রাষ্ট্রপতি নির্বাচন: অতি উৎসাহের সুযোগ যে কারণে নেই
ডেস্ক রিপোর্ট : পরবর্তী রাষ্ট্রপতি কে হবেন, তার নিষ্পত্তি এমনকি হয়ে যেতে পারে অনলাইনে এ লেখাটি প্রকাশের আগেই। রাষ্ট্রপতি কে হতে পারেন, তা নিয়ে মিডিয়ায় নিত্য আসা-যাওয়া করা জল্পনা ধরেও এ লেখা নয়। রাষ্ট্রপতি তিনিই হবেন- প্রধানমন্ত্রী যাকে মনোনয়ন দেবেন। ব্যাপারটা এমনই। তারপরও এ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের সংসদীয় দলের সভা ডাকা হয়েছে এবং সেখানে ক’জন বক্তব্য রেখে এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন একজন দলীয় রাজনীতিককেই যেন রাষ্ট্রপতি করা হয়। এটুকুই। তারপর রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনয়ন দানের দায়িত্বটি প্রধানমন্ত্রীর ওপর অর্পণ করা হয়েছে।
যাহোক, প্রধানমন্ত্রী যাকে মনোনীত করবেন, তিনিই রাষ্ট্রপতি হয়ে যাবেন। কেননা সংসদে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি বলে দিয়েছে, তারা কোনো প্রার্থী দেবেন না। প্রার্থী দিলেও সেটা অহেতুকই দেওয়া হতো। এখন একটাই বোধহয় দেখার বিষয় রয়েছে যে, দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ করে আসা কাউকে রাষ্ট্রপতি করা হয় কিনা। কেননা এমন খবর অনেকদিন ধরেই মিডিয়ায় এসেছে যে, একজন সাবেক আমলা বা সাবেক প্রধান বিচারপতি কিংবা একজন সাবেক উপাচার্যকেও রাষ্ট্রপতি করা হতে পারে। অগত্যা সে তালিকা থেকেই যদি কাউকে বেছে নেওয়া হয়, তাহলেও দলের ভেতর থেকে কেউ বলবেন না যে, আমরা আশা করেছিলাম জিল্লুর রহমান বা আবদুল হামিদের মতো কাউকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বেছে নেওয়া হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলে অপ্রতিদ্বদ্বী অবস্থানে রয়েছেন। তিনি সব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। তবে একথা বলা যাবে না যে, সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তিনি একাই নিয়ে থাকেন- কারও সঙ্গে কোনোরকম পরামর্শ না করে। রাষ্ট্রপতি মনোনয়নের বিষয়ে তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত কারও না কারও সঙ্গে তিনি নিশ্চয়ই পরামর্শ করে থাকবেন। আর সেটা তো খুবই স্বাভাবিক। ঘোষিত না হলেও ক্ষমতাসীন দলে একটা ‘পলিটব্যুরো’ নিশ্চয়ই রয়েছে।
আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা যেভাবে সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে, তাতে কে পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হতে যাচ্ছেন- এটা নিয়ে এত আলোচনারও আসলে কিছু নেই। নব্বইয়ে গণতন্ত্রের নবযাত্রার পর দেশটি সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার সময় রাষ্ট্রপতির হাতে কিছু ‘অতিরিক্ত ক্ষমতা’ রাখার বিষয়ে কোনো পক্ষ থেকেই কোনোরকম আগ্রহ কিন্তু দেখা যায়নি। প্রধানমন্ত্রীর হাতে ‘রাষ্ট্রপতির মতো ক্ষমতা’ প্রদানের বিষয়েই বরং আগ্রহ দেখতে পাওয়া গিয়েছে। পরেও এ ব্যাপারে ক্ষমতার কোনো পক্ষকে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করতে দেখা যায়নি। যারা রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার একটা ‘গ্রহণযোগ্য ভারসাম্যের’ পক্ষে কথাবার্তা বলেন, তারা ‘সংস্কারপন্থী’ বলে চিহ্নিত। তারাও বলছেন, প্রধানমন্ত্রী যাকে ইচ্ছা রাষ্ট্রপতি বানাবেন; তাতে আমাদের কী? বিএনপিও বলে দিয়েছে, তাদের আগ্রহ ‘অনির্বাচিত’ এ সরকারের পতনে এবং একটি দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে।
তখনও নিয়মমাফিক আবদুল হামিদ পরবর্তী রাষ্ট্রপতিই বঙ্গভবনে থাকবেন। কল্পিত ওই নির্বাচনে জিতে বিএনপি সরকার গঠনে সমর্থ হলেও এ রাষ্ট্রপতিই বহাল থাকবেন পদত্যাগ না করলে। বিএনপি এটা ধরে বসে আছে যে, দলনিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার এসে গেলে তো দলীয়ভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি আর বিশেষ কিছু করতে পারবেন না। রাজনৈতিক সরকারের পদত্যাগ বা পতন ঘটলে দলীয় রাষ্ট্রপতিও কেমন অসহায় হয়ে অন্য পক্ষের এজেন্ডা বাস্তবায়নে সহায়তা করেন, সে অভিজ্ঞতা সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদের মাধ্যমে বিএনপিরও হয়েছে।
ক্ষমতাসীন দলের নেতারা তেমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনার কথা চিন্তা করেন কিনা, সেটা কেবল তারাই বলতে পারেন। তাদের ভেতর থেকে মাঝে মাঝেই অবশ্য বলা হয়ে থাকে, ‘অসাংবিধানিক পথে’ ক্ষমতায় আসার চেষ্টা বা ‘ষড়যন্ত্র’ করছে বিএনপি কিংবা মহলবিশেষ। এটাও দৃঢ়তার সঙ্গে বলা হয় যে, সে সুযোগ আর নেই। তবে দলের মধ্যে আলোচনা আছে যে, তেমন কোনো জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হলে নতুন রাষ্ট্রপতি যাতে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থ রক্ষা করতে পারেন, তেমন কাউকেই রাষ্ট্রপতি বানানো প্রয়োজন। তাকে দেশের বিশিষ্ট নাগরিক হতেই হবে, এমন নয়। আলোচনায় না থাকা একজন ভদ্রলোকও রাষ্ট্রপতি হওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন যদি তিনি ক্ষমতাসীন দলটির স্বার্থ রক্ষায় আপসহীন হন। আলোচিত ওয়ান-ইলেভেনের আগে-পরে আমরা তো দেখেছি, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ কীভাবে বিএনপির স্বার্থ রক্ষায় তার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। তেমন পরিস্থিতি আর না হোক। কিন্তু হলে?
সামান্য হলেও দুশ্চিন্তার জায়গা ওটাই। আর কিছু নয়। এদেশে সরকার পরিচালনায় রাষ্ট্রপতির ভূমিকা প্রায় শূন্য। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে প্রদত্ত যৎসামান্য ক্ষমতা ব্যবহারে উদ্যোগী সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের বক্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে। বিএনপি মনোনীত সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাহীনতা নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন। তাকে শেষতক কী পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়েছিল, আমরা জানি। সর্বশেষ রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদও রসাত্মক ঢংয়ে তার অতি সীমাবদ্ধ ক্ষমতা ও অসহায়ত্বের কথা বর্ণনা করেছেন।
রাষ্ট্রপতি কে হবেন বা হলেন, তা নিয়ে অতি উৎসাহের সুযোগ তাই নেই। সত্যি বলতে ক্ষমতাসীন দলের বৃত্তেই কেবল এ সংক্রান্ত আলাপে উৎসাহ রয়েছে। লোকে বরং জানতে চায়, আগামী নির্বাচনের আগে কেমন থাকবে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। মাঠের বিরোধী দল কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে কিনা। সংঘাত-সহিংসতায় রাজপথ উত্তপ্ত হবে কিনা। মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতিই বা কী দাঁড়াবে এমনকি রমজান আসতে আসতে। ঘনায়মান এ সংকট সামলাতে সরকার কী করছে, সেটা বরং জানতে চায় মানুষ। আগামী নির্বাচন গ্রহণযোগ্য পরিবেশে আর অংশগ্রহণমূলক না হলে কী হবে, সেটা নিয়েও তারা চিন্তিত।