ি) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মন্ত্রী ও আওয়ামীলীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ড.আব্দুর রাজ্জাক।
এছাড়াও ধনবাড়ির মুশুদ্দি গ্রামের বৈরান নদীর প্রায় ২০০ একর জমি দখল করে মায়ের নামে মুসুদ্দি রেজিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠা করাসহ বাংলাদেশ মেডিকেল স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (বিএমএসআরআই) চেয়ারম্যান পদে এখনও বহাল থাকার অভিযোগ রয়েছে সাবেক মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক এর বিরুদ্ধে। ওই পদটি পেয়ে গত সাত বছরে তিনি দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অবৈধ নিয়োগ ও পদোন্নতি বাণিজ্যের মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।
অন্যদিকে ধনবাড়ির ভাইঘাট পালবাড়ীর মতি ড্রাইভারের ছেলে রাব্বির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এর সুবাদে গত বছরের সেপ্টেম্বরে স্ক্যামিং পর্নোগ্রাফি ব্যবসায় জড়িত রাব্বির বিরুদ্ধে সিআইডির করা মামলার নাম কাটিয়ে দেয়ার অভিযোগও রয়েছে সাবেক এই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে।
শুধু এখানেই শেষ নয় সাবেক মন্ত্রী ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনিসহ তার সকল স্বজনরাই পদোন্নতি, টেন্ডার, নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য। এছাড়া নির্বাচনী এলাকার মধুপুর ধনবাড়িতে জমি দখল, শালিস, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, থানার দালালী এসব চলছে মন্ত্রীর মদদে।
এরআগে ১৪ অক্টোবর রাত পৌনে ৮টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় রাজধানীর নিউ ইস্কাটন গার্ডেন এলাকা থেকে গ্রেফতার হন সাবেক কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক। অন্যদিকে সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক ও তার স্ত্রী শিরিন আক্তার বানুসহ পরিবারের সদস্যদের ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংক হিসাবে লেনদেন স্থগিতের পাশাপাশি সব ব্যাংক হিসাব সংশ্লিষ্ট তথ্য বা দলিল, যেমন হিসাব খোলার ফরম, কেওয়াইসি, লেনদেন বিবরণী বিএফআইইউর কাছে পাঠাতে বলা হয়েছে।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্রজনতার আন্দোলনে টাঙ্গাইলের তিন থানার ২টি হত্যাসহ তিনটি মামলায় ১৫ দিনের রিমান্ড শেষে সম্প্রতি ড, আব্দুর রাজ্জাককে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

সাবেক কৃষি মন্ত্রীসহ সকল আত্মীয়-স্বজনদের অবৈধ সম্পদের তদন্ত আর আইনের আওতায় এনে তাদের বিচার করার জোর দাবি জানিয়েছে এলাকাবাসী।

স্থানীয়রা জানায়, ডক্টর আব্দুর রাজ্জাক রাজনীতিতে আসার আগে ছিলেন সরকারের আমলা। ২০০১ সালে আওয়ামীলীগের মনোনয়নে প্রথম এমপি হন তিনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত তাঁর জীবনযাপন ছিল সহজ-সরল। এ সময় আওয়ামীলীগের এই নেতার নির্বাচনী এলাকা মধুপুর ও ধনবাড়িতে কোনো বাড়িও ছিল না। পুরোনো মডেলের গাড়ি নিয়ে এলাকায় আসতেন। সরকারে খাদ্য এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এরপরই তিনি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। দল ও সরকারি কাজে আধিপত্য বিস্তার করেন তিনি। আত্মীয়স্বজন ও অনুগত ব্যক্তিদের পদ-পদবি ও জনপ্রতিনিধি বানিয়ে নেতৃত্বে বসাতে শুরু করেন। টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, জমি দখলসহ নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ড. রাজ্জাক ২০১৮ সালের নির্বাচনে জিতে হন কৃষিমন্ত্রী। এরপর পুরো টাঙ্গাইল জেলাই চলে আসে তাঁর একক নিয়ন্ত্রণে। জেলার বড় বড় ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নেন তাঁর আত্মীয় স্বজনরা। ২০১৫ সালে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি উপজেলার মুশুদ্দি গ্রামের বৈরান নদীর প্রায় ২০০ একর জমি দখল করে সাবেক মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক তার মায়ের নামে প্রতিষ্ঠা করেন মুশুদ্দি রেজিয়া কলেজ। এছাড়াও ২০২২ সালে মুসুদ্দি ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। মুশুদ্দি গ্রামের বৈরান নদীটি দখল হওয়ার ফলে রীতিমত ওই এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়াও রাজ্জাকের ভাই মুশুদ্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু কায়ছার বলিভদ্র এলাকার শত শত একর কৃষিজমি মাটি ভরাট করে দখলে নিয়েছেন। সেখানে তিনি কারখানা করবেন বলে জানান স্থানীয়রা। আওয়ামীলীগের শাসন আমলের ১৫ বছর বিভিন্ন দপ্তরের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তার আত্মীয়দের মাধ্যমে লোপাট করেছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। এসব আত্মীয়দের মাধ্যমে সিঙ্গাপুর,মালয়েশিয়া,আমেরিকা করেছেন সম্পদের পাহাড়। দেশের কৃষি খাতে উন্নয়নের নামে একের পর এক প্রকল্প বানিয়ে বাজেট থেকে শত শত কোটি টাকা লোপাট করেছেন সাবেক এই মন্ত্রী। নিজের অবৈধ সম্পদ বৈধ করতে সাবেক মন্ত্রী রাজ্জাক আত্মীয়দের বানিয়েছেন ঠিকাদার। এছাড়াও সাবেক কৃষি মন্ত্রী ডক্টর আব্দুর রাজ্জাক বাংলাদেশ মেডিকেল ষ্টাডিজ এন্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউটের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় করেছেন ভর্তি বাণিজ্য। প্রত্যেক স্টুডেন্ট এর কাছ থেকে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়াসহ বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের ভিতরে দোকান বরাদ্দ বাবদ কামিয়ে নিয়েছেন শত শত কোটি টাকা।

অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, আব্দুর রাজ্জাকের পক্ষে হারুনুর রশিদ হিরা এবং মামাতো ভাই নূরানি কনস্ট্রাকশনের মালিক তরিকুল ইসলাম তারেক স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড, সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং গণপূর্তসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ ভাগাভাগির অঘোষিত নিয়ন্ত্রক বনে যান। তাদের যোগসাজসে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের কাছ থেকে প্রকল্পের মোট বরাদ্দের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কমিশন নিতেন সাবেক মন্ত্রী রাজ্জাক। বাকি কাজ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আত্মীয় স্বজনদের মাঝে বন্টন করতেন।

রাজ্জাক ও তাঁর সিন্ডিকেটের অনুগত গুটিকয় ঠিকাদার ছাড়া বেশির ভাগ দরপত্রে অন্য কেউ অংশ নিতেও পারতেন না। ওই প্রভাবে টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং টাঙ্গাইল সার্কিট হাউসের মত বড় বড় ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নেন নূরানি কনস্ট্রাকশনের মালিক তরিকুল ইসলাম তারেক। এসব কাজে মন্ত্রী রাজ্জাকেরও ছিল সমান ভাগ। রাজনৈতিক ক্ষমতাবলে টাঙ্গাইল চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রির সাধারণ সম্পাদকের পদটিও বাগিয়ে নিয়েছিলেন মন্ত্রী রাজ্জাকের মামাতো ভাই তারেক।

এ ছাড়া ড. রাজ্জাক কয়েকজন অনুগতকে দিয়ে এলাকাকে সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত করেন। যারা সাধারণ মানুষের জমি, বাড়ি ও পুকুর দখলসহ নানা অবৈধ কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এই অনুগতদের মধ্যে ছিলেন মধুপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র সিদ্দিক হোসেন খান, উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইশতিয়াক আহমেদ সজীব, যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আলমগীর হোসেন শিমুল, বিএনপি থেকে আওয়ামীলীগে যোগ দেয়া আনোয়ার হোসেন প্রমুখ।

উঠে আসা সাবেকমন্ত্রী রাজ্জাক ও তার আত্মীয়দের সম্পদের তথ্য-
রাজধানীর গুলশান ও বনানীতে ড. রাজ্জাকের রয়েছে বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট। আমেরিকায় রয়েছে একাধিক পেট্রোল পাম্প, সুপারশপসহ অনেক প্রতিষ্ঠান।
ধনবাড়ীর ভাইঘাট পালবাড়ীর মতি ড্রাইভারের ছেলে রাব্বির মাধ্যমে তিনি হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এই রাব্বি স্ক্যামিং পর্নোগ্রাফি ব্যবসায় জড়িত থাকায় গত বছরের সেপ্টেম্বরে তাঁর নামে সিআইডি থেকে মামলা করা হয়েছিল। পরে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের মাধ্যমে মামলা থেকে রাব্বির নাম কাটিয়ে নেন রাজ্জাক।
আব্দুর রাজ্জাকের আমেরিকা ও সুইডেনপ্রবাসী ভাইদের কাছেও অবৈধভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তার ছোট ছেলে রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত এর রয়েছে সিঙ্গাপুর,ভারত ও মালয়েশিয়া হোটেল ব্যবসা। রাজ্জাকের সহোদর ভাই বাচ্চু মিয়া থাকেন আমেরিকায়, সাবেক মন্ত্রীর সহযোগিতায় ও মন্ত্রণালয়ে তদবির বাণিজ্যের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার মালিকও হয়েছেন তিনি। এসব টাকা আমেরিকায় পাচার করে বারোটি পেট্রোল পাম্প করেছেন বাচ্চু মিয়া। অলিখিতভাবে সাবেক মন্ত্রীর ডক্টর রাজ্জাক ওই পাম্পের শেয়ার বলেও জানা গেছে।
রাজ্জাকের আপন ভাই মুশুদ্দি ইউপির চেয়ারম্যান কায়সারের রয়েছে হাজার বিঘা জমি। বলিভদ্র এলাকায় কারখানা করার জন্য শত শত একর কৃষি জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। ভূমিদস্যু হিসেবে পরিচিত কায়সার নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। ২০১৫ সালে ধনবাড়ীর মুশুদ্দিতে নদীর ২০০ একর জমি দখল করে রাজ্জাকের মায়ের নামে রেজিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠা করার ফলে ওই এলাকায় এখন রীতিমত জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। এ বিষয়ে এলাকাবাসী জাতীয় নদী কমিশনে লিখিত অভিযোগ দিলেও রাজ্জাকের প্রভাবে সে অভিযোগের কোন তদন্ত হয়নি।

