কোচিং-বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালা বাস্তবায়নের হার শূন্য!

বিশেষ প্রতিনিধি : ২০১১ সালের উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশ দেওয়ার ঠিক পরের বছরই একটি নীতিমালা জারি করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এটি ছিল শিক্ষকদের ‘কোচিং বাণিজ্য’ বন্ধ করা নিয়ে। এটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা-২০১২’। ঐ বছরের ২০ জুন এটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা হয়। কিন্তু নীতিমালা জারির ১০ বছর পর ২০২২-এ এসে দেখা গেল, মাঠ পর্যায়ে এই নীতিমালা বাস্তবায়নের হার শূন্য ভাগ। নেই কোনো মনিটরিং কার্যক্রমও। এতে ক্ষুব্ধ অভিভাবক-শিক্ষার্থী। তবে খুশি ‘কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনিতে সুবিধাভোগী শিক্ষকরা।

আগামী শিক্ষাবর্ষে চারটি শ্রেণিতে নতুন কারিকুলাম শুরু হবে। এই কারিকুলামে শিক্ষকদের হাতে অনেক নম্বর রাখা হয়েছে। কোনো কোনো শ্রেণিতে বার্ষিক পরীক্ষার চেয়েও বেশি। তাই শিক্ষকের কাছে কোচিং-টিউশনিতে পড়লে বেশি নম্বর দেওয়া হবে—এমন আশঙ্কা থেকেই এই ‘কোচিং বাণিজ্য বন্ধ’ নীতিমালা শতভাগ কার্যকরের বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।

২০১২ সালে নীতিমালা জারির পর নীতিমালা বাস্তবায়নের তোড়জোড় দেখা দেয়। এই নীতিমালা ঠিকমতো বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য কেন্দ্রীয়, বিভাগীয়, জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে মনিটরিং কমিটিও গঠন করা হয়। কিন্তু এই তোড়জোড় ছিল সর্বোচ্চ ছয় মাস। এরপর থেমে যায় বাস্তবায়ন এবং মনিটরিং কার্যক্রমও। প্রাইভেট টিউশনিতে শিক্ষকরা জড়িত—মনিটরিং কমিটি এমন অভিযোগ করলেও সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেই।

এই নীতিমালা তদারকির প্রধান দায়িত্ব মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি)। মাউশির এমনও অনেক কর্মকর্তা আছেন, যাদের এই নীতিমালা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণাও নেই। অবস্থাটা এমন যে, মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাও যেন এই নীতিমালা ভুলে গেছেন। অথচ আদালতের নির্দেশে এই নীতিমালা জারি হয়েছিল।

এই প্রতিবেদন তৈরির জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিভাবক ও স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নীতিমালা কেউই মানছে না ১ শতাংশও। সরেজমিনে ঘুরেও এই নীতিমালা বাস্তবায়নের কোনো প্রমাণ মেলেনি।

যে কারণে নীতিমালা
কেন নীতিমালা প্রয়োজন তা প্রকাশিত নীতিমালার শুরুতে বলা হয়। সেখানে বলা হয়—‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একশ্রেণির শিক্ষক বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কোচিং পরিচালনা করে আসছেন। এটি বর্তমানে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন; যা পরিবারের ওপর বাড়তি আর্থিক চাপ সৃষ্টি করেছে এবং এ ব্যয় নির্বাহে অভিভাবকগণ হিমশিম খাচ্ছেন। এছাড়া অনেক শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে মনোযোগী না হয়ে কোচিংয়ে বেশি সময় ব্যয় করছেন। এক্ষেত্রে দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা এবং অভিভাবকগণ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ সম্পর্কিত হাইকোর্ট বিভাগে দায়েরকৃত রিট পিটিশনের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ওপর কোচিং বাণিজ্য বন্ধে একটি গেজেট নোটিফিকেশন বা অন্য কোনোরূপ আদেশ প্রদানের নির্দেশনা রয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি ও হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে কোচিং বাণিজ্য বন্ধে সরকার কর্তৃক এ নীতিমালা প্রণয়ন করা হলো।’

নীতিমালায় যা বলা আছে
ঐ নীতিমালার উল্লেখযোগ্য অংশ হলো, কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারবেন না। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানের অনুমতি নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ১০ জন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান প্রধানকে ছাত্রছাত্রীর তালিকা, রোল, নাম ও শ্রেণি উল্লেখ করে জানাতে হবে।

নীতিমালা না মানলে যে শাস্তি
নীতিমালা না মানলে তিন ধরনের শাস্তির কথা বলা হয়েছিল। প্রথমত, এমপিওভুক্ত হলে এমপিও স্থগিত, বাতিল, বেতন কমিয়ে দেওয়া বা বরখাস্ত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের এমপিওবিহীন শিক্ষক হলে প্রতিষ্ঠান থেকে দেওয়া বেতন স্থগিত বা চাকরি থেকে বরখাস্তের মতো ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তৃতীয়ত, প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত না হলে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা, বেতন স্থগিতের মতো ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া হলে সরকার ঐ সব প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেবে।

