আজও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেন না
ভাষা সৈনিক মরহুম দবিরুল ইসলাম
জসীমউদ্দীন ইতি ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি ; বেশ কয়েকবার মরহুম এ্যাডভোকেট মুহাম্মদ দবিরুল ইসলাম সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে নিজেই লিখে গেছেন। কিন্তু তার পরেও ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পেড়িয়ে গেলেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়ায় স্বামীকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সরকারকের কাছে আবেদন জানিয়েনেছেন মরহুম দবিরুলের স্ত্রী আবেদা খাতুন ওরফে হেনা (৮৫) সহ তার পরিবার।
১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের এক সাহসী নাম দবিরুল ইসলাম। ৫২’র ভাষা আন্দোলনে যার ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূচনা পর্বে যে ক’জন সাহসী সূর্য সন্তান তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল দবিরুল ইসলাম ছিলেন সেই সাহসী ও স্বপ্ন সারথিদের অন্যতম একজন। ঠাকুরগাঁও জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে বালিয়াডাঙ্গি উপজেলার পাড়িয়া ইউনিয়নের বামুনিয়া গ্রামে ঘুমিয়ে আছেন এই ভাষা সৈনিক।
একটি সময় যার ভূমিকা ছিলো অনেক আজ তিনি শুধুই ইতিহাস। জাতি ভুলতে বসেছে তার অবদানের কথা। নতুন প্রজন্মের অনেকে তার সম্পর্কে এখনো কিছুই জানেন না। তবে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ঠাকুরগাঁও শহরের কালিবাড়ি সাধারণ পাঠাগার চত্বরে তার একটি স্মৃতিস্তম্ভ করা হয়েছিল। সেটি কিছুদিন আগে সংস্কার করলেও এখন অযতেœ ও অবহেলায় পড়ে আছে। তার স্মৃতিসৌধের আশেপাশে জমে আছে ময়লার স্তুপ।
রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির অভাবে ইতিহাসের স্মৃতি থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছেন ভাষা সৈনিক দবিরুল ইসলাম। ভাষা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী ত্যাগী এই সৈনিকের অবদান নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে স্বীকৃতির পাশাপাশি পাঠ্য বইয়ে তার জীবন-দর্শন অন্তর্ভূক্ত করার দাবি তার পরিবার ও এলাকাবাসীর।
ভাষা সৈনিক দবিরুল ইসলামের ইতিহাস-
“রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” আন্দোলন,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের নায্য আন্দোলন,পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন, যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন এসবের পিছনে অসামান্য অবদান রেখেছেন তিনি। যাদের নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন সেদিন বেগবান হয়েছিল ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি(১৯৪৯-১৯৫৩)ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন আইন বিভাগের ছাত্র,সাবেক এমএলএ, পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি (যুক্তফ্রন্ট) ও ভাষা সৈনিক মরহুম এ্যাডভোকেট মুহাম্মদ দবিরুল ইসলাম তাদেরই একজন। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে আইয়ুব সরকারের নির্যাতনের শিকার হন তিনি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ৫২’র ভাষা আন্দোলনের সময় বর্তমান ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার পাড়িয়া ইউনিয়নের বামুনিয়া গ্রামের বাড়ি থেকে তাকে গ্রেফতার করে দিনাজপুর জেলা কারাগারে নিয়ে তার ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়। জেল থেকে বেরিয়ে ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়ী হন তিনি। কিন্তু কারাগারে নির্যাতনের কারণে তার স্বাস্থ্য চরমভাবে নষ্ট হয়। যার ফলে তিনি হৃদরোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরবর্তীকালে ১৯৬১ সালের ১৩ জানুয়ারিতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
এছাড়াও তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর,একসাথে রাজনীতি করতেন এবং একসাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনবিভাগে পড়াশোনা করার সময় ছাত্র রাজনীতি করার জন্য বহিষ্কৃত হোন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এই দবিরুল ইসলাম সম্পর্কে ৮৮, ১১০, ১১৩-১৪ ও ১২৬ পৃষ্ঠায় অনেক কিছুই লিখেছেন।
মরহুম এ্যাডভোকেট মুহাম্মদ দবিরুল ইসলামের স্ত্রী আবেদা খাতুন (হেনা) দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ও কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন,বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার স্বামীর অসম্ভব ভালো সম্পর্ক ছিল। আমি তা নিজেই দেখেছি। বিয়ের ১০ বছরের মাথায় স্বামীকে হাড়িয়ে কোলের শিশুদের নিয়ে কিযে করুন ও নিদারুন দিন পার করেছি! এতো আন্দোলন সংগ্রাম করেও এখনো ভাষা সৈনিক হিসেবে কোন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেল না। মরার আগে যদি তার স্বীকৃতি দেখে যেতে পারতাম তাহলে মরেও শান্তি পেতাম।
মরহুম এ্যাডভোকেট মুহাম্মদ দবিরুল ইসলামের ছোট ছেলে দবিরুল ইসলাম-আহসান উল্লাহ(ফিলিপ) জানান,আমার বাবাকে বঙ্গবন্ধু কতটা ভালোবাসতেন তা তিঁনি তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখে গেছেন। আমার বাবা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী,রাজনৈতিক কর্মী,সহপাঠি হয়েও আজ পর্যন্ত কোন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেন না। তাই সরকারের কাছে আমার মা ও আমাদের পরিবারের সকলের দাবি আমরা যেন আমার বাবার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেখে যেতে পারি।
ঠাকুরগাঁও জেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুর রহমান বাবলু বলেন, ঠাকুরগাঁওয়ে এসে বঙ্গবন্ধু নিজেই মরহুম এ্যাডভোকেট মুহাম্মদ দবিরুল ইসলাম কথা বলেছেন যে তিনি ভাষা সৈনিক ও ছাত্রলীগের প্রথম সভাপতি ছিলেন। ওই দিন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,উনি আমার বন্ধু মানুষ,উনি যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে আমার মতোই বড় নেতা হতেন। আমি ঘুরে দেখলাম কোথাও তার কোন স্মৃতিস্তম্ভ নেই। আমি নির্দেশ দিলাম ২৪ ঘন্টার মধ্যে দবিরুল ইসলামে স্মৃতিস্থম্ভ আমি দেখতে চাই। তার নির্দেশেই তখন পাবলিক ক্লাব মাঠে ছোট একটি স্মৃতিস্থম্ভ করা হয় দবিরুল ইসলামের। সম্প্রতি যেটাকে সংস্কার করা হয়েছে।
ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমান বলেন,ভাষা সৈনিক দবিরুল ইসলামের প্রতি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিবছরে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। তার একটি স্মৃতিস্তম্ভ আছে সেখানে আমরা পুষ্পস্তবক অর্পন করি। এটি যেন প্রতিবছর করা হয় সেই ধারা আমরা অব্যাহত রাখবো। এছাড়া তিনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি,পাঠ্যপুস্তকে নাম লিপিবদ্ধকরণ ও পাঠাগার স্থাপনের বিষয়ে কোন মতামত প্রকাশ করেননি।