ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিলাসী জীবন নিষিদ্ধ
ডেস্ক রিপোর্ট: ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমাতে এবং আদায় বাড়াতে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর অংশ হিসাবে প্রথমেই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের কঠোরভাবে শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করার আইনি প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। যারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসাবে চিহ্নিত হবেন, তারা বিমান ভ্রমণ, ট্রেড লাইসেন্স, কোনো কোম্পানির নিবন্ধন এবং শেয়ার ছাড়ার অনুমোদনও পাবেন না। একই সঙ্গে বাড়ি, গাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট কিনে নিবন্ধন করতে পারবেন না। অর্থাৎ কোনো সম্পদ বা কোম্পানি করে নতুন ব্যবসা করতে পারবেন না। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে ঋণ আদায়ে অর্থঋণ আদালতে মামলার পাশাপাশি ফৌজদারি অপরাধে মামলাও চলবে। কোনো ব্যাংক বিধি ভঙ্গ করে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের ছাড় দিলে তাদের বিরুদ্ধে মোটা অঙ্কের জরিমানাসহ কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটি সার্কুলার জারি করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণের তথ্য অনুযায়ী ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি চিহ্নিতকরণের কাজ ১ জুলাই থেকে বাস্তবায়ন শুরু করতে হবে। ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে, এর আলোকে এ নির্দেশনা জারি হলো। সংশ্লিষ্টদের অনেকে মনে করেন, ইচ্ছাকৃত খেলাপির আওতায় কেবল ছোট বা দুর্বল ঋণখেলাপিরা আটকা পড়বেন। বিপরীতে প্রভাবশালী খেলাপিদের বেরিয়ে যাওয়ার ফাঁকফোকর রাখা আছে। কারণ, ইচ্ছাকৃত খেলাপি নির্ধারণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে ব্যাংকের হাতে। এর ফলে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীসহ সমাজের বিগশর্টদের অনেকে ছাড় পেয়ে যাওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, প্রভাবশালীদের জোর তদবিরের মুখে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থায় অনেক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কঠোর হওয়া কঠিন হবে। এজন্য ব্যাংক চাইলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ পুনর্গঠন বা নবায়ন করে ছাড় দিতে পারবে। মূলত এ সুযোগ বন্ধ করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে সার্কুলারের মধ্যে এ বিষয়টি স্পষ্ট করে বলে দিতে হতো। মোদ্দা কথা, ইচ্ছাকৃত খেলাপির সংজ্ঞায় যিনি বা যে প্রতিষ্ঠান পড়তে যাচ্ছেন তাকে নতুন ঋণ দিয়ে কিংবা ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া যাবে না। সম্ভাব্য ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বাঁচাতে ব্যাংক বড় ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী গ্রাহকদের খেলাপি ঋণ বিশেষ ব্যবস্থায় নবায়ন বা নতুন ঋণ দিয়ে নবায়ন করার সুযোগ করে দিতে পারে। এতে খেলাপি ঋণ আদায় বাধাগ্রস্ত হবে। তবু ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের শনাক্ত করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা ইতিবাচক। ব্যাংক বড়দের ছাড় না দিলে তারাও এর আওতায় পড়বেন।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে বলা হয়েছে, এখন থেকে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসাবে চিহ্নিত হলে তিনি বা ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা বিমান ভ্রমণ করতে পারবেন না। তারা নিজ নামে সিটি করপোরেশন থেকে কোনো ট্রেড লাইসেন্স নিতে পারবেন না। রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক অ্যান্ড কোম্পানিজ ফার্মস থেকে কোনো কোম্পানির নিবন্ধন পাবেন না। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন থেকেও কোনো কোম্পানির শেয়ার ছাড়া বা বন্ড ইস্যুর অনুমোদন পাবেন না। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের তালিকা চূড়ান্ত করার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওইসব তালিকা সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলোয় পাঠাবে। আইন অনুযায়ী ওইসব দপ্তর ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের সংশ্লিষ্ট সেবাদানে বিরত থাকবে।
এতে আরও বলা হয়, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির তালিকা বাংলাদেশ ব্যাংক গাড়ি, বাড়ি, ফ্ল্যাট, জমি ইত্যাদি নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। অর্থাৎ প্রচলিত আইন অনুযায়ী ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা গাড়ি, বাড়ি, জমি বা ফ্ল্যাটের নিবন্ধন করতে পারবেন না। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা কোনো রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বা সম্মাননা পাবেন না। কোনো ইচ্ছাকৃত খেলাপি তার সমুদয় ঋণ পরিশোধ করার পর ৫ বছর অতিক্রম না হওয়া পর্যন্ত তিনি কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে পারবেন না। কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসাবে গণ্য হলে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রচলিত আইন মেনে তার পরিচালক পদ শূন্য ঘোষণা করতে পারবে বা তাকে অপসারণ করতে পারবে। সার্কুলারে আরও বলা হয়, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার পর ওই তালিকার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আপিল না করলে বা তার করা আপিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে গৃহীত না হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক গ্রাহকের কাছে সমুদয় পাওনা ফেরত চেয়ে ২ মাসের নোটিশ দিতে পারবে। নোটিশ প্রদানের দুই মাসের মধ্যে পাওনা পরিশোধে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক পর্ষদের অনুমোদন সাপেক্ষে ওই গ্রহীতার বিরুদ্ধে আদালতে ফৌজদারি মামলা করতে পারবে। এ মামলা করা হলেও ঋণ আদায়ের জন্য অর্থঋণ আদালতে দায়ের করা মামলার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে না, চলমান থাকবে।
ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির তালিকা প্রতি ত্রৈমাসিকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের অডিট কমিটির সভায় উপস্থাপন করতে হবে। কমিটি এতে মতামত বা সিদ্ধান্তসহ পর্ষদে উপস্থাপন করবে। ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কার্যক্রমে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে হবে। একটি টীকা আকারে তা প্রতিবেদনে প্রকাশ করতে হবে।
এতে আরও বলা হয়েছে, ঋণখেলাপিদের সুদ মওকুফ করার সুযোগ থাকলেও ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের কোনো ঋণ বা এর সুদ মওকুফ করা যাবে না। কোনো ইচ্ছাকৃত খেলাপির ঋণ হিসাব অন্য কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কিনতে পারবে না। এই ঋণ সম্পূর্ণ আদায় না হওয়া পর্যন্ত তিনি বা ওই প্রতিষ্ঠান ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসাবে চিহ্নিত হবেন। সার্কুলারে বলা হয়, কোনো ব্যাংক ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি সংক্রান্ত নির্দেশনা লঙ্ঘন করলে বা ইচ্ছাকৃতভাবে লঙ্ঘন করেছে মর্মে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বিবেচিত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা এবং অনধিক ১ কোটি টাকা জরিমানা করা হবে। এরপরও লঙ্ঘন অব্যাহত পরবর্তী প্রতিদিনের জন্য অতিরিক্ত হিসাবে কমপক্ষে ১ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হবে। এত বলা হয়, ব্যাংক কর্তৃক ইচ্ছাকৃত খেলাপি শনাক্ত ও চূড়ান্তকরণের পর এ সংক্রান্ত তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোতে (সিআইবি) পাঠাতে হবে। ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতাকে সিআইবিতে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা হবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির তথ্য ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাতে হবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সংজ্ঞা হিসাবে সার্কুলারে বলা হয়েছে, নিজের, তার পরিবারের সদস্যের, স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির অনুকূলে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে গৃহীত ঋণ, অগ্রিম, বিনিয়োগ বা অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা বা এর অংশ বা এর ওপর আরোপিত সুদ বা মুনাফা তার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও পরিশোধ করা না হলে তিনি ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত হবেন।
একই সঙ্গে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে জালিয়াতি, প্রতারণা বা মিথ্যা তথ্য দেওয়ার মাধ্যমে নিজের, তার পরিবারের সদস্যের, স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির নামে ঋণ, অগ্রিম, বিনিয়োগ বা অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করে থাকলেও তিনি ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত হবেন।
কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে যে উদ্দেশ্যে ঋণ, অগ্রিম, বিনিয়োগ বা অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেছিলেন, সে উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ওই ঋণ, অগ্রিম, বিনিয়োগ বা আর্থিক সুবিধা বা এর অংশ ব্যবহার করে খেলাপি হলে তিনিও ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসাবে গণ্য হবেন। ঋণ বা অগ্রিমের বিপরীতে প্রদত্ত জামানত ঋণ বা অগ্রিম প্রদানকারী কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লিখিত পূর্বানুমতি ব্যতীত হস্তান্তর বা স্থানান্তর করে থাকলেও ইচ্ছাকৃত খেলাপি হবেন।
ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা শনাক্তকরণসহ এসব যাবতীয় কার্যক্রম স¤পাদনের জন্য ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পরবর্তী দুই ধাপ নিচের কর্মকর্তার অধীনে প্রধান কার্যালয়ে ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা শনাক্তকরণ ইউনিট’ নামে একটি পৃথক ইউনিট ৯ এপ্রিলের মধ্যে গঠন করতে হবে।
আইন অনুযায়ী ব্যাংক তাদের কোনো খেলাপি ঋণগ্রহীতা ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কো¤পানি ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা কি না, তা শনাক্ত করবে। কোনো ঋণগ্রহীতা খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার তৎপরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে ওই ঋণগ্রহীতা ইচ্ছাকৃত খেলাপি কি না, তা নিরূপণের লক্ষ্যে বিবেচ্য বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট ইউনিট পর্যালোচনা করে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি শনাক্ত করবে। ইচ্ছাকৃত খেলাপি শনাক্তকৃত হলে শনাক্তকরণের আগে গ্রাহকের বক্তব্য নিতে হবে। নির্ধারিত সময়ে গ্রাহক বক্তব্য দিতে ব্যর্থ হলে বা গ্রাহকের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য না হলে তিনি ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত হবেন। তবে শিল্পনীতিতে সংজ্ঞানুযায়ী ‘বৃহৎ শিল্প’ খাতের ৭৫ কোটি ও তদূর্ধ্ব, ‘মাঝারি শিল্প’ খাতের ৩০ কোটি ও তদূর্ধ্ব এবং অন্যান্য খাতের ১০ কোটি ও তদূর্ধ্ব স্থিতিস¤পন্ন ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির বা পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে স্থানীয় সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের বা ব্যবস্থাপনা কমিটির অনুমোদন গ্রহণ করতে হবে। ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসাবে কোনো গ্রাহককে চিহ্নিত করা হলে ৭ কর্মদিবসের মধ্যে লিখিতভাবে গ্রাহককে অবহিত করতে হবে।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা। অবলোপন করা হয়েছে ৫২ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া বিশেষ হিসাব মিলিয়ে খেলাপি ঋণ ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি। খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংক খাত দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ কারণে খেলাপি ঋণ আদায়ে জোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।