বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ শিক্ষক শিক্ষিকাদের জাতীয়করণ খুবই দরকার
ডেস্ক রিপোর্ট : বিগত ১১ জুলাই থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের এক দফা দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি পালন করে আসছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা শত-সহস্র শিক্ষক। শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান সরকারি-বেসরকারি বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে তাদের এই অবস্থান। কারিকুলাম, সিলেবাস, একাডেমিক সময়সূচি, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন এবং উত্তরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি কোনো পার্থক্য না থাকলেও আর্থিক সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে পাহাড়সম বৈষম্য। সরকারি একজন শিক্ষক বাড়িভাড়া পান মূল বেতনের ৪০-৪৫ শতাংশ আর বেসরকারি শিক্ষক পান মাত্র ১ হাজার টাকা। উত্সব ভাতা সরকারি শিক্ষক পান মূল বেতনের ১০০ ভাগ, বেসরকারি শিক্ষক পান মাত্র ২৫ ভাগ। আছে পদোন্নতির জট-জটিলতা। বর্তমানে অ্যান্ট্রি পদে নিয়োগের ক্ষমতা সরকার গ্রহণ করেছেন; কিন্তু প্রতিষ্ঠান প্রধান কিংবা সহপ্রতিষ্ঠান প্রধান পদে নিয়োগের ক্ষমতা ম্যানেজিং কমিটি আর গভর্নিং বডির হাতে থাকায় ব্যতিক্রম বাদে ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা খরচ না করে কেউ নিয়োগ পান না।
শিক্ষক আন্দোলনের ৯ম দিনে অর্থাত্ ১৯ জুলাই শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে জাতীয়করণ বিষয় বৈঠক করেন শিক্ষকরা। বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী জানান, জাতীয় নির্বাচনের আগে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ সম্ভব নয়। বৈশ্বিক এই অবস্থার মধ্যে আর্থিক বিরাট বোঝা কাঁধে নেওয়া কোনো সরকারের পক্ষেই সম্ভব নয়। বিপরীতে শিক্ষকরা বলেন, প্রতিষ্ঠানের ফান্ড ও শিক্ষার্থীদের বেতন সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে খুব সহজেই জাতীয়করণ করা সম্ভব। তবে কেন এই ‘আর্থিক বিরাট বোঝা’ তা নিয়ে কিছু বলা সমীচীন নহে বলে মনে করছি। কারণ সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩০ হাজার ৫৪০টি আর কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা ৫ লাখ ৬২ হাজার ৬৬৩ জন। এই সংখ্যা অর্ধেকে সীমাবদ্ধ না রাখতে পারলেও ‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জনবলকাঠামো ও এমপিও নীতিমালা’ প্রণয়নে দূরদর্শিতা থাকলে এই সংখ্যা দুই-তৃতীয়াংশ রাখা সম্ভব ছিল। কোনো কোনো এলাকায় যত নেতা তত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বরিশাল জেলার একটি উপজেলায় এমপিওভুক্ত কলেজের সংখ্যা ১৮টি। অন্য একটি উপজেলায় পুরোনো কলেজটি সরকারিকরণের পরপর স্থাপন করা হয়েছে এক কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে দুটি মহিলা কলেজ। গোড়া থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিষ্ঠানের দূরত্ব, ন্যূনতম জনসংখ্যা এবং কাম্য শিক্ষার্থীর সংখ্যাকে। সর্বশেষ এমপিও নীতিমালা-২০২১ অনুযায়ী বেতন-ভাতার সরকারি অংশ প্রাপ্তির জন্য কলেজে কাম্য শিক্ষার্থীর সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে দুটি বিভাগে দুটি বর্ষে ১৬০ জন। বিপরীতে বোর্ডের আসনসংখ্যা দুটি বিভাগে দুটি বর্ষে ৬০০টি। অর্থাত্ যে খরচে ৬০০ জন শিক্ষার্থীকে পড়ানো যেত, সেই খরচে ১৬০ জনকে পড়ানোর ব্যবস্থা এমপিও নীতিমালায় রয়েছে।
একদিকে শিক্ষকরা বলেন, প্রতিষ্ঠানের ফান্ড ও শিক্ষার্থীদের বেতন সরকার নিয়ে যদি শিক্ষা জাতীয়করণ করা হয়, তাহলে সরকারকে কোনো বাড়তি আর্থিক চাপ সহ্য করতে হবে না। অন্যদিকে শিক্ষামন্ত্রীও বলেন, সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের আয় থেকে কোনো অর্থ নেয় না। প্রশ্ন জাগে, শিক্ষকরা কেন প্রতিষ্ঠানের আয় সরকারকে দিতে চান? তারা কেন প্রতিষ্ঠানের আয় সরকারের মাধ্যমে নিতে চান? কারণ একটাই, হাতেগোনা ব্যতিক্রম বাদে প্রতিষ্ঠানের আয় তাদের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে যারা আছেন তারা লুটপাট করেন। এজন্য শিক্ষকরা জাতীয়করণের মাধ্যমে প্রকারান্তরে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের বদল চান এবং এমপিও প্রথা থেকে বেরিয়ে আসতে চান। এসব বিষয়ে একাধিক প্রতিবেদন ও সংবাদ বিভিন্ন তারিখে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। একাধিক সম্পাদকীয়ও লেখা হয়েছে। ২৮ জুলাই ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দ তারিখে ‘এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটির মূল দায়িত্ব কী’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে এই একই কথা উঠে এসেছে। সম্পাদকীয়র ভেতরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক ও আর্থিক অনিয়ম তদন্তকারী সংস্থা পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) মতামত তুলে ধরা হয়েছে। তারা স্বীকার করেছেন, একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৯৫ ভাগ অনিয়মই ম্যানেজিং কমিটির কারণে হয়ে থাকে। সম্পাদকীয়তে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এভাবে প্রশ্ন করা হয়েছে—‘শিক্ষার প্রকৃত উন্নয়নে সরকার কি তাহা হইলে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেই জাতীয়করণ করিতে পারে না?’
শিক্ষা জাতীয়করণের এই আন্দোলন মোটা দাগে আর্থিক বৈষম্য দূরীকরণের কথা বলা হলেও সমাজে তাদের মর্যাদাপূর্ণ বসবাসের বিষয়টিও জড়িত। একই সমাজে বসবাস করে কেউ সরকারি আর কেউ বেসরকারি, যা তাদের মানসিকভাবে সুস্থ থাকার অন্তরায়। বিশেষ করে ২৬ হাজার রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং প্রতিটি উপজেলায় একটি কলেজ ও একটি স্কুল জাতীয়করণের ফলে তাদের পেশাগত জীবনে একধরনের ভারসাম্যহীনতা লক্ষ করা যাচ্ছে। পাঁচ-সাত বছর আগে যে সহকর্মীর সঙ্গে এক টেবিলে বসে গল্প করতেন, চা-পান করতেন সেই সহকর্মী আজ সরকারি আর তিনি বেসরকারি। তাই সার্বিক বিবেচনায় বেসরকারি শিক্ষা ও শিক্ষকদের জাতীয়করণ করা সমীচীন বলে মনে করছি। আমার দৃঢ়বিশ্বাস দেশনেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ শিক্ষক শিক্ষিকাদের জাতীয়করণের ঘোষণা দিলে জাতির কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।