শেখ হাসিনার আরেকটি চমক
বার্তা সম্পাদক মোঃ সজীবুল হক : অন্য রাজনীতিবিদদের ভাবনা যেখানে শেষ হয়, সেখান থেকে শুরু হয় শেখ হাসিনার ভাবনা। অন্য রাজনীতিবিদরা চিন্তা করেন আজকের। আওয়ামী লীগ সভাপতি চিন্তা করেন আগামীকালের। অন্যরা সবকিছু দেখেন সামনে থেকে।
শেখ হাসিনা সবকিছু দেখেন চারপাশ থেকে। এ ভিন্নতা তাঁকে করেছে অসাধারণ। অনন্য। আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা ১৪ বছরের বেশি সময় ক্ষমতায়।
ক্ষমতায় থাকার ম্যাজিক কী? এ প্রশ্নের উত্তরে অনেকে অনেক কথাই বলবেন। কিন্তু টানা ক্ষমতায় থাকার আসল রহস্য হলো শেখ হাসিনার ম্যাজিক। তাঁর অনন্য ও দূরদর্শী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং প্রজ্ঞার জন্যই আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায়। শেখ হাসিনা যে সিদ্ধান্ত গ্রহণে কতটা দূরদর্শী এবং ব্যতিক্রমী তার প্রমাণ এবার রাষ্ট্রপতি মনোনয়নে নতুন করে পাওয়া গেল।
নতুন রাষ্ট্রপতি কে হবেন? এ নিয়ে দেশজুড়ে নানা আলোচনা ছিল। সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতিদের তালিকা প্রকাশে দেশের গণমাধ্যমগুলোর মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, ড. মশিউর রহমানসহ বিভিন্ন ব্যক্তির নাম ঘুরে-ফিরে এসেছে বারবার। আওয়ামী লীগের নেতারাও নতুন রাষ্ট্রপতির ব্যাপারে ছিলেন অন্ধকারে। এমনকি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও জানতেন না নতুন রাষ্ট্রপতির নাম।
গত বৃহস্পতিবার (৯ ফেব্রুয়ারি) আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়ে নেতা-কর্র্মীদের নিয়ে ঘরোয়া আলাপচারিতায় বসেছিলেন ওবায়দুল কাদের। ওই আড্ডায় যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের একজন জানালেন, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিমকে সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতির ব্যাপারে কিছু তথ্য দিচ্ছিলেন। জানাচ্ছিলেন, এমন একজন ব্যক্তি যিনি এমপি নন, আমলা নন, কিন্তু আওয়ামী লীগের। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিমকে বলেছিলেন, নেত্রী এই তিনটা পয়েন্ট দিয়েছেন। তুমি বলতে পার কে? ওবায়দুল কাদের বা নাছিম কেউই তিন সূত্রের উৎস ধরে নতুন রাষ্ট্রপতির নাম ‘আবিষ্কার’ করতে পারেননি। অর্থাৎ নতুন রাষ্ট্রপতি কে হচ্ছেন, এ সম্পর্কে ১২ ফেব্রুয়ারি সকালের আগে আওয়ামী লীগের কোনো শীর্ষ নেতাই কিছু জানতেন না। কৌশলগত কারণেই শেখ হাসিনা নামটি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গোপন রেখেছেন। ২০০৯ সাল থেকেই তিনি রাজনৈতিক কৌশলগুলো এভাবেই গোপন রাখছেন। যে কারণে তাঁর কৌশল অব্যর্থ হয়ে উঠেছে। তাঁর এ কৌশলেই বিরোধী দল পরাজিত। আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায়। দলের নেতা থেকে তিনি রাষ্ট্রনায়ক এবং বিশ্বনেতায় পরিণত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর চমক এটিই প্রথম নয়। গত ১৪ বছরের রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে তিনি নানা চমক দেখিয়েছেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়। ঐক্যফ্রন্টের সভায় নির্বাচন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের স্থির বিশ্বাস ছিল প্রধানমন্ত্রী সংলাপের দাবি প্রত্যাখ্যান করবেন। এটিই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ইস্যু করতে পারবে। সে লক্ষ্যেই তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের প্রস্তাব করে চিঠি পাঠায়। যথারীতি আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রতিক্রিয়া ছিল নেতিবাচক। তারা বললেন, কীসের সংলাপ। কোনো সংলাপ হবে না। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী সংলাপের প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। শুধু জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নয়, স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে বাদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী গণভবনে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করলেন। এ সংলাপ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকেই পাল্টে দিল। দলীয় সরকারের অধীনে, সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের রেকর্ড হলো।
২০২০ সালের মার্চে করোনা প্রকোপে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল বিশ্বজুড়ে। বাংলাদেশেও লকডাউন ঘোষিত হলো। কিন্তু লকডাউনের চেয়েও বড় চমক দিলেন শেখ হাসিনা। তিনি ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় প্রদত্ত নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করে বেগম জিয়াকে জামিন দিলেন। এর ফলে জেল থেকে ‘ফিরোজা’য় থাকার অনুমতি পেলেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। পরে জানা গেল বেগম জিয়ার ছোটভাই, বোন গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাদের অনুরোধে প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক উদারতায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। যিনি তাঁকে গ্রেনেড মেরে শুধু রাজনীতি নয়, পৃথিবী থেকে চিরবিদায় করতে চেয়েছিলেন, তাঁর প্রতি এমন উদারতা এক বিরল ঘটনা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এ কৌশলী সিদ্ধান্ত বিএনপির রাজনীতিকে এক দ্বিধান্বিত রেখায় দাঁড় করিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত যেমন চমকপ্রদ ছিল, তেমনি এ ব্যাপারেও আওয়ামী লীগের নেতারা ছিলেন অন্ধকারে। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে বেগম জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মালয়েশিয়ায় মারা যান। এ সময় বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচন বাতিল এবং নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পুনর্নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে। অগ্নিসন্ত্রাস, জ্বালাও-পোড়াও এবং সহিংসতায় জনজীবন দুর্বিষহ। এর মধ্যেই প্রটোকল ভেঙে প্রধানমন্ত্রী চলে যান গুলশানে। বেগম জিয়াকে সান্ত্বনা দিতে। বেগম জিয়া তখন ঘোষণা দিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য তাঁর গুলশানের কার্যালয়ে অবস্থান নিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী গুলশানের অফিসে গেলে মূল ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়। ছোট গেট দিয়েও দেশের প্রধানমন্ত্রীকে ভিতরে প্রবেশের সৌজন্যতা দেখানো হয়নি। সেদিন শেখ হাসিনার এই চমক তাঁকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। বেগম জিয়া এবং তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের এরকম অসৌজন্যমূলক আচরণে হতবাক হয়ে যায় গোটা দেশ। বিএনপির ওই লাগাতার আন্দোলনের অপমৃত্যুর জন্য এ ঘটনা বহুলাংশে ভূমিকা রেখেছে। ২০১৪ সালে আকস্মিকভাবে বেগম জিয়াকে টেলিফোন করে তাঁকে গণভবনে চায়ের নিমন্ত্রণ জানানো ছিল বাংলাদেশের রাজনীতির আরেক টার্নিং পয়েন্ট। আরেক চমক। ওই সাহসী সিদ্ধান্ত জনমতকে বিএনপির আন্দোলনের বিরুদ্ধে নিয়ে যায়। ওই নির্বাচনের আগে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে ‘সর্বদলীয় নির্বাচনকালীন সরকার’ গঠনের সিদ্ধান্ত ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরেকটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। বিএনপির অনেক নেতাই এখনো বলেন, ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান ছিল বিএনপির মহাভুল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বারের মতো শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। বিডিআর বিদ্রোহ সরকারের জন্য এক বড় সমস্যা হিসেবে সামনে আসে। এ সময় শেখ হাসিনা একক সিদ্ধান্তে সেনানিবাসে দরবার হলে গিয়ে সেনা কর্মকর্তাদের মুখোমুখি হন। তাদের উদ্দেশে বক্তৃতা দেন। অনেক উত্তেজনা ঠান্ডা মাথায় সামাল দেন। তার সঙ্গে ছিলেন তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী এখন সংসদ উপনেতা, বেগম মতিয়া চৌধুরী। প্রধানমন্ত্রীর ওই সিদ্ধান্তে চমক তো ছিলই, সঙ্গে ছিল সাহসিকতা। গত ১৪ বছরে দেশের রাজনৈতিক ঘটনাবলি নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করলে এরকম বহু চমকের দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। যেসব চমকের সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। এটি আসলে এক ধরনের রাজনৈতিক কৌশল। এটা অনেকটাই ঝানু দাবাড়ুর প্রাজ্ঞ চালের মতো। যে চাল প্রতিপক্ষ আঁচ করতে পারে না। আর আওয়ামী লীগ সভাপতির কৌশল যেন প্রতিপক্ষ জানতে না পারে সে জন্য তাঁর পরিকল্পনা এবং সিদ্ধান্ত তিনি দলের কাউকে বলেন না। এক-এগারোর আগে এরকম বহু ঘটনা আমরা দেখেছি। শেখ হাসিনা একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁর বিশ্বস্ত, ঘনিষ্ঠ দু-একজনকে বলেছেন। ব্যস তারাই এটা ফাঁস করে দিয়েছেন। পুরো কৌশলটাই ভেস্তে গেছে। এভাবে রাজনৈতিক জীবনে বহুবার প্রতারিত হয়েছেন। বিশ্বাসঘাকতার শিকার হয়েছেন। এক-এগারো এক্ষেত্রে সম্ভবত আওয়ামী লীগ সভাপতির সবচেয়ে বড় শিক্ষা। এক-এগারোর পর শেখ হাসিনা তাঁর কৌশল পরিবর্তন করেছেন। এখন তাঁর গুরুত্বপূর্ণ, স্পর্শকাতর সিদ্ধান্তগুলো যেমন গোপন থাকে, তেমনি সিদ্ধান্তে থাকে চমক। কেউ কেউ মনে করতেই পারেন নতুন রাষ্ট্রপতি কে হবেন, এ নিয়ে গোপনীয়তার দরকার কী? অবশ্যই গোপনীয়তার দরকার ছিল। পাঠক লক্ষ্য করুন, রাষ্ট্রপতি হিসেবে গণমাধ্যমে যাদেরই নাম এসেছে তাদেরই বিতর্কিত করার চেষ্টা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ফেসবুক, ইউটিউবে কিছু ব্যক্তি এখন চরিত্র হননের খেলায় মেতেছে। নতুন রাষ্ট্রপতির নাম আগে জানাজানি হলে সেই নোংরামি শুরু হতো। তাছাড়া আওয়ামী লীগেও নানাজন নানাভাবে সিদ্ধান্ত পাল্টানোর জন্য দেনদরবার করত। একজন রাষ্ট্রপতি হলেন দেশের ঐক্য ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। তাঁকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা দেশের সংবিধান ও সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত। শেখ হাসিনা ভালো করেই জানেন, একটি মহল তৎপর। তারা সবকিছুকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে। এ কারণেই তিনি এমন একজনকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বেছে নিলেন, যার যোগ্যতা অসাধারণ কিন্তু তিনি অনালোচিত। কর্মদীপ্ত কিন্তু পাদপ্রদীপে নেই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে আচমকা। এ সিদ্ধান্তে ষড়যন্ত্রকারীদের সমস্যা হয়েছে। কারণ নতুন মহামান্যকে নিয়ে মিথ্যার বেসাতি সাজাতেও তাদের সময় লাগবে। সমস্যাও হবে। শেখ হাসিনার ‘চমক কৌশল’ই রাজনীতিতে তাঁকে দিয়েছে দার্শনিকের মর্যাদা। সামনে নির্বাচন এবং আন্দোলন। সেখানেও হয়তো দেখা যাবে প্রধানমন্ত্রীর আরও বড় চমক। সেই চমকেই কেটে যাবে নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ।