সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, পানিবন্দি ৭ লাখ মানুষ
অনলাইন ডেস্ক: সুরমা নদীর পানি সিলেট নগর ছুঁই ছুঁই করছে। নদীর পানি আরেকটু বাড়লে তা নগরে ঢুকে পড়বে। এ রকম পরিস্থিতিতে বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। আজ ভোর ছয়টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ছয় ঘণ্টায় সিলেটে ৮২ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। সঙ্গে পাহাড়ি ঢল মিলিয়ে জেলাজুড়ে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। এরই মধ্যে জেলার প্রায় ৭ লাখ মানুষ বন্যাক্রান্ত হয়েছেন। তিন নদী ৫ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সিলেটের জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, সিলেট সিটি করপোরেশনের ৪২টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২১টি ওয়ার্ড এবং জেলার ১৩ উপজেলার ১১১টি ইউনিয়নের মধ্যে ১০২টি ইউনিয়নই বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। এতে করে সিটি করপোরেশন ও উপজেলাগুলোর ৬ লাখ ৭৫ হাজার ৯৩৭ জন মানুষ বন্যাক্রান্ত হয়েছেন। বন্যাকবলিত মানুষের জন্য ৬২৭টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর মধ্যে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে উঠেছেন ১৭ হাজার ২৮৫ জন মানুষ।
সিলেট নগর এলাকায় অর্ধ লাখ মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছেন।
১৩ উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত গোয়াইনঘাট উপজেলার ১৩ ইউনিয়নের সবকটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এতে উপজেলার ১ লাখ ২৩ হাজার ৮০০ জন মানুষ বন্যাক্রান্ত হয়েছেন। প্লাবিত হয়েছে উপজেলার ২২৩টি গ্রাম।
আবহাওয়া অধিদপ্তর সিলেট সূত্রে জানা গেছে, সিলেটে বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। মঙ্গলবার ভোর ৬টা থেকে আজ বুধবার ভোর ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সিলেটে বৃষ্টিপাত হয়েছে ১০০ মিলিমিটার।
আজ ভোর ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত মাত্র ছয় ঘণ্টায় সিলেটে বৃষ্টিপাত হয়েছে ৮২ দশমিক ২ মিলিমিটার। এর মধ্যে ভোর ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত হয়েছে ৫৫ মিলিমিটার। আগামী তিন দিন ভারি ও মাঝারি বৃষ্টিপাতের পূর্ভাবাস রয়েছে। এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন আবহাওয়া অধিদপ্তর সিলেট কার্যালয়ের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ্ সজিব হোসেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেট সূত্রে জানা গেছে, জেলার সব পয়েন্টে নদীর পানি বাড়ছে। এর মধ্যে ছয় পয়েন্টে নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুরমা নদী সিলেট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৮৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুশিয়ারা নদী জকিগঞ্জের অমলসিদ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে, ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৯৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং শেরপুরে পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া গোয়াইনঘাট পয়েন্টে সারি গোয়াইন নদীর পানি বিপৎসীমার ৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
নগর পরিস্থিতি
সুরমা নদীর পানি নগর ছুঁই ছুঁই করায় নগরের বন্যা পরিস্থিতি আরো খারাপের আশঙ্কা করা হচ্ছে। আজ দুপুরে নগরের কিনব্রিজ সংলগ্ন সুরমা নদী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে চাঁদনী ঘাটের শেষ সিঁড়ি পর্যন্ত নদীর পানি উঠে এসেছে। আরেকটু পানি বাড়লেই তা শহরের এই অংশ দিয়ে প্রবেশ করবে। আবার খানিকটা পশ্চিম দিকে এগিয়ে কোতোয়ালি থানা এলাকার পার হয়ে দেখা গেছে সেখানে নদীর পানি রাস্তায় উঠে এসেছে। এ ছাড়া নগরের তোপখানা, সিলেটের সবচেয়ে বড় আড়ৎ ঐতিহ্যবাহী কালিঘাট এলাকা, কাজিরবাজার, কাষ্টঘর, সোবহানীঘাট, মাছিমপুর, মেন্দিবাগ, উপশহর তেরোরতন, যতরপুর, সোনারপাড়া, খাঁর পাড়া, তালতলা, জামতলাসহ বিভিন্ন এলাকা জলমগ্ন হয়ে আছে। কোতোয়ালী থানা প্রাঙ্গণ, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সিলেট কার্যালয় প্রাঙ্গণসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রতিষ্ঠানের উঠান জলমগ্ন হয়ে আছে।
