ইউনূসকে চুবানি দিয়ে পদ্মা সেতুতে তোলা, আর খালেদাকে টুস করে নদীতে ফেলা উচিত: প্রধানমন্ত্রী

বিশেষ প্রতিনিধি : মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষ্যে আয়োজিত স্বপ্নপূরণের জয়োত্সবের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা|
প্রমত্তা পদ্মার বুকে বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন করে নতুন স্বপ্নের উন্মোচন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল শনিবার মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষ্যে আয়োজিত স্বপ্নপূরণের জয়োত্সবের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে দেশের মানুষকে ‘স্যালুট’ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষের সমর্থন আর সাহসেই তিনি নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কঠিন কাজটি সম্ভব করতে পেরেছেন। কবির ভাষায় তিনি বলেছেন, ‘যতবারই হত্যা করো, জন্মাবো আবার; দারুণ সূর্য হবো, লিখবো নতুন ইতিহাস।’

বেলা ১১টা ৫৮ মিনিটে মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর ফলক উন্মোচন করে স্বপ্নের দুয়ার খুলে দেন শেখ হাসিনা। দুই দশক আগে তিনিই দক্ষিণ জনপদের ২১ জেলার মানুষের এ স্বপ্নের সেতুর ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। সকালে হেলিকপ্টারে করে মাওয়ায় পদ্মা সেতু সার্ভিস এরিয়ায় সুধী সমাবেশে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী। সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাঙালি বীরের জাতি। আমরা মাথা নোয়াই নি, আমরা কোনদিন মাথা নোয়াব না। এ সেতু বাংলাদেশের জনগণের। এর সঙ্গে জড়িত আছে আমাদের আবেগ, সৃজনশীলতা, সাহসিকতা, সহনশীলতা এবং আমাদের প্রত্যয়, জেদ। যে জেদের কারণে আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণে সক্ষম হয়েছি। যারা বাধা দিয়েছে, তাদের একটা জবাব আমরা দিয়েছি। এই পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে তাদের একটা সমুচিত জবাব দিতে পেরেছি।

প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতুকে বাংলাদেশের গর্ব, সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক আখ্যায়িত করে বলেন, সকল ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে বহুল প্রতীক্ষিত সেতুটি এখন প্রমত্তা পদ্মার বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। আজ পদ্মার বুকে জ্বলে উঠেছে লাল, নীল, সবুজ, সোনালি আলোর ঝলকানি। ৪১টি স্প্যান যেন স্পর্ধিত বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। পদ্মা সেতু নির্মাণের বিরোধিতাকারীদের ব্যাপারে তার কোন অভিযোগ বা অনুযোগ নেই জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই জনগণই আমার সাহসের ঠিকানা, এই জনগণকে আমি স্যালুট জানাই। আমি আশাবাদী, পদ্মা সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। তাদের হয়তো চিন্তা-চেতনার দৈন্যতা রয়েছে। আত্মবিশ্বাসের অভাব রয়েছে। কাজেই তাদের দেশপ্রেম জাগ্রত হবে এবং দেশের মানুষের প্রতি তারা আরো দায়িত্ববান হবেন।

প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে সেতু নির্মাণকাজের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, যারা এ প্রকল্পের জন্য বাপ-দাদার ভিটা ছেড়ে দিয়েছেন সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘আপনারা সবাই জানেন, এ সেতু নির্মাণ করতে যখন আমরা যাই, অনেক ষড়যন্ত্র শুরু হয়, মিথ্যা অপবাদ, দুর্নীতির অপবাদ দিয়ে একেকটি মানুষ, একেকটি পরিবারকে যে মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে। আমার ছোট বোন শেখ রেহানা, আমার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, আমার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ, শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক, আমার অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক যোগাযোগ সচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া—যারা এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাদের ওপর মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয়, তাদের পরিবারসহ যে যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে, আমি তাদের প্রতি সহমর্মিতা জানাই।’ শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সেতু নির্মাণের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন—সকল প্রকৌশলী, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী, দেশি-বিদেশি পরামর্শক, ঠিকাদার, প্রযুক্তিবিদ, শ্রমিক, নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি জানি আজকে বাংলাদেশের মানুষ গর্বিত। সেই সঙ্গে আমিও আনন্দিত, গর্বিত এবং উদ্বেলিত।