মাঠ পর্যায়ের চিত্র
কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা শিক্ষকরা মানছেন—এমন কোনো উদাহরণ নেই। আজিজুল ইসলাম নামে এক অভিভাবক বলেন, ‘শতভাগ গ্যারান্টি দিয়ে বলছি কোনো শিক্ষকই এই নীতিমালা মানেন না। নীতিমালা জারির আগে যেভাবে কোচিং বাণিজ্য চলত, এখনো ঠিক সেই আগের মতোই চলছে। শিক্ষকরা নিজ বাসায় পড়ান। কোনো কোনো শিক্ষক পৃথক বাসা ভাড়া নিয়ে কোচিংয়ে শিক্ষার্থী পড়ান। পরিস্থিতি এমন যে, স্কুলে শুধু উপস্থিত হাজিরা দেওয়ার জন্য, আর কোচিং হলো পড়াশোনার জন্য। কিছু শিক্ষক নীতিমালা জারির আগেও কোচিং-প্রাইভেট টিউশনিতে জড়িত ছিলেন না। এখনো নেই। তবে এ সংখ্যা হাতেগোনা।

শিক্ষকরা কী বলছেন
এই প্রতিনিধির সঙ্গে একাধিক শিক্ষক ও শিক্ষক নেতার সঙ্গে কথা হয়। নাম না প্রকাশ করার শর্তে তারা জানান, প্রাইভেট পড়ান শিক্ষকরা—এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবে অভিভাবকদেরও আগ্রহ আছে। শ্রেণিকক্ষে বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী থাকায় পড়াশোনা হয় না। তাই প্রাইভেট কোচিংয়ে পড়াতে বাধ্য হন অভিভাবকরা। শুধু বেসরকারি শিক্ষকরা নন, সরকারি স্কুলের শিক্ষকরাও পড়ান এমন অভিযোগ তাদের।

অভিভাবকরা কী বলছেন
অভিভাবকরা বলছেন, আমরা বাধ্য হয়েই শিক্ষকের বাসায় বা শিক্ষক পরিচালিত কোচিং সেন্টারে পড়তে পাঠাই। কোনো শিক্ষার্থী কোনো শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট কোচিংয়ে পড়লে সে স্কুলের পরীক্ষার খাতায় ভালো নম্বর পায়। পরীক্ষার আগে নানা কৌশলে এসব শিক্ষার্থীকে প্রশ্ন দিয়ে দেন শিক্ষকরা। এছাড়া স্কুলের পাঠদানে শিক্ষকরা মনযোগী নন। কেউই যদি প্রাইভেট-কোচিংয়ে না পড়ে সেটা ভালো হবে। তারা কঠোর মনিটরিং করে এই নীতিমালা বাস্তবায়নের দাবি অভিভাবকদের। এই নীতিমালা বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিক্ষায় অনিয়ম অনেকাংশে দূর হবে বলে মনে করেন তারা।

শাস্তির উদাহরণ
কোচিং বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের অভিযোগে রাজধানীর আট প্রতিষ্ঠানের মোট ৯৭ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছিল দুদক। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি সেসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান, পরিচালনা পর্ষদ এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিবকেও দুদকের পক্ষ থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছিল। সে আলোকে ২০১৮ সালে কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে রাজধানীর পাঁচটি সরকারি বিদ্যালয়ের ২৫ জন শিক্ষককে বিভিন্ন জেলায় বদলি করা হয়েছিল। কিন্তু যারা বদলি হয়েছিল তারা আবারও ফিরে এসেছেন ঢাকায়। অন্য কোথাও শাস্তি দেওয়া হয়েছে এমন বড় কোনো উদাহরণ নেই। এছাড়া নীতিমালায় বদলির কথা নেই। যে তিন ধরনের শাস্তির কথা বলা হয়েছে তার একটাও এদের ক্ষেত্রে নেওয়া হয়নি। ২০১৯ সালের আগস্টে মনিটরিং ব্যবস্থা আরো জোরদারের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে উচ্চ পর্যায়ের সভা হয়েছিল। কিন্তু সে সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি।

মনিটরিং কর্মকর্তারা কী বলছেন
মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা এই নীতিমালা বাস্তবায়নের ধারেকাছে নেই। পল্লবী ও রূপনগর এলাকার শিক্ষা কর্মকর্তার অফিস মিরপুর বাংলা স্কুলের ক্যাম্পাসের ভেতরেই। অথচ এই স্কুলের শিক্ষকরাই এই কোচিং বাণিজ্যে জড়িত। এক শিক্ষক জানান, শিক্ষা কর্মকর্তা ফারজানা শারমিনের এই বিষয়ে কোনো নজরদারি নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফারজানা শারমিন বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যখন বলেন তখন এই বিষয়ে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। নীতিমালা জারি থাকার পরও কেন নতুন করে আদেশ দিতে হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি মোবাইল ফোনে কোনো উত্তর দিতে চাননি। এমন চিত্র প্রায় পুরো দেশের।

শিক্ষা অধিদপ্তর কী বলছে
শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক বেলাল হোসাইন বলেন, একবার ২৫ জন শিক্ষককে বদলি করা হয়েছিল। পরে দুদকের সুপারিশ নিয়ে তারা অভিযোগ থেকে অব্যাহতি নিয়েছে। মাঠ পর্যায়ে এই নীতিমালা বাস্তবায়ন হচ্ছে না—এমন অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। আমরা মাঠ পর্যায়ের পরিচালক ও উপ-পরিচালকদের বলে দেব যাতে এই নীতিমালা বাস্তবায়নে তারা কঠোর হন।

যা বললেন শিক্ষামন্ত্রী
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, কোচিংকে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে। কোচিংয়ের অনৈতিক দিকগুলো বন্ধ করা দরকার। প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনের খসড়ায় শিক্ষক কাকে, কোথায় পড়াতে পারবেন, সেই বিষয়গুলো বলা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *