দেবহাটায় মাদ্রাসার ছাত্রী ধর্ষণ করা শিক্ষক ফিরতে চান স্ব পদে
মিজানুর রহমান দেবহাটা প্রতিনিধি : দেবহাটায় নিজ মাদ্রাসার ছাত্রী ধর্ষণ ও রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার চার্জশিটভূক্ত আসামী সাময়িক বহিস্কৃত শিক্ষক ফজর আলী নিজেকে স্ব পদে বহাল রাখতে বিভিন্ন স্থানে দৌঁড়ঝাপ শুরু করেছেন। সে দেবহাটা উপজেলার হাদীপুর জগন্নাথপুর আহছানিয়া আলিম মাদ্রাসার আইসিটি বিষয়ক শিক্ষক ও কালীগঞ্জ উপজেলার কাশেমপুর গ্রামের দবিরউদ্দীন খাঁনের ছেলে।
নারী ও শিশু নির্যাতন চলমান মামলা সুত্রে জানা যায়, একই মাদ্রাসার শিক্ষক জহুরুল হকের বাড়িতে ফজর আলী শিক্ষকতার সূত্র ধরে যাওয়া আসা ছিল। সেই সুযোগে শিক্ষক জহুরুল হকের মেয়েকে ফুসলিয়ে পরিবারের সদস্যদের ঘুমের ঔষধ দিয়ে অচেতন করে প্রায় ২ বছর ধরে ধর্ষন করতেন ফজর আলী। পরবর্তীতে গত ১০/০৬/২০১৮ তারিখ রাত ১০ টার দিকে বহিস্কৃত শিক্ষক ফজর আলী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীকে ধর্ষন করে পালিয়ে যাওয়ার সময় ধরা পড়ে। এ ব্যাপারে শিক্ষক জহুরুল হক বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০১ এর ৯(১) ধারায় দেবহাটা থানায় ১২ নং মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় ফজল আলী গ্রেপ্তার হন। পরে সাতক্ষীরা আমলি আদালাতে ভিক্টিম ও স্বাক্ষীদের জবানবন্দী রেকার্ড করা হয়। পরবর্তীতে দেবহাটা থানা পুলিশের মাধ্যমে উক্ত মামলার চার্জশীট আদালতে জমা দেওয়া হয়। এর আগে শিক্ষক জহুরুল ও তার ভাইকে বিপদে ফেলতে গত ইং ০৫/০৬/১৮ ইং তারিখে থানা মসজিদের ভিতরে একটি হলুদ খামে সরকার ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিভিন্ন উসকানীমূলক চিঠি প্রদান করে। পরে বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ আইন-২ শাখায় জানালে ফজর আলীকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ প্রদান করে। পরে গত ১৬/০৫/১৯ তারিখের দায়েরকৃত মামলায় তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
অভিযুক্ত শিক্ষক ফজর আলী ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠানে যোগদান করে। যোগাদানে পর থেকে একাধীক ছাত্রীকে যৌন হয়রানি, বিয়ে পরবর্তী ছাত্রীদের সংসারে মনমালিন্য সৃষ্টি সহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগের বিষয়গুলো তদন্ত কমিটি সত্যতা পেলেও বিভিন্ন ব্যক্তিকে ম্যানেজ করে স্ব পদে বহাল ছিলেন। পরবর্তীতে নারী শিশু নির্যাতন আইনে আসামী হয়ে জেল খাটায় ২৭/৬/২০১৮ তারিখে ম্যানেজিং কমিটির সভায় শিক্ষক ফজর আলীকে মাদ্রাসা পরিচালনা নীতি মোতাবেক সাময়িক বহিস্কার করে। এরপর আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে শিক্ষক ফজর আলী। এরপর ২০১৯ সালের ৫ জুলাই ফজর আলী মাদ্রাসার দলবল এনে গেটে এসে হুমকি দিয়ে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে উপজেলা প্রশাসন ও থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে আনেন।
বর্তমানে সাময়িক বহিস্কৃত শিক্ষক ফজর আলী নিজেকে বাঁচাতে এবং স্ব পদে বহাল রাখতে বিভিন্ন মহলে দৌঁড়ঝাপ শুরু করে। সর্বশেষ বহিস্কৃত অবস্থায় বকেয়া পুর্ণ বেতনভাতা ও স্ব পদে দায়িত্ব প্রদানের আবেদন জানান। কিন্তু নীতিমালা অনুযায়ী সাময়িক বহিস্কার আদেশ প্রত্যাহার হলেও তিনি সনদপত্র জালিয়াতি করে চাকুরীতে যোগদান করায় বোর্ডে তার সনদ ভূয়া প্রমাণিত হয়। কিন্তু নারী শিশু নির্যাতন আইন ও রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার চলমান আসামী হওয়াতে ফজর আলীর যোগদান ও বহিস্কার আদেশ প্রত্যাহর করা হয়নি। এরই প্রেক্ষিতে ১১ এপ্রিল দুপুরে মাদ্রাসা ছুটির পর উপজেলা নির্বাহী অফিসার, তার দপ্তরের কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্য নিয়ে মাদ্রাসায় প্রবেশ করেন। এসময় মাদ্রাসার সুপার অফিসিয়াল কাজে বাহিরে থাকায় ভারপ্রাপ্ত সুপারের নিকট বিভিন্ন বিষয়ের জবাব চান উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবিএম খালিদ হোসেন সিদ্দিকী।