প্রধানমন্ত্রী তার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ভাষণে আরো বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজের গুণমানে কোনো আপস করা হয়নি। এই সেতু নির্মিত হয়েছে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও উপকরণ দিয়ে। সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা বজায় রেখে পুরো নির্মাণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে সর্বোচ্চ মান বজায় রেখে। পদ্মা সেতুর পাইল বা মাটির গভীরে বসানো ভিত্তি এখন পর্যন্ত বিশ্বে গভীরতম। ভূমিকম্প প্রতিরোধ বিবেচনায় ব্যবহূত হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। এ রকম আরো বিশেষ কিছু বৈশিষ্ঠ্যের কারণে এই সেতুর নির্মাণ পদ্ধতি বিশ্ব জুড়ে প্রকৌশলবিদ্যার পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হবে—এটা নিশ্চিত। কারণ এটা একটা আশ্চর্য সৃষ্টি।

প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়া, প্রকল্পে যুক্ত কর্মকর্তাদের নামে মামলা এবং বাংলাদেশের একজন অর্থনীতিবিদ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধির ঐ সময়ের ভূমিকা নিয়েও কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ২০০১ সালের ৪ জুলাই তিনি মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তবে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তিনি বলেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার ২২ দিনের মধ্যে আমরা নকশা তৈরির জন্য পরামর্শক নিয়োগ করা হয়। পদ্মা সেতুর অর্থায়নের জন্য অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে বিশ্বব্যাংকও এগিয়ে আসে। কিন্তু দেশের কোনো একজন স্বনামধন্য ব্যক্তির (ড. ইউনূস) জন্য বিশ্বব্যাংক প্রকল্প থেকে সরে যায়। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জার। বিষয়টি নিয়ে অনেক পানি ঘোলা করা হয়েছে, অনেক ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অর্থনীতিবিদসহ আরো কয়েকজন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেতু চালু হওয়ার পর সড়ক ও রেলপথে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এর ফলে এ অঞ্চলের মানুষের একদিকে দীর্ঘদিনের ভোগান্তি লাঘব হবে, অন্যদিকে অর্থনীতি হবে বেগবান। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হবে। আশা করা হচ্ছে, এ সেতু জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ১ দশমিক দুই-তিন শতাংশের বেশি হারে অবদান রাখবে এবং এর ফলে দারিদ্র্য নিরসন হবে। এ সেতুকে ঘিরে গড়ে উঠবে নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্ক। ফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে এবং দেশের শিল্পায়নের গতি ত্বরান্বিত হবে। তাছাড়া পদ্মার দুই পাড়ে পর্যটন শিল্পেরও ব্যাপক প্রসার ঘটবে। পাশাপাশি এ বছরের শেষ নাগাদ চালু হবে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল এবং ঢাকায় মেট্রোরেল। ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উত্পাদন শুরু হবে। ঢাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। সেটিও ২০২৩ নাগাদ চালু হবে। প্রধানমন্ত্রী এ সময় আবেগজড়িত কণ্ঠে রক্তাক্ত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কথা তুলে ধরেন।

মাওয়ায় সুধী সমাবেশ শেষে সেতুর জাজিরা প্রান্তে মাদারীপুরের শিবচরে কাঁঠালবাড়ীতে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় বক্তব্য রাখেন শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি পদ্ম সেতুর কাজে ষড়যন্ত্রকারী এবং উপহাসকারীদের অপমানের জবাব দেন। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে পদ্মা সেতু হয়েছে কিনা দেখে যেতে বলেন। এছাড়াও দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে তিনি বক্তব্য দেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই বাংলাদেশের মানুষের জন্য আমার বাবা জীবন দিয়ে গেছেন। জীবন দিয়ে গেছেন আমার মা-ভাইয়েরা। আমি ও আমার ছোট বোন বেঁচে আছি। এই পদ্মা সেতু করতে গিয়ে আমাদের অনেক অসম্মান করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু আমরা পিছু হটি নাই। আমাদের একটাই লক্ষ্য ছিল। আমরা এই সেতু নির্মাণ করব। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন আমরা করব। আমরা সেটা করেছি। প্রধানমন্ত্রী কবিতার ভাষায় তার বক্তব্য শেষ করেন। তিনি বলেন, ‘রিক্ত আমি, সিক্ত আমি দেওয়ার কিছু নাই; আছে শুধু ভালোবাসা দিয়ে গেলাম তাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *