আস্থা-বিশ্বাস পুনর্নির্মাণ চায় যুক্তরাষ্ট্র

ডেস্ক রিপোর্ট: বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের আস্থা ও বিশ্বাস পুনর্নির্মাণ চায় যুক্তরাষ্ট্র। সফররত মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু বিভিন্ন বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের এ বার্তাই পৌঁছে দিয়েছেন। লু বলেছেন, বাংলাদেশে আমি এসেছি আস্থা ও বিশ্বাস পুনর্নির্মাণ করতে। অস্বস্তি দূর করে আমরা এখন সামনে তাকাতে চাই, পেছনে নয়। গতকাল সফরের দ্বিতীয় দিনে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ ও পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন। আজ সকালে ঢাকা ত্যাগ করেছেন যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর দায়িত্বে থাকা ডোনাল্ড লু। নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠনের পর আলোচিত এ কর্মকর্তার এটাই ছিল প্রথম বাংলাদেশ সফর। ডোনাল্ড লু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলন করেন। উপস্থিত সবার উদ্দেশে সালাম-শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে লু বলেন, আমি দুই দিন ধরে ঢাকায় আছি দুই দেশের জনগণের মধ্যে নতুন করে আস্থা-বিশ্বাসের জায়গা তৈরি করার জন্য। এখানে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং অহিংস নির্বাচন নিশ্চিতে গত বছর জুড়ে যুক্তরাষ্ট্র অনেক পরিশ্রম করেছে; যা আমাদের সম্পর্কে কিছুটা উত্তেজনা তৈরি করেছিল। যদিও এটি আমাদের সম্পর্কে খুবই সাধারণ বিষয়। কিন্তু এখন আমরা সামনে এগিয়ে যেতে চাই, মোটেও পেছনে ফিরতে চাই না। আমরা আমাদের সম্পর্ক দৃঢ় করার উপায় খুঁজে বের করতে চাই। দুই দেশের মধ্যে এখনো অনেক অস্বস্তিকর ইস্যু রয়েছে জানিয়ে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা, শ্রম অধিকার, মানবাধিকার, ব্যবসায়িক পরিবেশের সংস্কারসহ আরও অনেক ইস্যু রয়েছে, যা নিয়ে আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্যদের সঙ্গে কথা বলেছি। এ হার্ড ইস্যুগুলো নিয়ে আমাদের আলোচনা চলমান থাকবে। পাশাপাশি দুই দেশের সম্পর্কের ইতিবাচক অনেক বিষয় রয়েছে। যেখানে আমাদের পরস্পরের সহযোগিতা দরকার।
ডোনাল্ড লু বলেন, আমরা নতুন বিনিয়োগের কথা বলেছি। অধিকসংখ্যক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করবে, এটা নিয়ে আলোচনা করেছি। ক্লিন এনার্জি নিয়ে কথা বলেছি। সর্বশেষ যে বিষয়টি নিয়ে আমি মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি, সেটা হলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হবে। আমরা যেটা করতে পারি সরকারের স্বচ্ছতা, সরকারি কর্মকর্তাদের জবাবদিহির মাধ্যমে। আমরা করসীমা বাড়ানোর কথা বলেছি, যাতে বাংলাদেশ সেখান থেকে উপকৃত হতে পারে। পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, আমাদের দেশে ২৫ লাখ লোক কর দেয় কিন্তু এখানে কয়েক কোটি লোকের কর দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে। করব্যবস্থা আধুনিক করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা করতে চায় এবং একই সঙ্গে করফাঁকি বন্ধে সহায়তা করতে চায়। তিনি বলেন, ২০২৬ সালে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ এবং আমরা এখন যে সুবিধা পাই, তা আর থাকবে না। এ বিষয়ে বাংলাদেশের যাত্রা যেন সমৃদ্ধ হয়, তার জন্য সহায়তা চেয়েছি। আমরা আগে যে জিএসপি সুবিধা পেতাম এখন কিন্তু তা পাই না। সেটি তারাও ফিরিয়ে দিতে চায় এবং তারা প্রোগ্রাম যখন আবার শুরু করবে তখন এটি বাংলাদেশ পাবে। তবে এজন্য আমাদের শ্রমনীতি পুনঃপর্যালোচনা করতে হবে এবং এটি আমরা করছি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো এবং আর্থিক খাত শক্তিশালী করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ডেভেলপমেন্ট ফিন্যান্স করপোরেশন থেকে বাংলাদেশকে অর্থায়ন করতে চায়।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতে চায় জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও গভীর ও বিস্তৃত করার লক্ষ্যে আলোচনা হয়েছে। বহুমাত্রিক সম্পর্ক রয়েছে এবং বাংলাদেশের অভিযাত্রায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা রয়েছে। তারা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতে চায়। আমরাও তা চাই। নির্বাচন বা মানবাধিকার নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি জানিয়ে হাছান মাহমুদ বলেন, আমরা সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ইতিবাচক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছি। অতীতে কী ঘটেছে, তা আমরা দেখতে চাই না। আমরা ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে চাই। এর আগে সকালে ডোনাল্ড লুর নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল সচিবালয়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক করে। বৈঠক থেকে বেরিয়ে ডোনাল্ড লু বলেন, আমাদের চমৎকার আলোচনা হয়েছে। পরিবেশ সুরক্ষায় আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় কীভাবে একসঙ্গে কাজ করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করেছি। ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে একসঙ্গে কাজ করার কথাও জানান লু।

পরে সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বিনামূল্যে রিয়াল টাইম স্যাটেলাইট ডেটা অফার করার পরিকল্পনা করেছে। এর মাধ্যমে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, দূষণ এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মতো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো পর্যবেক্ষণ করা যাবে। বাংলাদেশ প্রযুক্তি হস্তান্তর, সক্ষমতা বৃদ্ধি, স্মার্ট এগ্রিকালচার এবং সবুজ ও জলবায়ু প্রযুক্তির অগ্রগতি অর্থায়নে সহায়তা প্রত্যাশা করছে। এজন্য একটি দ্বিপক্ষীয় ওয়ার্কিং গ্রুপ প্রতিষ্ঠিত হবে। পরিবেশমন্ত্রী বলেন, আলোচনায় পরিবেশগত ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতে সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টার গুরুত্বের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে। পরিবেশমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের আগে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন ডোনাল্ড লু। দুপুরে ঢাকায় গুলশানের ইএমকে সেন্টারে ডোনাল্ড লু ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও ইস্টার্ন ব্যাংকের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এ অনুষ্ঠানে বলা হয় : বাংলাদেশে কর্মরত বিভিন্ন করপোরেশন, ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি, এনজিও এবং জলবায়ু কর্মী যারা জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন প্রকল্প এবং বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়নে শ্রেষ্ঠত্ব ও নেতৃত্ব দেখিয়েছেন, তাদের কাজের স্বীকৃতি ও উদ্যাপনের লক্ষ্যে প্রতি বছর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাডাপটেশন অ্যাওয়ার্ড পুরস্কার দেওয়া হবে। অনুষ্ঠানে ডোনাল্ড লু বলেন, আমরা ইবিএলের এ গুরুত্বপূর্ণ নতুন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাডাপটেশন অ্যাওয়ার্ডে সহযোগিতা করতে উন্মুখ। বিকালে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বসুন্ধরা স্পোর্টস কমপ্লেক্স অনুষ্ঠানে যোগ দেন ডোনাল্ড লু। ভারত ও শ্রীলঙ্কা সফর শেষে গত বুধবার দুপুরে ঢাকায় আসা মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু প্রথম দিনে গুলশানে রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বাসায় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মানবাধিকার, শ্রম অধিকার ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করেন তিনি। রাতে ভোজে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বৈঠকে বিভিন্ন ইস্যুর পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে মার্কিন কোম্পানিগুলোর লভ্যাংশ নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করেন লু। ডলার সংকটের কারণে আপাতত এ লভ্যাংশ নিতে পারছে না মার্কিন কোম্পানিগুলো। দক্ষিণ এশিয়া সফর শেষ করে আজ সকালে ওয়াশিংটনের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করবেন ডোনাল্ড লু।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *