জেনারেল আজিজকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা
ডেস্ক রিপোর্ট: সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ব্যাপক দুর্নীতি এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া খর্বে তাঁর সম্পৃক্ততায় এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। গতকাল ভোরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর স্টেট ডিপার্টমেন্ট এক বিবৃতিতে এ কথা জানিয়েছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ভিসানীতি ঘোষণার পর এ প্রথম বাংলাদেশের সাবেক কোনো শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে আজিজ আহমেদের নিষেধাজ্ঞা নির্বাচনসংক্রান্ত নয়, বরং দুর্নীতি ও সুশাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর ফলে আজিজ আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা স্বাভাবিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারবেন না।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ গতকাল গণমাধ্যমকে বলেন, এমন কোনো অপরাধ করিনি যে শাস্তি পেতে হবে। তারা যে অভিযোগের কথা বলছে সেগুলো সত্য নয়। আর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সম্পূর্ণভাবে তাঁর জন্য প্রযোজ্য নয়।
এ ব্যাপারে গতকাল পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) এক অনুষ্ঠানে বলেন, জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র-ঘোষিত ভিসানীতির অধীনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি। দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে আজিজ আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি জনসমক্ষে আনার আগে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসকে জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। স্টেট ডিপার্টমেন্টের বিবৃতি : বিবৃতিতে স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার জানান, স্টেট ডিপার্টমেন্ট, ফরেন অপারেশনস এবং রিলেটেড প্রোগ্রামস অ্যাপ্রোপ্রিয়েশনস অ্যাক্টের ৭০৩১ (সি) ধারায় এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এ নিষেধাজ্ঞার কারণে আজিজ এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারবেন না বলেও বিবৃতিতে বলা হয়েছে।
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে : ব্যাপক দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ। তাঁর বিভিন্ন কর্মকান্ডে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবমূল্যায়ন এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের আস্থা কমেছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্যভাবে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন আজিজ আহমেদ।
একই সঙ্গে কোনো ধরনের জবাবদিহি ছাড়াই নিজের ভাইকে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করার সুযোগ করে দিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া অন্যায্যভাবে সামরিক খাতে কন্ট্রাক্ট পাওয়া নিশ্চিত করার জন্য তিনি তাঁর ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। তিনি নিজের স্বার্থে সরকারি নিয়োগের বিনিময়ে ঘুষ নিয়েছেন। এ নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং আইনের শাসন শক্তিশালী করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ম্যাথিউ মিলারের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে : আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও আইনের শাসন শক্তিশালী করতে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকার পুনরায় নিশ্চিত করা হলো। সরকারি সেবা আরও স্বচ্ছ ও নাগরিকদের সেবালাভের সুযোগ তৈরি, ব্যবসা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং অর্থ পাচার ও অন্যান্য অর্থনৈতিক অপরাধের অনুসন্ধান ও বিচার নিশ্চিতে সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশে দুর্নীতিবিরোধী প্রচেষ্টায় সহায়তা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
জেনারেল আজিজ আহমেদ ২০১৮ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত তিন বছর বাংলাদেশের চিফ অব আর্মি স্টাফ ছিলেন। তাঁর আগে ২০১২ সাল থেকে চার বছর তিনি সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিজিবির মহাপরিচালক ছিলেন। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছিল।
এর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন’-এর অভিযোগে বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র্যাব এবং এর সাবেক-বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। সে নিষেধাজ্ঞার মধ্যে ছিলেন সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও ছয় সেনা কর্মকর্তা।
সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের আগে ঘোষিত ভিসানীতির আওতায় গত বছরের সেপ্টেম্বরে কিছু বাংলাদেশির ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার কথা জানায় যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু কতজন বা কাদের ওপর এ ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে তা প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হয়নি। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে ঘোষিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের অনুরোধ জানানো হলেও যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি অনুসারে যাকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় তার স্ত্রী, সন্তান ও পিতা-মাতাও নিষেধাজ্ঞার আওতায় চলে আসেন।
শাস্তি পাওয়ার মতো কোনো কাজ করিনি : গতকাল গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ বলেন, এমন কোনো অপরাধ করিনি যে শাস্তি পেতে হবে। তারা যে অভিযোগের কথা বলছে সেগুলো সত্য নয়। আর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সম্পূর্ণভাবে তাঁর জন্য প্রযোজ্য নয়। আজিজ আহমেদ বলেন, আমার বিরুদ্ধে দুটি দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রথমটি হলো, আমি আমার ভাইকে তার অপরাধ কর্মকান্ড থেকে বাঁচাতে নিজের পদপদবি ব্যবহার করেছি। দ্বিতীয়টি হলো, আমি সেনাপ্রধান হিসেবে আমার ভাইকে সামরিক কন্ট্রাক্ট দিয়ে ঘুষ নিয়েছি। কিন্তু আমি জেনারেল হওয়ার অনেক আগে থেকে আমার সেই ভাই বিদেশে থাকে। নিশ্চয়ই সে বৈধ পাসপোর্ট নিয়েই বিদেশে গিয়েছে। এখানে আমার পদপদবি ব্যবহার করে আইন ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে, যা আমি মেনে নিতে পারি না। এটা সঠিক নয়। দ্বিতীয় অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, বিজিবির মহাপরিচালক এবং সেনাপ্রধান থাকাকালে আমার কোনো ভাই বা নিকটাত্মীয় এ দুই প্রতিষ্ঠানের কোথাও ঠিকাদারি করেছে তার কোনো তথ্যপ্রমাণ দিতে পারলে আমি সব মেনে নেব। শুধু তাই নয়, এ প্রতিষ্ঠান দুটিতে তাদের কোনো লাইসেন্স থাকার প্রমাণ দিতে পারলেও আমি সব শাস্তি মেনে নেব।
বাংলাদেশের সাবেক এই সেনাপ্রধান বলেন, বিজিবি ও আর্মি প্রেস্টিজিয়াস ইনস্টিটিউশন। সব সময় সতর্ক ছিলাম, আমার কোনো কর্মকান্ডে যেন এ দুটি বাহিনীর সুনাম ক্ষুণ না হয়। যেহেতু বর্তমান সরকারের সময় আমি সেনাপ্রধান ছিলাম, সরকারকে হেয় করার জন্যও এ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হতে পারে।
যা বললেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সচিবালয়ে এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের বলেন, একটা বিষয় আমি বুঝতে পেরেছি, মার্কিন সরকার অনেক দেশের অনেক ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। অনেক দেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এটা তাদের জন্য নতুন কিছু না। আমাদের দেশে যাকে দেওয়া হয়েছে, আমাদের কাছে এখনো সেটা সঠিকভাবে আসেনি। এলে পরে জানতে পারব, কেন দেওয়া হয়েছে।