দায়িত্বরত শিক্ষক মাসুম বিল্লাহ জানান, আকর্ষিক উপজেলা নির্বাহী অফিসার মহোদয় পুলিশ নিয়ে মাদ্রাসায় প্রবেশ করেন। এসময় সাময়িক বহিস্কৃত শিক্ষক ফজর আলী তাদের সাথে আসেন। আমার কাছে নির্বাহী অফিসারের আদেশকৃত চিঠির জবাব না দেওয়ার বিষয়ে জানতে চান। আমি এ বিষয়ে কিছু জানি না বলে জানালে সাদা কাগজে উক্ত বিষয়টি লিখে নেওয়া হয়।
এদিকে নিজ মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে দায়ের করা মামলার বাদী জহুরুল হক জানান, আমার সরলতার সুযোগে লম্পট ফজর আলী আমার মেয়েকে ধর্ষণ করে আসছিল। একপর্যায়ে বিষয়টি ধরা পড়লে আমরা আইনের আশ্রয় গ্রহন করি। সে আমাদের ফাঁসাতে আমাদের নামে মিথ্যা লিফলেট ছাপিয়ে থানায় প্রদান করে। পরে সত্য উদঘাটন হয় এবং সে গ্রেফতার হয়ে জেল খাটে। কিন্তু জামিনে বের হয়ে আমাদের বিভিন্ন সময় হুমকি দিচ্ছে। আমরা বর্তমানে খুবই নিরাপত্তাহীনতায় ভূগছি। আমাদের বিভিন্ন ক্ষতি করবে বলে এখনো হুমকি দিচ্ছে। তিনি আরো বলেন, ফজর আলীর নোংরা চরিত্র প্রকাশ হওয়ার পর অনেক ছাত্র-ছাত্রী মাদ্রাসা ছেড়েছে। সে যদি আবারো এই প্রতিষ্ঠানে ফিরে আসে তাহলে মাদ্রাসাটি মুখ থুবড়ে পড়বে। হয়ত কোন মেয়ের বাবা আর এখানে তাদের কন্যা সন্তানকে পড়তে দেবেন না।
স্থানীয় অভিভাবক বাবুর আলী জানান, শিক্ষক ফজর আলী একজন খারাপ চরিত্রের মানুষ। তিনি যে অপকর্ম করেছেন তাতে আমরা সবাই লজ্জিত। বাবা হয়ে সন্তানদের এই মাদ্রাসায় দিতেও ভয় পায়। তিনি যদি আবারো বহাল হন তাহলে আমাদের সন্তানদের এখানে পড়ানো সম্ভব হবে না।
স্থানীয় বাসিন্দা আল-আমিন জানান, যে প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করেন সেই প্রতিষ্ঠানে ছাত্রী ধর্ষণের বিষয়টি অত্যান্ত লজ্জাকর। আমরা াইনা এমন দুচরিত্রের কোন ব্যক্তি পুনরায় এই প্রতিষ্ঠানে আসুক।
এদিকে মাদ্রাসার বর্তমান সুপার আব্দুস সালাম জানান, আমি মাদ্রাসার জরুরী কাজে ঢাকায় আছি। আমার অবর্তমানে বহিস্কৃত শিক্ষক ফজর আলী ইউএনও স্যার পুলিশ নিয়ে মাদ্রাসায় গিয়েছিলেন শুনেছি। আইসিটি শিক্ষক ফজর আলীর বহিস্কারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আরো বলেন, কোন শিক্ষক নারী শিশু ও রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার আসামী হলে বিধি মোতাবেক অটো বহিস্কার হয়ে যান। সেই আলোকে মাদ্রাসার সভাপতি উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুজিবর রহমানকে বিষয়টি অবহিত করি। পরে কমিটির মিটিংএ বিষয়টি উপস্থাপন হলে নিয়ম অনুযায়ী সকলের সিদ্ধান্তের আলোকে তাকে বহিস্কার করা হয়। তবে ৬০ দিনের বেশি সাময়ীক বহিস্কার আদেশ বহাল রাখা যায় না বলে ফজর আলী একটি পিটিশন দায়ের করে। কিন্তু ফজর আলী জাল সনদে অবৈধ নিয়োগে চাকুরীতে যোগদান করার বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় বোর্ডের নির্দেশ মোতাবেক সে অবৈধ ভাবে চাকুরীতে বহাল ছিলেন। অন্যদিকে নারী শিশু ও রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার আসামী হয়ে মামলা চলমান থাকায় নিষ্পত্তির আগ পর্যন্ত তাকে স্ব পদে বহাল কিংবা বকেয়া বেতন প্রদান সম্ভব নয়। হাইকোর্টের মামলার নিস্পত্তি না হওয়ায় কোন কিছু সম্ভব হচ্ছে না।
অভিযুক্ত শিক্ষক ফজর আলী জানান, আমি হাইকোর্ট, শিক্ষাবোর্ড, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ পেয়ে সোমবার ইউএনও, ওসি সাহেবকে নিয়ে মাদ্রাসায় যায় কিন্তু সুপার সাহেব না থাকায় দায়িত্বরত শিক্ষককে কাছ থেকে এ বিষয়ে সাদা কাগজে লিখিত নেওয়া হয়। তবে তার বিরুদ্ধে মামলা চলমান থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আরো বলেন, মামলা চলমান তাতে কি আমি পূর্ণাঙ্গ বেতনভাতা পাওয়ার দাবিদার।
তবে একজন চরিত্রহীন শিক্ষক নতুন ভাবে শিক্ষকতা ফিরে আসুক সেটি চান না এলাকাবাসী।