ড. রাজ্জাকের খালাতো ভাই হারুনুর রশিদ হিরার আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আশার পূর্বে তেমন কিছু ছিলোনা, সাবেক মন্ত্রীর ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান দিয়ে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। টাঙ্গাইল জেলার মধ্যে শ্রেষ্ঠ করদাতা বর্তমানে বিভিন্ন ব্যাংকে তার নামে ১০০ কোটি টাকার এফডিআর রয়েছে। রয়েছে পেট্রোল পাম্প, কয়েকশ বিঘা জমিসহ রাজধানীর বসুন্ধরায় দশ তলা দুটি ভবন। আরেক খালাতো ভাই দেলোয়ার বিআরটিএ থেকে অবৈধ বাণিজ্যের মাধ্যমে ঢাকায় করেছেন ফ্ল্যাট ও বাড়ি। খালাতো ভাই রিপনও কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। ওয়ান-ইলেভেনের সময় দুর্নীতির দায়ে আরেক খালাতো ভাই বিআরটিএতে চাকরিরত শহীদুল্লাহ কায়সারের চাকরি চলে যায়। ২০০৯ সালে রাজ্জাক মন্ত্রী হওয়ার পর শহীদুল্লাহ কায়সারকে চাকরি ফেরত দিয়ে বিআরটিএর পরিচালক করা হয়। এই খালাতো ভাইও তিতাস ফিলিং স্টেশন নামে পেট্রোল পাম্পসহ ঢাকায় একাধিক ফ্ল্যাট এবং নামে-বেনামে প্রচুর টাকার মালিক হয়েছেন। এছাড়াও সাবেক এই মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী মাসুদের নামেও রয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ। মাসুদ অস্ট্রেলিয়ায় বাড়ি কিনেছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। মাসুদের দুর্নীতির কারণে সাবেক এমপি ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন মামলা করলে সেটি সাবেক আইনমন্ত্রীর মাধ্যমে খারিজ করান রাজ্জাক।
মন্ত্রী রাজ্জাকের খালাত ভাই রনু। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে তিনি গার্মেন্টসে চাকরি করতেন। ড. আব্দুর রাজ্জাক কৃষি মন্ত্রী হওয়ার পর ভাইয়ের দাপটে আর মদদে বর্তমানে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। করেছেন মালয়েশিয়ায় হোটেল ব্যবসা।
সাবেক কৃষি মন্ত্রী আরেক চাচাতো ভাই রেজা। আওয়ামী লীগের ক্ষমতার আসার আগে মালোশিয়া শ্রমিকের কাজ করতেন,। আওয়ামী লীগের ক্ষমতা আসার পর রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যান তিনি। ক্ষমতার অপব্যবহার করে সেজেছেন বড় ঠিকাদার। সাবেক কৃষি মন্ত্রী ক্ষমতার অপব্যবহার করে ভুয়া কাজ দেখিয়ে কৃষি দপ্তরের একচেটিয়া ঠিকাদারি কাজ করছেন তিনি । বর্তমানে তিনিও হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে। সাবেক মন্ত্রীর মামাত ভাই রিপন। তিনি মধুপুর শহরের ট্রলি চালানোর কাজ করতেন। ড. রাজ্জাক কৃষি মন্ত্রী হওয়া পর রাতারাতি ভাগ্য খুলে যায় তার। বর্তমানে তিনিও শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।।
সাবেক মন্ত্রীর বোন জামাই বেলাল প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরে চাকরি করেন, বর্তমানে তিনিও সাবেক মন্ত্রীর ক্ষমতার অপব্যবহার করে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।

মুশুদ্দি গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ মাহাবুব জানান, আমাদের মুশুদ্দি গ্রামের বৈরান নদীটি ছিল প্রবাহমান। আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী ড. রাজ্জাক তার মায়ের নামে কলেজ করে নদীটি দখল করে রেখেছেন। পানি প্রবাহ বন্ধ থাকার কারণে মুশুদ্দি এলাকার কামাড়পাড়া, বাইন্দাপাড়া, গোনাভাতকুড়া, ভাতকুড়া, ফুলবাড়ি, কয়ড়া, আটাপাড়া, চরপাড়া, চরধলি ও খাসপাড়া এলাকায় ২০ হাজারের বেশি কৃষক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। নদীতে বাঁধ দিয়ে দখল করার কারণে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে কাইলাচড়া, ফুলবাড়ি, চাটকি বিল, সুতারিপুড়ি বিল, কাহিলাপুড়ি বিল কয়ড়া হয়ে হাইক্কা বিলে পানি নামা বন্ধ রয়েছে। নদী দখলের মত হীন কাজটি সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক ও তার ভাই আবু কায়ছারের প্রত্যক্ষ মদদে হয়েছে। ঝোপনা থেকে দরিচন্দ্র বাড়ি পর্যন্ত বাঁধ দেওয়া প্রায় আধা কিলোমিটার নদী উদ্ধার করে স্বাভাবিক গতিপথ ফিরিয়ে আনার জন্য দাবি জানান মাহাবুব।
রাজ্জাকের ভাই মুশুদ্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু কায়ছার বলিভদ্র এলাকায় শত শত একর কৃষিজমি মাটি ভরাট করে দখলে নিয়েছেন। তিনি সেখানে কারখানা করবেন বলেও জানান তিনি।

স্থানীয় কৃষকরা জানান, কায়ছার চেয়ারম্যান এলাকাবাসীর কাছ থেকে জমি কেনার কথা বলে জমি নিয়ে আর টাকা দেননি।

বলিভদ্র গ্রামের মতি জানান, আমার কৃষিজমি দখল করেছেন কায়ছার চেয়ারম্যান। তার মন্ত্রী ভাইয়ের প্রভাব খাটিয়েছেন। আমরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে বারবার অভিযোগ করে কোনো সমাধান পাইনি।

আরেক কৃষক মোস্তফা জানান, আমার সংসার চালাই কৃষি কাজ করে। আর সেই জমি কায়ছার চেয়ারম্যান দখল করে নিয়েছেন। আমরা তার বিরুদ্ধে মানববন্ধনও করেছি। কিন্তু তার ভাই আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ছিলেন বলে তাদের ক্ষমতার সামনে আমরা টিকতে পারিনি। তিনি আরও জানান, আমাকে টাকা দেবে বলেছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত একটা টাকাও পায়নি।
ধনবাড়ি উপজেলার ব্যবসায়ী সামাদ মিয়া জানান, সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক ভোলার আত্মীয় স্বজনরা তেমন কিছুই ছিলেন না। মন্ত্রী থাকাকালীন তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তারা।

ওষুধ দোকান ব্যবসায়ী সুমি ইসলাম জানান , বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজে আমার একটি দোকান বরাদ্দ ছিল। দোকানের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর সাবেক কৃষি মন্ত্রী আমাকে ডেকে নিয়ে বলেন আপনি আর দোকান বরাদ্দ পাবেন না। তার চাচাতো ভাই হানিফকে দিয়ে আমাকে ৫০ লাখ টাকার প্রস্তাব করেন। এবং টাকা না দিলে আমার দোকান বরাদ্দ বাতিল করে দিবেন বলে হুমকি দেন। তিনি আরও জানান, চেয়ারম্যান থাকার সুবাদে ভর্তি বাণিজ্যের মাধ্যমে স্টুডেন্টদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা।

ধনবাড়ী উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ওয়াদুদ তালুকদার সবুজ জানান, ক্ষমতায় থাকতে মধুপুর ও ধনবাড়ীতে আব্দুর রাজ্জাকের কথাই ছিল শেষ কথা ছিল। ক্ষমতায় আসার আগে প্রভাবশালী এই নেতাসহ তার আত্মীয় স্বজনের কিছুই ছিল না। মন্ত্রীর হওয়ার সুবাদে তারাও এখন কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। টেন্ডারবাজি ও দখলবাজি করতে গিয়ে দলের ভেতরে বিভেদ তৈরি করেছেন মন্ত্রী রাজ্জাক। ত্যাগী নেতাকর্মীকে উপেক্ষা করেছেন। নিজ দলের লোকজনকে মামলা করে জেল খাটিয়েছেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) টাঙ্গাইলের সাধারণ সম্পাদক তরুণ ইউসুফ জানান, ড. রাজ্জাক ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

এ বিষয়ে টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মতিউর রহমান বলেন, বৈরান নদী দখলের তথ্য যাচাইয়ের জন্য কর্মকর্তা পাঠানো হবে। দখল হয়ে থাকলে আইন অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

উল্লেখ্য, টাঙ্গাইল-১ (মধুপুর-ধনবাড়ি) আসন থেকে টানা পাঁচবার ২০০১, ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়নে টাঙ্গাইল-১ (মধুপুর-ধনবাড়ি)আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ২০০৯ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, ২০১২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আর ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি থেকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ড. আব্দুর রাজ্জাক। ২০১৬ সালে আব্দুর রাজ্জাক বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য (সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কমিটি) নির্বাচিত হন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *