রোজানির্ভর ৬ পণ্যের দাম আকাশছোঁয়া

অপরাধ তথ্যচিত্র ডেস্ক: রোজাকে সামনে রেখে ছোলা, ভোজ্যতেল, মসুর ডাল, পেঁয়াজ, চিনি ও খেঁজুর-এ ছয় পণ্য নিয়ে ফের তৎপর হয়ে উঠেছে সেই পুরোনো সিন্ডিকেট। অথচ চাহিদার তুলনায় এগুলোর সরবরাহ ও মজুত পর্যাপ্ত। এরপরও বাজারে এসব পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। দাম কমাতে সরকার থেকে নীতি-সহায়তায় ছাড় দিলেও এর প্রভাব পড়ছে না। মূলত মিল ও মোকাম পর্যায় থেকেই দাম বাড়ায় পাইকারিতে এর প্রভাব পড়েছে। ফলে খুচরা বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যেন আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে। করোনার কারণে অর্থনৈতিক মন্দায় একদিকে মানুষের আয় কমেছে, অন্যদিকে পণ্য মূল্য বাড়ায় ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে স্বল্প ও মধ্য আয়ের ভোক্তাদের একরকম হাঁসফাঁস শুরু হয়েছে।রোজা এলেই কিছু পণ্যের চাহিদা বাড়ে। একে কেন্দ্র করে বাড়ে দাম। অর্থনীতির সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী চাহিদার তুলনায় পণ্যের সরবরাহ বেশি থাকলে দাম কম থাকে। কিন্তু বাজারে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি থাকার পরও দাম বাড়ছে। পণ্যমূল্য অযৌক্তিকভাবে বাড়ালে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে-এ মর্মে সরকারের একাধিক সংস্থার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হলেও কোনো কাজে আসেনি। বাজার তদারকিতে সরকারের ১৪টি সংস্থা মাঠে থাকলেও খুব একটা সুফল মেলেনি। উলটো পণ্যমূল্য নিু, স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। প্রতিবছরই রোজার আগে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তা যেন একরকম স্থায়ী সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এ ব্যাপারে সব সময়েই সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থগুলো ‘রহস্যময়’ কারণে অনেকটাই থাকে নির্বিকার। রোজার পণ্য নির্ভর সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় তারা বেপরোয়া হয়ে উঠে। এর প্রভাবে বাড়ে দাম। যা ঈদ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এ সময়ে ভোক্তার পকেট থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় সেই সিন্ডিকেট চক্র।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. এম কে মুজেরি বলেন, যে কোনো ব্যক্তিগোষ্ঠীর হাতে বাজারের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা চলে গেলে ভোক্তার স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়। তাই ভোক্তার সুরক্ষা দিতে হলে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের দরকার প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করা। কিন্তু দেশে সেটি হচ্ছে না। কিছু ব্যক্তি-গোষ্ঠীর হাতেই নিত্যপণ্যের নিয়ন্ত্রণ থেকে যাচ্ছে। এরা কারসাজি করলে তখন সরকারের আর করার কিছু থাকে না। তিনি মনে করেন, মুক্তবাজার অর্থনীতি থাকবে। কিন্তু তার মানে এই নয়, এর মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা যা খুশি তাই করার সুযোগ পাবে। বিশ্বের অনেক দেশে মুক্তবাজার অর্থনীতি থাকলেও সরকারের হাতে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও থাকে। বাংলাদেশেও এ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রাখতে হবে।
২০১৯ থেকে চলতি বছরের রোজার আগের পণ্য মূল্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে-রোজা শুরুর এক মাস আগে থেকেই রোজা নির্ভর ৬টি পণ্যের দাম হু হু করে বাড়ে। পুরো রমজান বাড়তি দামেই বেচাকেনা হয়। ঈদের পর গিয়ে তা কমতে থাকে। ২০১৯ সালের রোজায় প্রতি কেজি ছোলা ছিল ৭০ টাকা। ২০২০ সালেও ওই দর ছিল। ২০২১ সালে কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে ৭৫ টাকা হয়। চলতি বছর এখন প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকায়। প্রতি কেজি ছোট দানার ডাল ২০১৯ সালে ছিল ৯৫ টাকা। ২০২০ সালে ১০০ টাকা, ২০২১ সালে ১১০ টাকা এবং চলতি বছর ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। ভোজ্যতেল নিয়ে এবার বড় কেলেংকারি হয়ে গেছে। যার প্রভাব এখনও বাজারে বিদ্যমান। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ ও মজুত বেশি থাকায় তেলের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। বোতলজাত সয়াবিন তেল ২০১৯ সালে ছিল ৯৫ থেকে ১০০ টাকা লিটার। ২০২০ সালে ১০৫ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি হয়। ২০২১ সালে আরেক দফা বেড়ে ১৪০ টাকায় বিক্রি হয়। এবার তা ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা লিটার বিক্রি হচ্ছে। কিছুদিন আগে ২০৫ টাকা লিটার পর্যন্ত উঠেছিল। সরকারের তদারকির ফলে দাম কিছুটা কমেছে। সয়াবিন তেলের ওপর ভ্যাট, এলসি মার্জিন ও এলসি কমিশনে ছাড় দেওয়ার পর সরকার থেকে ইতোমধ্যে প্রতি লিটার ১৬০ টাকা দরে বিক্রি দাম বেঁধে দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাজারে ওই দরে তেল মিলছে না।প্রতি কেজি চিনি ২০১৯ ও ২০২০ সালে বিক্রি হয়েছে ৬৫ টাকা। গত বছর বিক্রি হয়েছে ৭০ টাকা কেজি। এবার তা বেড়ে ৮০ থেকে ৮২ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। পেঁয়াজ ২০১৯ সালে ছিল ৩০ টাকা কেজি। ২০২০ সালে বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকা কেজি। ওই বছর ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলে বাজারে দাম হু হু করে বেড়ে যায়। কিন্তু বাজারে পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি ছিল না। গত বছর পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৩৫ টাকা। এবার ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। সাধারণ মানের খেজুর ২০১৯ সালে ছিল ২০০ টাকা কেজি। ২০২০ সালে ২৫০ টাকা কেজি। গত বছর ৩৫০ টাকা কেজি। এবার এই খেজুর ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, প্রতি বছর রোজা ঘিরে অসাধুদের কারসাজির কারণেই মূলত এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পণ্য নিয়ে কারসজি করার দায়ে একাধিক দফায় সিন্ডিকেট চক্রটি চিহ্নিত করা হলেও কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। ফলে তারা নানা ইস্যুতে সুযোগ পেলেই নিত্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল করে তুলছে। এবারও আগের ধারাবাহিকতায় নতুন ভাবে রোজাকে টার্গেট করে বাজার বেসামাল করে ফেলেছে। সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ার অজুহাত কাজে লাগাচ্ছে। তাই এ সব নির্মূলে ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণে দেশে বেশ কিছু আইন আছে। সেসব আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। অসাধুদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি ভোক্তাদেরও সচেতন হতে হবে। রোজা উপলক্ষ্যে ১০ দিনের পণ্য একদিনে কেনা থেকে বিরত থাকতে হবে। এতে বাজারে পণ্য মূল্য সহনীয় রাখা সম্ভব হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ১০ মার্চ পর্যন্ত পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে ১৫ লাখ টন চিনি, ৬ লাখ টন দুধ, ৯ লাখ টন ভোজ্যতেল, ৭ হাজার টন ফল, ২ লাখ ৪ হাজার টন ডাল, ৪ লাখ ২৭ হাজার টন পেঁয়াজ, ২৪ হাজার টন ছোলা আমদানি করা হয়েছে। ১ মার্চ থেকে ১৪ মার্চ পর্যন্ত আরও ৬৪ হাজার টন চিনি, ৪ হাজার টন দুধ, ৬০ হাজার টন ভোজ্যতেল, ২ হাজার টন ফল, ১৩ হাজার টন ডাল, ৬ হাজার টন পেঁয়াজ, ১৬ হাজার টন ছোলা আমদানির এলসি খোলা হয়েছে। আমদানির অপেক্ষায় রয়েছে আরও পণ্য।
এদিকে গত অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারির তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে চিনি আমদানি বেড়েছে সাড়ে ৩০ শতাংশ, এলসি খোলা বেড়েছে ১০৪ শতাংশ, দুধ আমদানিতে এলসি খোলা বেড়েছে দশমিক ৯ শতাংশ, আমদানি বেড়েছে সোয়া ১৮ শতাংশ। পরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানির এলসি খোলা বেড়েছে ৯৫ শতাংশ এবং আমদানি বেড়েছে ৫৭ শতাংশ। তবে অপরিশোধিত তেল আমদানি ও এলসি খোলা দুটোই কমেছে। এর এলসি খোলা ১৫ শতাংশ ও আমদানি ২৮ শতাংশ কমেছে। ডালের এলসি খোলা ৯ শতাংশ এবং আমদানি ২৭ শতাংশ বেড়েছে।বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সার্বিক ভাবে বাজার তদারকি করা হচ্ছে। বিশেষ করে রোজা উপলক্ষ্যে অধিদপ্তরের তদারকি টিমের সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান পরিচালনা করছে। দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে অনিয়ম পেলে শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে। আশা করি রোজার আগে যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে সেগুলো কমে আসবে।আসন্ন রমজান উপলক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পণ্যের মজুত, সরবরাহ, আমদানি মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এতে বলা হয়-দেশে বছরে প্রায় ২৫ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে রোজার মাসের চাহিদা ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টন। স্থানীয় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ লাখ ৪ হাজার টন। আমদানি করা হয় ৬ থেকে ৭ লাখ টন।বছরে ভোজ্যতেলের চাহিদা প্রায় ২০ লাখ টন। শুধু রোজার মাসে চাহিদা আড়াই থেকে ৩ লাখ টন। স্থানীয় ভাবে দুই লাখ ৩ হাজার টন উৎপাদিত হয়। বাকি ১৮ লাখ টন আমদানি করতে হয়।
বছরে ১৮ লাখ টন পরিশোধিত চিনির চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে রমজানের চাহিদা ৩ লাখ টন। আখ থেকে চিনির স্থানীয় উৎপাদন ৩০ থেকে ৪০ হাজার টন। বাকি ১৯ লাখ টন আমদানির মাধ্যমে চাহিদা পূরণ করতে হয়।বছরে মসুর ডালের চাহিদা ৫ লাখ টন। রমজানে এই চাহিদা ৭০ হাজার টন। স্থানীয় ভাবে উৎপাদন হয় ২ লাখ ৬ হাজার টন। আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হয় ৩ লাখ ৫০ হাজার টন।দেশে প্রতি বছর ১ লাখ টন ছোলার চাহিদা। এর মধ্যে পবিত্র রমজান মাসের চাহিদা ৮০ হাজার টন। স্থানীয় ভাবে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৬ হাজার টন। পাশাপাশি ১ লাখ টন আমদানি করতে হয়।দেশে প্রতি বছর ৪০ হাজার টন খেজুরের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে রোজার মাসে ২৫ হাজার টন দরকার হয়। বছরে আমদানি প্রায় ৫০ হাজার টন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *