বস্তি থেকে ৮ তলা বাড়িতে রহিমা
নিজস্ব প্রতিনিধি : এক সময়ের বস্তিবাসী রহিমা বেগমের জীবন অনেকটা কল্পকাহিনির মতো। গেণ্ডারিয়ার নামাপাড়া রেললাইন ঘেঁষা ঝুপড়ি থেকে তিনি গড়েছেন অঢেল সম্পদ। এখন তিনি বাস করেন অভিজাত ফ্ল্যাটে। গাড়ি, বাড়ি, ব্যাংক ব্যালেন্স কী নেই তার। রাতারাতি সৌভাগ্যের চাকা যেন তিনি ঘুরিয়েছেন নিজের হাতে।
সূত্র বলছে, রহিমা বেগম ওপরতলায় উঠেছেন মাদক ব্যবসার সিঁড়ি বেয়ে। এক সময় বস্তিতে গাঁজার পুরিয়া বেচতেন। পরে নাম লেখান ইয়াবা নেটওয়ার্কে। এ সুবাদে স্বল্প সময়েই তার সম্পদ ফুলে-ফেঁপে ওঠে। তার ব্যাংক হিসাবগুলোতে জমা পড়ে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা।
অঢেল সম্পদ : দীর্ঘ তদন্তের পর রহিমা বেগমের অঢেল বিত্তবৈভবের কিয়দংশের সন্ধান পায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। নামে-বেনামে তার ১২টি ব্যাংক হিসাবে অন্তত ২২ কোটি টাকার সন্ধান মিলেছে। এর মধ্যে রহিমা বেগমের নিজের নামে ৫টি ব্যাংক হিসাবে ১৩ কোটি, স্বামী হযরত আলীর নামে খোলা ৩ অ্যাকাউন্টে ৭ কোটি এবং দুই নাবালক সন্তানের নামে খোলা ৪টি অ্যাকাউন্টে আরও রয়েছে ২ কোটি টাকা।
নগদ টাকা ছাড়াও রহিমার নামে বহুতল বাড়ি, ফ্ল্যাট এবং মূল্যবান গাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে আছে ফতুল্লার ভুঁইগড় এলাকায় ৮ তলা বাড়ি এবং সবুজবাগের মেরাদিয়া এলাকায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকার প্লট এবং রাজধানীতে অন্তত ৫টি ফ্ল্যাট।
রহিমার ব্যাংক হিসাব সংক্রান্ত কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখা যায়, অ্যাকাউন্ট খোলার সময় আয়ের উৎস হিসাবে তিনি একেক ব্যাংকে একেক ঘোষণা দেন। কোথাও লেখেন ব্যবসা, কোথাও লিখেছেন চাকরি। তিনি বেশিরভাগ হিসাব খোলেন সরকারি ব্যাংকে। তবে ৩-৪টি অ্যাকাউন্ট খুলেছেন কয়েকটি নামকরা বেসরকারি ব্যাংকেও। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে রহিমার ব্যাংক হিসাবগুলোতে সন্দেহজন লেনদেন হয়। জমা পড়ে কোটি কোটি টাকা।
কিন্তু রহস্যজনক কারণে ব্যাংকের তরফ থেকে তার কাছে অর্থের উৎস সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়নি। মাদক ব্যবসার টাকা তিনি ইচ্ছেমতো লেনদেন করতে সক্ষম হন। এছাড়া মাদক ব্যবসা আড়াল করতে বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও খোলেন রহিমা। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে জাহিদ জীবন ল্যান্ড বিজনেস সেন্টার নামের জমি কেনাবেচার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে তার।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রহিমার ব্যক্তিগত জীবন উচ্ছৃঙ্খল। ক্ষমতা বলয়ে চলাফেরা করেন তিনি। বস্তিবাসী জীবনে তিনি আব্দুল মালেক নামের একজনের ঘরণী ছিলেন। কিন্তু ইয়াবার জগতে ঢুকে বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে তিনি স্বামী বদলান। আগের স্বামী আব্দুল মালেককে তালাক দেন। বিয়ে করেন কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী হযরত আলীকে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।
মাদক ব্যবসার মানিকজোড় বলে কথা। জমে ওঠে স্বামী-স্ত্রীর যৌথ মাদক ব্যবসা। তাদের এই কেরামতি ব্যবসায় আরও ফুলে-ফেঁপে ওঠে সম্পদ। অবশ্য তা বেশিদিন এগোতে পারেনি। এক পর্যায়ে সবাইকে মেনেজ করতে ব্যর্থ হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়তে হয় হযরত আলীকে। এরপর বিধি বাম। কিছুদিন পর রহিমার কাছে খবর আসে তার স্বামী ক্রসফায়ারে মারা গেছেন।
সূত্র বলছে, হযরত আলী যাত্রাবাড়ী এলাকায় মাদকের ত্রাস হিসাবে পরিচিত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে ডজনখানেক মাদক মামলা ছিল। তবে স্বামীর ক্রসফায়ারে দিশেহারা হয়ে পড়েন রহিমা। বিশেষ করে তার মধ্যেও ক্রসফায়ারের ভয় আতঙ্ক ভর করে। এরপর মৃত্যুভয়ে গা ঢাকা দেন। এক পর্যায়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান ভারতে। তবে ২ বছর আগে বিশ্বব্যাপী করোনার প্রকোপ শুরু হলে তিনি দেশে ফিরতে বাধ্য হন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, বুধবার রহিমার বিরুদ্ধে অর্থ পাচার আইনে রাজধানীর গেণ্ডারিয়া থানায় মামলা করা হয়েছে। অর্থসম্পদের পাশাপাশি তার শেল্টারদাতাদের খোঁজ চলছে। এছাড়া রহিমা যাতে দেশের বাইরে পালাতে না পারেন সেজন্য ইমিগ্রেশন বিভাগেও চিঠি দেওয়া হচ্ছে।
এ সংক্রান্ত মামলার বাদী মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক আলী আসলাম হোসেন বলেন, রহিমা বেগম অবৈধ মাদক ব্যবসার মাধ্যমে বিপুল অর্থসম্পদ গড়েছেন। এসব অবৈধ অর্থসম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বদ্ধপরিকর।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অঢেল সম্পদ থাকলেও রহিমার আয়কর ফাইল একেবারে ফাঁকা। সম্পদের তথ্য গোপন করে ৫ বছর ধরে তিনি মিথ্যা আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তিনি আয় দেখিয়েছেন মাত্র ২ লাখ ৯০ হাজার টাকা এবং মোট সম্পদ দেখানো হয়েছে ১৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকার।
সূত্র বলছে, রহিমার মাদক সিন্ডিকেটে জড়িত অনেকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসাধু সদস্যরাও নিয়মিত মাসোহারা নিতেন তার কাছ থেকে। এ কারণে অনেকটা বাধাহীনভাবে মাদক ব্যবসা করতে সক্ষম হন রহিমা। তদন্ত পর্যায়ে এসব নেপথ্য শেল্টারদাতাদের নামও জানার চেষ্টা করা হবে। রহিমা বেগমের বর্তমান ঠিকানা ফতুল্লার মাহমুদপুর গ্রাম, তবে তার স্থায়ী ঠিকানা মাদারীপুরের রাজৈর থানার মঠবাড়ী এলাকার আমগ্রাম। পিতার নাম শহিদ মাতবর।