আমান উল্লাহর ১৩ বছর ও ইকবাল হাসানের ৯ বছরের কারাদণ্ড বহাল
বিশেষ প্রতিনিধি: নিম্ন আদালতের দেওয়া সাজা হাইকোর্টে বহাল থাকায় বিএনপি নেতা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও আমান উল্লাহ আমান নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্যই রইলেন। সাজার কারণে ২০০৮ এবং ২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনে তাঁদের প্রার্থিতা বাতিল হয়েছিল। এখন আপিল বিভাগে সাজা স্থগিত বা খালাস না পেলে তাঁরা আগামী নির্বাচনেও অংশ নিতে পারবেন না। গত মঙ্গলবার দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমানের ১৩ বছর ও তাঁর স্ত্রী সাবেরা আমানের তিন বছরের কারাদণ্ড বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি দুদকের অপর এক মামলায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর ৯ বছরের কারাদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে।
বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াত সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ তিন আসামির করা পৃথক আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে এ রায় দেন। বিচারিক আদালতে এ রায় পৌঁছানোর দুই সপ্তাহের মধ্যে তাঁদের আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে। রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেন, রাজনীতিবিদ রক্ষক; ভক্ষক হতে পারেন না। অর্থ উপার্জনের জন্য রাজনীতি কোনো পেশার আওতায় আসতে পারে না। দুর্নীতির মামলায় সাজা বহাল থাকায় সংবিধানের ৬৬(২ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তাঁদের ভোটে অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই। এতে বলা হয়েছে, নৈতিক স্খলনের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ন্যূনতম দুই বছর কারাবাস থেকে মুক্তির পর পাঁচ বছর পার না হলে কেউ নির্বাচনে যোগ্য হবেন না। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে বলে জানিয়েছেন দণ্ডিতদের আইনজীবীরা। হাইকোর্টে আমান দম্পতির পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন ও আইনজীবী নাজমুল হুদা এবং ইকবাল হাসানের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আজমালুল হোসেন ও আইনজীবী মো. সাইফুল্লাহ মামুন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক এবং দুদকের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ খুরশীদ আলম খান ও টাইতাস হিল্লোল। জরুরি অবস্থার মধ্যে ২০০৭ সালের ৬ মার্চ আমান ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে রাজধানীর কাফরুল থানায় এ মামলা করে দুদক। মামলার অভিযোগে বলা হয়, ১৯৯২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আমান দম্পতি ৯ কোটি ৯৪ লাখ ৬৩ হাজার টাকার সম্পত্তি অবৈধভাবে অর্জন করেন। ২০০৭ সালের ২১ মার্চ সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর বিরুদ্ধে দুদকের উপপরিচালক গোলাম শাহরিয়ার চৌধুরী মোহাম্মদপুর থানায় অপর মামলাটি করেন। তাঁর বিরুদ্ধে ৪ কোটি ৯৬ লাখ ১১ হাজার ৯১৬ টাকার অবৈধ সম্পত্তি অর্জন এবং সম্পদের তথ্য গোপন করার অভিযোগ আনা হয়। ২০০৭ সালের ২১ জুন বিশেষ জজ আদালত আমানকে ১৩ বছর ও সাবেরাকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেন। একই বছরের ১৫ নভেম্বর এক রায়ে টুকুকে ৯ বছরের কারাদণ্ড দেন বিশেষ জজ আদালত। পরে দণ্ডিতরা হাইকোর্টে আপিল করেন। ২০১০ সালের ১৬ আগস্ট হাইকোর্ট আমান দম্পতির আপিল মঞ্জুর করে তাঁদের খালাস দেন। দুদক হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে ২০১৪ সালের ২৬ মে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বাতিল করেন। পাশাপাশি হাইকোর্টকে ফের আপিল শুনানির নির্দেশ দেওয়া হয়। গত ১৪ মে আপিলের পুনঃশুনানি শেষে রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন হাইকোর্ট। অন্যদিকে বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে টুকু আপিল করলে ২০১১ সালের ১৫ জুন তাঁকে খালাস দেন হাইকোর্ট। কিন্তু এখানেও দুদক ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে ২০১৪ সালের ২১ জানুয়ারি খালাসের রায় বাতিল করে হাইকোর্টে পুনঃশুনানির আদেশ দেন আপিল বিভাগ। ওই রায় পুনর্বিবেচনারও আবেদন করেন টুকু। সর্বোচ্চ আদালত তা খারিজ করে দিলে ফের শুনানির আদেশ বহাল থাকে।
হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ
রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেন, রাজনীতিবিদরা জনগণ ও দেশের কল্যাণে নিজেদের উৎসর্গ করার লক্ষ্যে রাজনীতিতে জড়িত হন এবং রাজনীতি জনগণ ও দেশের কল্যাণে এক ধরনের মহান ত্যাগ-নিষ্ঠার কাজ। তাই রাজনীতিবিদরা জনগণের সম্পদের রক্ষক হবেন। তাঁরা ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন না। বৈধ ব্যবসা এবং অন্যান্য পেশার আশ্রয় নিয়ে অর্থ-সম্পত্তি অর্জনের অনেক উপায় রয়েছে। তবে অর্থ উপার্জনের জন্য রাজনীতি কোনো পেশার আওতায় আসতে পারে না। এতে আরও বলা হয়, দুর্নীতি সব লিঙ্গ, বয়স এবং বর্ণের মানুষকে প্রভাবিত করে। এটি দরিদ্র ও দুর্বল গোষ্ঠীকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করে। দুর্নীতিবাজরা তাদের সমালোচকদের চুপ করতে এবং চুরি করা সম্পদ লুকানোর জন্য একে অপরকে সাহায্য করে। তাদের বিরুদ্ধে একসঙ্গে কাজ করার সময় এসেছে।
নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে আইনজ্ঞদের প্রতিক্রিয়া
সাজার কারণে ২০০৮ সালের নির্বাচনে সিরাজগঞ্জ-২ আসনে প্রার্থী হতে পারেননি টুকু। তাঁর স্ত্রী রোমানা মাহমুদ এই নির্বাচনে এমপি হন। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও টুকুর প্রার্থিতা বাতিল হলে রোমানা মাহমুদ প্রার্থী হন। সাজার কারণে আমানও ২০০৮ সালে ঢাকা-২ আসনে প্রার্থী হতে পারেননি। ২০১৮ সালে তাঁর প্রার্থিতাও বাতিল হয়। তাঁর ছেলে ইরফান ইবনে আমান বিএনপির প্রার্থী হয়েছিলেন একাদশ সংসদ নির্বাচনে। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ সমকালকে বলেন, সাজা বহাল থাকায় বিএনপির এ দুই নেতার আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ নেই; যদি না হাইকোর্টের রায় আপিল বিভাগ স্থগিত করেন। এখানে অনেক যদি আছে। বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্?দীন মালিক বলেন, হাইকোর্টে সাজা বহাল থাকলেও আপিলের সুযোগ আছে। দুর্নীতির মামলায় হাজী সেলিমের সাজা হাইকোর্টে বহাল থাকলেও তিনি এমপি পদে বহাল আছেন। কারণ তাঁর সাজা আপিল বিভাগ স্থগিত করেছেন। তাই আপিল বিভাগই পরবর্তী সিদ্ধান্ত দেবেন। দুদক আইনজীবী মোহাম্মদ খুরশীদ আলম খান বলেন, বর্তমান আইনি প্রেক্ষাপটে দণ্ডিতরা নির্বাচন করতে পারছেন না। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে পরে দেখা যাবে। অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, দণ্ডিত তিন আসামিরই বর্তমান আইনি পরিস্থিতিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ নেই।