বন্যায় এক মিনিটও বন্ধ থাকবে না সিসিকের কার্যক্রম
উদ্ভুত পরিস্থিতিতে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান মঙ্গলবার রাত আটটার দিকে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে তিনি নগরবাসীকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘যতদিন বন্যার পানি না কমছে, ততদিন আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। নগর ভবনে কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে। এখান থেকে সকল কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। এসব কার্যক্রম আমি নিজে তদারিক করব। এক মিনিটের জন্যও আমাদের কার্যক্রম বন্ধ হবে না।’
সার্বিক পরিস্থিতির জন্য সিসিকের তদারকি টিম গঠন করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করবো। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মানুষ যেন ভোগান্তি না পোহান সেদিকে নজর রাখা হয়েছে। শুকনো ও রান্না করা খাবার তাদের দেওয়া হচ্ছে। সঙ্গে প্রয়োজনীয় ওষুধও দেওয়া হচ্ছে। বন্যার্তদের দুর্ভোগ কমাতে যথাযথ সব করা হবে।’ বিদ্যুৎকেন্দ্র রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও পানি উন্নয়ন বোর্ড কাজ করছে বলে তিনি জানান।
উপজেলাগুলোর পরিস্থিতি
সিলেটের ১৩ উপজেলার সবকটি বন্যা কবলিত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে গোয়াইনঘাট উপজেলা। এরপরই আছে কানাইঘাট ও কম্পানীগঞ্জ উপজেলা। বন্যায় তলিয়ে যাওয়া গোয়াইনঘাট উপজেলার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। সিলেটের সঙ্গে উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে। পাশাপাশি গোয়াইনঘাট উপজেলা সদরের সঙ্গে ইউনিয়নগুলোর সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। উপজেলায় এখন চলাচলের একমাত্র নৌকা।
বন্যাকবলিত গোয়াইনঘাট উপজেলার মানুষের পাশে দাঁড়াতে উপজেলা প্রশাসন প্রশংসনীয় কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে প্রশাসনের স্মার্ট কুইক রেসপন্স টিম এবং ৩৩৩ হটলাইনের ইমার্জেন্সি সার্ভিস অ্যান্ড লজিস্টিকস টিমের কাজ প্রশংসিত হচ্ছে। উপজেলার বন্যা দুর্গত এলাকায় কুইক রেস্পন্স টিম ভলান্টিয়াররা নৌকার মাধ্যমে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। পাশাপাশি ৩৩৩ ও ৯৯৯ হেল্পলাইনে প্রাপ্ত কলের ভিত্তিতে প্রশাসনের উদ্যোগে বন্যায় পানিবন্দি জনগণকে খাবার ও জরুরি সামগ্রী (পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, ঔষধ, শিশু খাদ্য, গো-খাদ্য) পৌঁছে দিচ্ছে উপজেলা প্রশাসন, গোয়াইনঘাটের উদ্যোগে পরিচালিত জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় তরুণ-যুবকদের অংশগ্রহণে সংগঠিত স্মার্ট কুইক রেস্পন্স ভলান্টিয়ার টিম।
এদিকে বন্যায় কানাইঘাট উপজেলার চতুল-দরবস্ত সড়ক, গাজী বোরহান উদ্দিন সড়ক, কানাইঘাট শাহবাগ সড়ক, সুরইঘাট-কানাইঘাট সড়কের নিচু এলাকা দিয়ে বন্যার পানি তীব্র বেগে প্রবাহিত হওয়ায় সিলেটের সঙ্গে কানাইঘাট সদরের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। কানাইঘাট-শাহবাগ সড়কের রামপুরে সম্প্রতি ১ম দফার বন্যায় ভেঙে যাওয়া সড়কের স্থান পানির তীব্র স্রোতে বিশাল আকারে ভেঙে গিয়ে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামীণ রাস্তা-ঘাট, সুরমা, লোভা ও কুশিয়ারা নদীর পানি অব্যাহতভাবে বেড়ে যাওয়ায় তলিয়ে গেছে। শত শত বাড়ি-ঘর বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার মানুষ।
এ ছাড়া কম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, সিলেট সদর, বিশ্বনাথ, ফেঞ্চুগঞ্জ, দক্ষিণ সুরমা, বালাগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ উপজেলার সবকটি ইউনিয়ন কমবেশি প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া জকিগঞ্জ উপজেলার ৯ ইউনিয়নের ৪ ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে।